রাজধানীর ৫০ থানায় জিডি ঢাকায় দেড় বছরে নিখোঁজ ৪০৫২

logo

ফাহিমা আক্তার সুমি

২৪ জুন ২০২৪, সোমবার

mzamin

facebook sharing button

আনোয়ারুল আজিম আনার। তিনি ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন। ঢাকার মানিক মিয়া  এভিনিউয়ের বাসায় সপরিবারে বসবাস করতেন। গত ১২ই মে চিকিৎসার জন্য ভারতে যান। তিন দিন পার হলেও পরিবারের সদস্যরা তার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করতে পারেননি। এরপর থেকেই রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হন তিনি। আনারের খোঁজ পেতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারস্থ হন স্বজনরা। ৮ দিন নিখোঁজ থাকার পর বিদেশের মাটিতে নৃশংস খুন হওয়ার খবর পাওয়া যায়। তার লাশ গুম করার জন্য পৈশাচিকভাবে মরদেহ টুকরো টুকরো করে বিভিন্ন স্থানে ফেলে দেয়া হয়। এই হত্যাকাণ্ডে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে ভারতীয় ও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।

পরবর্তীতে আনার খুন হওয়ার ঘটনায় রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় অপহরণ মামলা করেন তার মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন। নানা কারণে এভাবে কেউ নিখোঁজ হলে পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় জিডি করা হয়। জিডির তথ্য অনুযায়ী রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, মামলা থেকে মুক্তি পেতে, অভাব, ব্যক্তিগত স্বার্থ কিংবা দ্বন্দ্ব-বিদ্বেষসহ বিভিন্ন কারণে নিখোঁজের ঘটনাগুলো ঘটছে। পুলিশ বলছে, নানা কারণে নিখোঁজের জিডি হয়। কেউ পূর্বশত্রুতার কারণে অপহরণ ও খুনের শিকার হন। আবার কম বয়সী ছেলেমেয়েরা প্রেমের কারণে পালিয়ে যায় খোঁজ না পেয়ে পরিবার জিডি করে। থানায় নিখোঁজের কোনো জিডি হলে একজন ইনকোয়ারি অফিসার নিয়োগ করা হয়। সে নিখোঁজ ব্যক্তিদের ট্রেস আউট করে খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। অনেককে খুঁজে পাওয়া যায় আবার অনেককে ট্রেস করা যায় না। কেউ কেউ নিজ ইচ্ছায় আবার ফিরে আসে। নিখোঁজ ব্যক্তিদের ফিরে আসার পরিসংখ্যান করা কঠিন। অনেকে ফিরে আসা বা খোঁজ পাওয়ার পর সেটি আর থানায় জানায় না।

রাজধানীর থানাগুলোতে প্রায় নিয়মিতই নিখোঁজ সংক্রান্ত সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) তথ্যমতে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের মে পর্যন্ত ঢাকার ৫০টি থানায় ৪০৫২টি নিখোঁজের জিডি হয়। অর্থাৎ প্রতি মাসে গড়ে ২৩৮টি এই সংক্রান্ত ডায়েরি করা হয়। এরমধ্যে ডিএমপি’র রমনা বিভাগে ৩৭৪টি, তেজগাঁও বিভাগে ১৬২টি, গুলশান বিভাগে ৬৩২টি, ওয়ারী বিভাগে ৮৭৫টি, লালবাগ বিভাগে ৩২৪টি, উত্তরা বিভাগে ৭৪৪, মিরপুর বিভাগে ৯০টি, মতিঝিল বিভাগে ৮৫১টি। এই আট বিভাগে নিখোঁজ সংক্রান্ত সাধারণ ডায়েরি করা হয় ৪০৫২টি।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত নিখোঁজ ও গুমের অভিযোগ পেয়েছে ১২৮টি।
এদিকে ১২ দিন ধরে নিখোঁজ ছিল শিশু রবিউল হাসান রাফি। সন্তানকে খুঁজে পেতে রাত-দিন হন্য হয়ে খুঁজছিলেন বাবা-মা। সবার কাছে ফিরে পাওয়ার আকুতি জানিয়েছিলেন পরিবারটি। সে রাজধানীর তেজকুনীপাড়া বাইতুল ফালা জামে মসজিদে পড়াশোনা করে। বাসা থেকে মাদ্রাসায় যাওয়ার জন্য বের হয়ে সে মাদ্রাসায় যায়নি। বাড়িতেও ফিরে আসেনি। পরে তার সন্ধান মিলে ময়মনসিংহে। রাফির বাবা আনিছ মিয়া বলেন, এমন কোনো জায়গা নেই যে ছেলেকে খুঁজিনি। এপ্রিলের ২৮ তারিখে তেজগাঁও থানায় এই ঘটনায় জিডি করি। ওর মা অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। রাত-দিন শুধু কেঁদেই গেছে। তখন আট দিন ধরে বাসায় কোনো খাবার রান্না হয়নি। ছেলের ফিরে আসার অপেক্ষায় প্রতিদিন গভীর রাত পর্যন্ত রেলস্টেশনে গিয়ে বসে থাকতাম। ঢাকার বাইরেও খুঁজেছি। ঘটনার দিনের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, দুই পথশিশু ও এক তরুণের সঙ্গে রাফি তেজগাঁও রেলস্টেশনের ভেতরে প্রবেশ করে। ট্রেন আসার অপেক্ষায় ছিল তারা। পরে ১২ দিন পর অপরিচিত এক ব্যক্তির মাধ্যমে সন্তানের খবর পাই।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ মানবজমিনকে বলেন, এসকল ঘটনাগুলোতে সমাজ ও জনগণের মধ্যে অস্থিরতা বিরাজ করে। কখনো কখনো নিখোঁজ ব্যক্তির লাশ পাওয়া যাচ্ছে, আবার কেউ ফিরে আসছে, আবার সে কোথায় আছে বছরের পর বছর খোঁজ পাচ্ছে না পরিবার। এটি বিভিন্ন কারণে হচ্ছে। কেউ অপহরণ হচ্ছে, কেউ খুন হচ্ছে, কেউ বিদ্বেষের কারণে, কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যাচ্ছে, কেউ অভাবের কারণে, কেউ পড়াশোনার চাপে আবার কেউ মামলা-মোকদ্দমা থেকে মুক্তির জন্য পালিয়ে থাকছে। আবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক মানবজমিনকে বলেন, শিশু থেকে শুরু করে সব বয়সীরা নিখোঁজ হচ্ছে। শিশুদের নিরাপত্তা কিংবা তাদের লালন-পালনের ক্ষেত্রে আমরা কিছু ভাবছিও না। চারপাশের মানুষকে যেভাবে ইতিবাচক থাকা দরকার সেই জায়গাতেও যথেষ্ট দুর্বলতা রয়েছে। শুধু নিখোঁজে থেমে থাকছে না তাদের নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হচ্ছে। এর বাইরে যে নিখোঁজ ও অপহরণের ঘটনাগুলো হচ্ছে সেটি আমরা দেখি রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের কারণে হচ্ছে। এদের পেছনে যারা রয়েছে সে সকল ব্যক্তিকে খুঁজে বের করে দ্রুত সময়ের মধ্যে বিচার নিশ্চিত করা বা পরিবারকে সহযোগিতা করা। তিনি বলেন, বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক উঠিয়ে নিয়ে যায় সেক্ষেত্রে নিয়ম হলো সাধারণ মানুষের কাছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যে জবাবদিহিতার জায়গা, কাউকে বিশেষ জিজ্ঞাসাবাদ বলুন বা আলাপ-আলোচনার প্রয়োজন হতে পারে সেক্ষেত্রে পরিবারকে জানানো উচিত তাকে কেন নিয়ে গেল। কিন্তু আমাদের এখানে এগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতানৈক্য থাকার কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও যে সর্বদা আইন বা আইনের শিষ্টাচার ব্যবহার করছে সেটি আমরা জোর দিয়ে বলার কোনো সুযোগ নেই। বরং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কখনো কখনো উপরের পর্যায়ে বা যারা ক্ষমতায় থাকে অতীতের বা বর্তমানের প্রেক্ষাপটে এদের দ্বারা প্রভাবিত হন।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) ড. খ. মহিদ উদ্দিন মানবজমিনকে বলেন, নিখোঁজ হওয়া বেশির ভাগ ব্যক্তি ফিরে আসেন এবং তাদের পাওয়া যায়। আর কিছু কিছু হয়তো দেখা যায় নিজেরা চলে গিয়েছে। পরিবারকে না জানিয়ে পালিয়ে গেছে, বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে সেটি বেশি দেখা যায়। আবার কেউ কেউ দুর্ঘটনার শিকার হন। যারা ফিরে আসে তাদের সম্পর্কে পরিবার পুলিশকে জানায় কম। বাসা থেকে চলে যাওয়ার সংখ্যাটা বেশি। বিশেষ করে উঠতি বয়সী ছেলে-মেয়েদের নিখোঁজ হওয়ার জিডির সংখ্যা বেশি হয়। নিখোঁজ হওয়ার ক্ষেত্রে যেহেতু অনেকে ইচ্ছা করে চলে যায় এটি পরিবারের দায়িত্ব খেয়াল রাখা। আর যখন চলে যায় তখন থানাকে অবগত করতে হবে।