পদ হারানোর শঙ্কায় বিএনপি নেতারা

পদ হারানোর শঙ্কায় বিএনপি নেতারা

দল পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় পদ হারানোর আতঙ্কে ভুগছেন বিএনপি নেতারা। সরকারবিরোধী আন্দোলনে ব্যর্থতার দায়ে একের পর এক কমিটি বিলুপ্ত করেছেন দলটির হাইকমান্ড। মূল দলের বিভিন্ন ইউনিটের পাশাপাশি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর কমিটিও ভাঙা হচ্ছে। রদবদল করা হচ্ছে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোও। এরই ধারাবাহিকতায় খুব দ্রুতই বিএনপির মেয়াদোত্তীর্ণ জেলা কমিটি ও অঙ্গ সংগঠনগুলোও ভেঙে দেওয়া হবে। পূরণ করা হবে দলটির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির শূন্য পদগুলোও।

এ পরিস্থিতিতে দলের জ্যেষ্ঠ নেতা থেকে শুরু করে প্রতিটি সাংগঠনিক ইউনিট ও অঙ্গ সংগঠনের মধ্যে চলছে অস্থিরতা। গ্রাস করেছে পদপদবি হারানোর শঙ্কা। সেই সঙ্গে মানসম্মান নিয়ে রাজনীতি করার নিশ্চয়তা নিয়েও উদ্বিগ্ন দলের অনেক জ্যেষ্ঠ নেতা।

বিএনপির বেশ কয়েকজন নেতা সমকালকে জানিয়েছেন, তাদের মধ্যে এক ধরনের ভীতি কাজ করছে। তারা বলেন, দল পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে এসব কমিটি ভাঙা, কেন্দ্রীয় কমিটিতে রদবদল আনা হলেও কোন ফর্মুলায় করা হয়েছে, তা তারা জানেন না। কমিটিতে যাদের পুরস্কৃত করা হয়েছে, তাদের কী যোগ্যতায় করা হয়েছে, আবার যাদের পদাবনতি করা হয়েছে, তা কীসের ভিত্তিতে– তাও তারা বুঝতে পারছেন না।

তারা জানান, দলের হাইকমান্ড হঠাৎ করে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে যে প্রক্রিয়ায় বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটিতে রদবদল করেছেন, এ বিষয়ে তারা অবহিত ছিলেন না। এটা দলকে শক্তিশালী করতে কতটা কার্যকর ভূমিকা

রাখবে বা কতটা এগিয়ে নেবে বিএনপিকে, তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে নেতাকর্মীর। এসব হিসাবনিকাশ করে ক্ষোভও প্রকাশ করছেন অনেক নেতাকর্মী।

তারা বলছেন, বিএনপির সব কাজকর্মই এখন নজিরবিহীন। পক্ষকালের বেশি সময় ধরে গুরুত্বপূর্ণ ঢাকা মহানগর ছাড়াও দেশের আরও তিন মহানগর এবং কেন্দ্রীয় যুবদল অভিভাবকহীন হয়ে আছে। এর আগে এটা কখনও হয়নি। কমিটি ভেঙে কমিটি হয়েছে। এ রকম ঝুলিয়ে রাখা হয়নি, নেতৃত্বশূন্য করা হয়নি। কবে এসব কমিটি ঘোষণা হবে, তাও কেউ বলতে পারছেন না।

এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান সমকালকে বলেন, বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটিতে বাকি শূন্য পদগুলোও সামনে পূরণ করা হবে। পাশাপাশি সদ্য বিলুপ্ত হওয়া ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপি এবং যুবদলের কমিটিও খুব শিগগির দেওয়া হবে।

