রপ্তানিতে সরকারি তথ্যেই ১৪ বিলিয়নের গোঁজামিল

রপ্তানিতে সরকারি তথ্যেই ১৪ বিলিয়নের গোঁজামিল

সাম্প্রতিক সময়ে দেশের রপ্তানি কমলেও ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখিয়ে আসছিল সরকারি সংস্থা রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো-ইপিবি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে রপ্তানি কমেছে। ইপিবি এপ্রিল পর্যন্ত গত অর্থবছরের ১০ মাসে পণ্য জাহাজীকরণের ভিত্তিতে রপ্তানির যে তথ্য প্রকাশ করেছিল, প্রকৃত রপ্তানি তার চেয়ে প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলার কম। রপ্তানি আয় প্রত্যাবাসনের সঙ্গে এই পার্থক্য আরও অনেক বেশি হবে। প্রকৃত তথ্যের ফলে দেশের চলতি হিসাবে বড় ঘাটতি দেখা দিয়েছে।

ব্যবসায়ীরা বেশ আগে থেকে ইপিবির তথ্যের সঠিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে আসছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে ইপিবির তথ্যে বড় পার্থক্য নিয়ে বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে রিপোর্ট হয়েছে। আইএমএফ থেকে এ নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। এর পর বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও ইপিবি কয়েক দফা বৈঠক করে। সেখানে উঠে আসে, অনেক ক্ষেত্রে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ রপ্তানির একই তথ্য একাধিকবার হিসাব করছে। এতে প্রকৃত হিসাবের সঙ্গে এত পার্থক্য থাকছে। এনবিআর সংশোধিত পদ্ধতিতে চলতি অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত রপ্তানি পণ্য জাহাজীকরণের তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংক ও ইপিবিতে পাঠিয়েছে। সে অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংক গতকাল ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ের ব্যালান্স অব পেমেন্ট বা বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্যের হিসাব প্রকাশ করেছে। রপ্তানি আয় অনেক কমে যাওয়ায় এই হিসাব ওলটপালট দেখা যাচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এপ্রিল পর্যন্ত ১০ মাসে ৩ হাজার ৩৬৭ কোটি ডলারের পণ্য জাহাজীকরণ করা হয়েছে। আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় যা ৬ দশমিক ৮০ শতাংশ কম। ইপিবি প্রকাশিত তথ্যে এপ্রিল পর্যন্ত রপ্তানি দেখানো হয় ৪ হাজার ৭৪৭ কোটি ডলারের বা ৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ বেশি। এর মানে পণ্য জাহাজীকরণেই পার্থক্য ১৩ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার।

এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরের ইপিবি জুলাই-এপ্রিল সময়ে ৪ হাজার ৫৬৮ কোটি ডলার রপ্তানি দেখিয়েছিল। সংশোধিত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, আসলে পণ্য জাহাজীকরণ হয় মাত্র ৩ হাজার ৬১৪ কোটি ডলার। এর মানে ইপিবির তথ্যের সঙ্গে পার্থক্য ৯৫৪ কোটি ডলার।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি দেখানো হয় ৫ হাজার ৫৫৬ কোটি ডলারের। আর দেশে এসেছিল ৪ হাজার ৩৫৭ কোটি ডলার। পার্থক্য ছিল ১ হাজার ১৯৯ কোটি ডলারের। ২০২১-২২ অর্থবছর ইপিবির হিসাবে রপ্তানি হয়েছিল ৫ হাজার ২০৮ কোটি ডলার। আর দেশে এসেছিল ৪ হাজার ৩৬০ কোটি ডলার। কম এসেছিল ৮৪৮ কোটি ডলার।

নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম সমকালকে বলেন, ইপিবির তথ্য যে সঠিক নয়, বেশ আগ থেকে তারা বলে আসছেন। ২০২২ সালের নভেম্বরে এ নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে তিনি কথা বলেন। তার বক্তব্য ছিল, এত রপ্তানি ব্যবসায়ীরা করেননি। তাদের বক্তব্য আমলে না নিয়ে ভুল তথ্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন নীতিমালা নেওয়া হয়েছে। তাদের সুবিধা কমানো হয়েছে। তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা সবাই জানেন, ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণের পর ডব্লিউটিওর শর্ত মেনে সাধারণভাবে আর নগদ সহায়তা নেওয়া যাবে না। অবশ্য সমঝোতার ভিত্তিতে উত্তরণের পর আরও তিন বছর সুবিধা পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। অথচ আড়াই বছর আগেই নগদ সহায়তা কমানো হলো। এর মাধ্যমে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কার স্বার্থে করা হচ্ছে, তা বোধগম্য নয়।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ইপিবি মূলত এনবিআরের কাস্টম হাউসের তথ্যের ভিত্তিতে পরিসংখ্যান প্রকাশ করে। কাস্টমস কর্তৃপক্ষ রপ্তানির জন্য জাহাজীকরণের আগে পণ্য যাচাইয়ের পর বিল অব এক্সপোর্ট ইস্যু করে। এটি ধরেই তারা রপ্তানি হিসাব করে থাকে। তবে বিল অব এক্সপোর্ট ইস্যুর পর কোনো ত্রুটি বা অন্য কোনো কারণে রপ্তানি বাতিল হলেও হিসাব থেকে আর বাদ দেওয়া হতো না। আবার কাউকে উপহার বা স্যাম্পল হিসেবে পণ্য পাঠালে রপ্তানি হিসেবে গণ্য করা হতো। এসব কারণে প্রকৃত রপ্তানির চেয়ে অনেক বেশি দেখা যেত।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও ভারপ্রাপ্ত মুখপাত্র সাইফুল ইসলাম সমকালকে বলেন, ইপিবির রপ্তানি তথ্যের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে আগে থেকেই পার্থক্য ছিল। এখন আগের হিসাব পদ্ধতি সংশোধন করা হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশিত সংশোধিত তথ্য অনুযায়ী, গত এপ্রিল পর্যন্ত ৩৩ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার রপ্তানির বিপরীতে আমদানি হয়েছে ৫২ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলার। এতে করে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে ১৮ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলারে উঠেছে। গত মার্চ পর্যন্ত যেখানে বাণিজ্য ঘাটতি দেখানো হয় ৪ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলার। এপ্রিল পর্যন্ত ১৯ দশমিক ১২ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স এসেছে। দুয়ে মিলে চলতি হিসাবে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলার।

গত মার্চ পর্যন্ত যেখানে উদ্বৃত্ত দেখানো হয় ৫ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার। আর্থিক হিসাবে এপ্রিল পর্যন্ত ২ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলারের উদ্বৃত্ত দেখা যাচ্ছে। আর গত অর্থবছরের একই সময়ে উদ্বৃত্ত দেখানো হয়েছে ৩ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলার। গত মার্চ পর্যন্ত যেখানে ঘাটতি দেখানো হয়েছিল ৯ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলার। সব মিলিয়ে সামগ্রিক লেনদেন ভারসাম্যে ৫ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। গত এপ্রিল পর্যন্ত যেখানে ঘাটতি ছিল ৪ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার।

samakal