প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামীকাল বুধবার ভিন্ন এক প্রেক্ষাপটে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং এবং প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াংয়ের সঙ্গে পৃথক আলোচনায় বসছেন। গত এক দশকে দুই দেশের সম্পর্কের গুণগত উত্তরণ ঘটেছে। চীনের অঞ্চল ও পথের (বেল্ট অ্যান্ড রোড) উদ্যোগে বাংলাদেশ যুক্ত হয়েছে। চীন অর্থায়ন করেছে পদ্মা রেলসেতু ও বঙ্গবন্ধু টানেলের মতো বড় প্রকল্পে।
তবে এবার বেইজিংয়ে গ্রেট হল অব পিপলে দুই দেশের শীর্ষ নেতাদের বৈঠক শুধু দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের পরিমণ্ডলেই সীমিত থাকবে না। পরিবর্তিত সমকালীন আঞ্চলিক আর বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে প্রাসঙ্গিকভাবেই গুরুত্ব পাবে ভূরাজনীতি আর ভূ–অর্থনীতি।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, আগামীকাল দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীদের আনুষ্ঠানিক আলোচনায় যথারীতি অর্থনৈতিক সহযোগিতা প্রাধান্য পাবে। তবে সামগ্রিকভাবে সম্পর্কের গুণগত পরিবর্তনে ‘নিবিড় কৌশলগত অংশীদারত্বে’ উত্তরণের ঘোষণা আসতে পারে। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের সমন্বিত উন্নয়নের উদ্যোগে চীনের যুক্ততার ঘোষণার মধ্য দিয়ে বড় পরিসরে অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় বেইজিংয়ের ভূমিকার বিষয়টিও স্পষ্ট হওয়ার কথা রয়েছে।
ভারত সফরের পরেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরের বিষয়টি আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল। সাম্প্রতিক সময়ের আলোচিত তিস্তা বৃহদায়তন প্রকল্পে চীনের প্রস্তাব আপাতত আর এগোচ্ছে না। কারণ, ভারত এরই মধ্যে দুই দেশের অভিন্ন নদীর প্রকল্পে আগ্রহ দেখিয়েছে। একটি কারিগরি দল পাঠানোরও ঘোষণা দিয়েছে। তিস্তা প্রকল্পের পাশাপাশি প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের অন্যতম পরিকল্পনা বৈশ্বিক উন্নয়ন উদ্যোগে (জিডিআই) বাংলাদেশের যুক্ততায় চীন বেশ আগ্রহী ছিল। এ সফরে এ নিয়ে সমঝোতা স্মারক সইয়ের বিষয়ে দুই দেশ প্রস্তুতিও নিয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ করে গত মাসের শেষ সপ্তাহে এসে বাংলাদেশ জিডিআইয়ের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে।
বেইজিংয়ের গ্রেট হল অব পিপলে কাল সকালে চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াংয়ের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হবে। বিকেলে একই স্থানে আলোচনা হবে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল সোমবার বিকেলে বেইজিং পৌঁছান। প্রধানমন্ত্রীর ৯১ সদস্যের প্রতিনিধিদলে রয়েছেন অর্থমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, তথ্য ও যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ পলক ও বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু। এই সফরে ৫৯ সদস্যের আলাদা একটি ব্যবসায়ী দলও চীন সফর করছে।
কী হবে জিডিআইয়ের
চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়াও ওয়েন ২০২২ সালে ঢাকা সফরে এলে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের দুই বৈশ্বিক উদ্যোগ জিডিআই এবং বৈশ্বিক নিরাপত্তা উদ্যোগে (জিএসআই) বাংলাদেশকে যুক্ত হওয়ার অনুরোধ জানায়। পরে এ নিয়ে বাংলাদেশের কাছে সমঝোতা স্মারকের (এমওইউ) পাশাপাশি প্রয়োজনীয় নথিও পাঠায় চীন। শুরুতে বাংলাদেশ নিরাপত্তার উপাদান থাকায় জিএসআই সইয়ে অনীহার কথা জানিয়ে দেয়। জিডিআই নিয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখালেও বাংলাদেশ এ নিয়ে কিছু সই করার আগে সময় নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সমঝোতা সই না করলেও বাংলাদেশ যাতে জিডিআইয়ের সহযোগীদের ফোরামে যোগ দেয়, সে ব্যাপারে চীন বেশ আগ্রহী ছিল। এমনকি গত বছর জিডিআই নিয়ে মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানায় চীন। ওই বৈঠকের পর যৌথ ঘোষণায় বাংলাদেশকে সই করার অনুরোধ করেছিল চীন। কিন্তু কৌশলগত কারণে বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত সই করেনি।
সরকারের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, জিডিআই শেষ পর্যন্ত চীনের ৫০০ কোটি ডলারের দর–কষাকষির অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। চীন যদি বাংলাদেশের শর্ত মেনে ঋণ দেয়, সে ক্ষেত্রে একেবারে শেষ মুহূর্তে যৌথ ঘোষণায় ঢাকায় জিডিআইয়ে যুক্ত হবে এমন ঘোষণা দিতে পারে।
কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা মনে করেন, বাংলাদেশের জিডিআইতে যুক্ততার মধ্যে তেমন কোনো সমস্যা নেই। এটি মূলত উন্নয়নকেন্দ্রিক উদ্যোগ। এখন চীনের কাছ থেকে ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে এটিকে বাংলাদেশ কতটা দর–কষাকষির অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
গবেষণাপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের (বিআইপিএসএস) প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর এবারের সফর কিন্তু দ্বিপক্ষীয় পরিসরে সীমিত থাকছে না। ভারত, প্রশান্ত মহাসাগরসহ বিশ্বের নানা প্রান্তে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রসহ তার মিত্রদের কৌশলগত লড়াইয়ের আবহ এই সফরে থাকবে। ফলে সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে নতুন প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিতে হবে। আর চীনের কাছ থেকে বাংলাদেশের নিজের স্বার্থ বজায় রেখে অর্থনৈতিক সুবিধা আদায়ের ক্ষেত্রে জটিলতার মুখোমুখি হতে হবে। কোনো কোনো পক্ষের চাপ অগ্রাহ্য করেই বাংলাদেশকে দেশের স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে এগোতে হবে।
আলোচ্যসূচিতে তিস্তা নেই
২০১১ সাল থেকে বাংলাদেশ ও ভারতের অভিন্ন ৫৪ নদীর অন্যতম তিস্তার ভাগ্য ঝুলে গেছে। ২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেদ৶ মোদি দিল্লিতে শীর্ষ বৈঠকের পর প্রত্যয়ের সঙ্গে বলেছিলেন, তাঁদের ক্ষমতার মেয়াদে তিস্তা চুক্তি সই হবে। এরপরও চুক্তিটি সই হয়নি। এমন প্রেক্ষাপটে তিস্তায় একটি বৃহদায়তন প্রকল্প গ্রহণের জন্য বাংলাদেশ ২০১৯ সালের দিকে একটি সমীক্ষা চালায়। পরে ওই সমীক্ষা শেষে চীনের কাছে অর্থায়নের প্রস্তাব দিলে দেশটি এতে আগ্রহ দেখায়। তিস্তায় অর্থায়নের জন্য চীন প্রস্তাব দেয়। দুই দেশের অভিন্ন নদী তিস্তায় চীনের এই প্রস্তাব নিয়ে ভারত ২০২০ সালে থেকে উদ্বেগ দেখিয়ে আসছে। পরে তিস্তার প্রস্তাব নিয়ে বাংলাদেশ ও চীন একাধিকবার নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে প্রস্তাব সংশোধনও করেছে। গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর তিস্তা প্রকল্পে ইতিবাচক সাড়া পাবে, এমনটা ধারণা ছিল চীনের। কিন্তু সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে তিস্তা নিয়ে বাংলাদেশের আলোচনা গত কয়েক মাসে থমকে গেছে। আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের পর তিস্তা নিয়ে চীনের আশা একেবারে ফিকে হয়ে গেছে। এবারের আলোচ্যসূচিতেও তিস্তা নেই।
তিস্তা প্রকল্প নিয়ে চীনের প্রস্তাবের বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ গত রোববার সাংবাদিকদের স্পষ্ট করে বলেছেন, চীন যদি বিষয়টি আলোচনায় তোলে, তবেই আলোচনা হবে। কারণ, ভারত এরই মধ্যে দুই দেশের অভিন্ন নদীর ব্যবস্থাপনায় একটি প্রস্তাব দিয়েছে। সুতরাং বাংলাদেশকে সেই প্রস্তাব বিবেচনায় নিতে হবে।
চীনের ঋণ কি আসছে
চীনের যেমন তিস্তা আর জিডিআইয়ে বেশ মনোযোগ ছিল, বাংলাদেশের এখন পর্যন্ত অন্যতম অগ্রাধিকার চীনের কাছ থেকে ৫০০ কোটি ডলারের ঋণসহায়তা।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, চীনের সঙ্গে এখন সুদের হার নির্ধারণের চেয়ে সুদ পরিশোধের সময়সীমা, কিস্তি শুরুর আগে রেয়াতি সময় (গ্রেস পিরিয়ড) নিয়েই বেশি আলোচনা চলছে। বাংলাদেশ চায় নতুন ঋণ পরিশোধের সময়সীমা অন্তত ৩০ এবং গ্রেস পিরিয়ড কমপক্ষে ১০ বছর। এ বিষয়ে চীনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ঋণের সুদের হার ১ শতাংশ হলে ঋণ পরিশোধের সময়সীমা অন্তত ২০ ও গ্রেস পিরিয়ড ৫ বছর। আর বাংলাদেশের প্রস্তাব অনুযায়ী, ঋণ পরিশোধের সময়সীমা অন্তত ৩০ ও গ্রেস পিরিয়ড ১০ বছর করা হলে সুদের হার হবে ২ শতাংশ। এ বিষয়ে কর্মকর্তা পর্যায়ের আলোচনা এগোয়নি। তবে রাজনৈতিক পর্যায়ে অগ্রগতি হলেও হতে পারে।
অতীতে নেওয়া চীনা ঋণের সুদের হার সব মিলিয়ে ২ শতাংশের আশপাশেই আছে। বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাইকাসহ অন্যান্য সংস্থার ঋণের সুদের হারও প্রায় একই। কিন্তু বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকার মতো ঋণদাতা সংস্থার ঋণ পরিশোধের জন্য ৩০–৪০ বছর সময় পাওয়া যায়।
চীনা ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময়সীমা বেশ কম। ৫ বছর গ্রেস পিরিয়ড বাদ দিলে ১০–১৫ বছরে এ ঋণ পরিশোধ করতে হয়। এতে প্রতিটি কিস্তিতে অর্থের পরিমাণ বেশি হয়, যা সার্বিক ঋণ পরিশোধে চাপ সৃষ্টি করে।
জানতে চাইলে সাবেক রাষ্ট্রদূত ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের (বিইআই) প্রেসিডেন্ট এম হুমায়ুন কবির প্রথম আলোকে বলেন, এক চীন নীতি, দক্ষিণ চীন সাগর, তাইওয়ানের পাশাপাশি বাণিজ্যের বিষয়ে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে চীন চাপে রয়েছে। ফলে বাংলাদেশকে জোরালোভাবে পাশে পেতে চাইবে চীন। তাই এ সফরটা শুধুই দ্বিপক্ষীয় থাকছে না।
prothom alo