জানা গেছে, কমিটি রদবদলের প্রক্রিয়ায় খুব শিগগির আরও কিছু চমক আসতে পারে। সেখানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা থাকতে পারেন পদাবনতির তালিকায়। অভিজ্ঞ ও গ্রহণযোগ্য এসব নেতাকে সাইডলাইনে বসিয়ে রাখা হতে পারে। আবার অনেক কম পরিচিত নেতাকেও লাইমলাইটে নিয়ে আসা হতে পারে। অনেক প্রবাসী নেতাকেও পদায়ন করা হতে পারে, যদিও তারা মামলা-হামলা থেকে অনেক দূরে আছেন।

বরিশাল স্বেচ্ছাসেবক দলের এক নেতা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘বিএনপি এখন কমিটি ভাঙাভাঙি নিয়েই ব্যস্ত। এভাবেই তারা জীবন পার করবে। ক্ষমতায় আর আসা লাগবে না!’
এ ব্যাপারে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, কেন্দ্রীয় কমিটিতে আরও রদবদল হবে কিনা, সেটা বিএনপির হাইকমান্ড সিদ্ধান্ত নেবেন। এটি একটি রুটিন ওয়ার্ক। সুতরাং বিএনপির হাইকমান্ড যদি মনে করেন, তাহলে আরও রদবদল হতে পারে।

গত ১৫ জুন বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটিতে ৪৫টি পদে রদবদল করা হয়। একই দিন বিদেশবিষয়ক দুটি (চেয়ারপারসনস ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যাডভাইজরি কমিটি এবং স্পেশাল অ্যাসিস্ট্যান্ট টু দ্য চেয়ারপারসনস ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যাডভাইজরি) কমিটি গঠন হয়। এতে প্রধান করা হয় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে। পরে গত ২৪ জুন এ কমিটিতে আরও ১৭ জনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৫ জুন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সংসদের ২৬০ সদস্যবিশিষ্ট আংশিক পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয় এবং বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য অধ্যাপক ডা. মওদুদ হোসেন আলমগীর পাভেলকে ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক থেকে পূর্ণাঙ্গ আহ্বায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তবে তাঁকে বেশির ভাগ নেতাকর্মীই চেনেন না। মিডিয়ার সঙ্গেও তাঁর কোনো সম্পৃক্ততা নেই।

এর আগে ১৩ জুন সরকার পতনের এক দফার আন্দোলনে ব্যর্থতার অভিযোগে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও বরিশাল মহানগর বিএনপির চারটি আহ্বায়ক কমিটি এবং কেন্দ্রীয় যুবদলের কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়। একই দিন ছাত্রদলের ঢাকা মহানগরের চারটি কমিটিও বিলুপ্ত করা হয়। তবে যে কোনো সময় যুবদল, ঢাকা মহানগর ছাত্রদলসহ বিএনপির চার ইউনিটে নতুন কমিটি ঘোষণা করা হবে বলে জানা গেছে।
বিএনপির বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী বলেন, যারা এই কমিটি ভাঙাভাঙি আর রদবদলের সঙ্গে জড়িত, তাদের কি কখনও আন্দোলনের কোনো প্ল্যাটফর্মে দেখা গেছে? তাদের কী ভূমিকা ছিল? এখন যাদের পদায়ন করা হচ্ছে, তাদেরও কী ভূমিকা ছিল? এটাকে তারা দল দুর্বল করার প্রক্রিয়া হিসেবেই দেখছেন। দল পুনর্গঠনের যুক্তি দিয়ে এই প্রশ্নবিদ্ধ রদবদল প্রক্রিয়া নেতাকর্মীকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি।
নেতাকর্মীরা বলছেন, দায়িত্বশীল পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া নেতাদের মধ্যে মাহবুবউদ্দিন খোকন, মজিবর রহমান সরোয়ার, মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল ও হারুন অর রশিদের মতো অভিজ্ঞরাও রয়েছেন। যুগ্ম মহাসচিবের পদ থেকে সরিয়ে তাদের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য করা হয়েছে। সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ থেকে সরিয়ে উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য করা হয়েছে রুহুল কুদ্দুস তালুকদারকে। এ ধরনের রদবদলকে তারা অশনিসংকেত হিসেবে দেখছেন। আবার যুবদলের সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর মতো অভিজ্ঞ নেতাকে সরিয়ে এখন কাদের ওপর ভর করে সামনের দিনগুলোতে আন্দোলন পরিচালনা করবেন দলের হাইকমান্ড, তা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেছেন দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা। এখন স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় কমিটি ভেঙে দেওয়ার জোর গুঞ্জনও শুরু হয়েছে। মেয়াদ থাকার পরও কমিটি ভাঙার ঘটনাকে নজিরবিহীন বলে মনে করছেন নেতাকর্মীরা। এই প্রক্রিয়ায় যুবদলের মতো স্বেচ্ছাসেবক দলের কমিটি ভাঙলে অস্থিরতা তৈরি হবে বলেও আশঙ্কা তাদের।

বিদেশবিষয়ক দুটি কমিটি গঠন নিয়েও নেতাকর্মীর প্রশ্ন রয়েছে। ২০১৬ সালে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার হাত ধরে গঠিত ওই কমিটির ধারাবাহিকতায় ২০১৯ সালে ২১ সদস্যবিশিষ্ট বিদেশবিষয়ক কমিটি (ফরেন অ্যাফেয়ার্স) পুনর্গঠন করেন দলটির হাইকমান্ড। কূটনৈতিক উইংয়ে কাজ করতে যেসব যোগ্যতাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়, এবার তার অনেক কিছুই নেই নতুন কমিটির অনেক সদস্যের মধ্যে। আবার আগের দুই কমিটিতে কাজ করলেও এবার শুধু ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানাকে বাদ দেওয়া হয়েছে। কোন ব্যর্থতার দায়ে তাঁকে সরানো হলো তা কেউ জানেন না। এ নিয়েও দলের নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ। নতুন কমিটির অনেক নেতাকে কেউ চেনেন না। প্রবাসে তাদের কাজের ধরন নিয়েও আছে সমালোচনা। এ রকম লোক কীভাবে কূটনৈতিক উইংয়ে কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন, তা নিয়ে আলোচনা আছে খোদ দলের মধ্যে।

তিন শাখায় নতুন কমিটির সম্ভাবনা
যে কোনো সময়ে বিএনপির ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের আহ্বায়ক কমিটি কিংবা আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হতে পারে। উত্তরের নতুন কমিটিতে আলোচনায় রয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হাবিবুর রহমান হাবিব, সদ্য বিলুপ্ত কমিটির সদস্য সচিব আমিনুল হক, যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম নিরব, যুবদলের সাবেক সহসভাপতি এস এম জাহাঙ্গীর ছাড়াও মহানগর উত্তরের নেতা আনোয়ারুজ্জামান আনোয়ার, কফিলউদ্দিনসহ আরও অনেকে।

দক্ষিণের নতুন কমিটিতে সভাপতি পদে আলোচনায় রয়েছেন সদ্য বিলুপ্ত কমিটির সদস্য সচিব রফিকুল আলম মজনু। আর সদস্য সচিব কিংবা সাধারণ সম্পাদক পদে সদ্য বিলুপ্ত কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক তানভীর আহমেদ রবিন আলোচনায় আছেন। সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক লিটন মাহমুদ এবং ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রশিদ হাবিবের নামও শোনা যাচ্ছে।

যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটিও যে কোনো মুহূর্তে ঘোষণা করা হতে পারে। নতুন কমিটিতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদের জন্য আলোচনায় রয়েছেন সদ্য বিলুপ্ত কমিটির সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি মামুন হাসান, সহসভাপতি নূরুল ইসলাম নয়ন, ১ নম্বর যুগ্ম সম্পাদক গোলাম মাওলা শাহিন ও জিয়াউর রহমান জিয়া। এ ছাড়া সদ্য সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোনায়েম মুন্না, সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক শফিকুল ইসলাম মিল্টন, সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ইসহাক সরকার, ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসান, ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ফজলুর রহমান খোকনের নামও আলোচনায় রয়েছে।

samakal