ভারতের বিপক্ষে ‘হার মেনে নেয়া’, ‘খোলসবন্দি’ বাংলাদেশের অসহায় আত্মসমর্পণ

  • নয়া দিগন্ত অনলাইন
  •  ২৩ জুন ২০২৪, ১১:০৯


টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে খেলার আশা কার্যত শেষ বাংলাদেশের জন্য।

সুপার এইট পর্বে নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচে বাংলাদেশকে ৫০ রানের বড় ব্যবধানে হারিয়ে ভারত সেমিফাইনাল প্রায় নিশ্চিত করেছে।

এর আগে বাংলাদেশ অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ডিএলএস পদ্ধতিতে ২৮ রানে হেরেছিল এবং ভারত আফগানিস্তানের বিপক্ষে ৪৭ রানের জয় পেয়েছিল।

ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের অ্যান্টিগার নর্থ সাউন্ডে স্যার ভিভিয়ান রিচার্ডস স্টেডিয়ামে বাংলাদেশের বিপক্ষে ভারত ১৯৫ রান তোলে জবাবে বাংলাদেশ ১৪৫ রান তুলতে সক্ষম হয়।

ভারতের হার্দিক পান্ডিয়া মাত্র ২৭ বলে ৫০ রানের একটি ইনিংস খেলে ভারতের জন্য বড় স্কোর দাঁড় করান। পরে বল হাতে একটি উইকেট নিয়ে ম্যাচ সেরার পুরস্কার পেয়েছেন এই অলরাউন্ডার।

এই ম্যাচে বাংলাদেশ দলের টসের সিদ্ধান্ত, ব্যাটিংয়ের ধরন এবং একাদশ নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, কেউ কেউ বলছেন বাংলাদেশের সেমিফাইনালে যাওয়ার কোনো তাড়নাই ক্রিকেটারদের মধ্যে দেখা যায়নি।

টস জিতে ফিল্ডিং দেখে ‘অবাক’ মাইকেল ভন
ম্যাচ শুরুর পরপরই ইংল্যান্ডের সাবেক অধিনায়ক মাইকেল ভন এক্স প্ল্যাটফর্মে (সাবেক টুইটার) একটি পোস্ট করে লেখেন, ‘দিনে খেলা এবং সেখানে বোলিং করার সিদ্ধান্ত!’

বিস্ময় প্রকাশ করে তিনি আরো লেখেন, ‘তার ওপর ভারতের দু’জন ব্যাটার যারা স্পিনে দুর্দান্ত খেলেন, তাদের সামনে দু’জন স্পিনার দিয়ে বোলিং কিভাবে শুরু করল বাংলাদেশ।’

ভারতের বিপক্ষে টসে জিতে বোলিং করার সিদ্ধান্ত নেয়ার পর প্রথমেই দুই প্রান্তে মাহেদি হাসান ও সাকিব আল হাসানকে দিয়ে বোলিং শুরু করে বাংলাদেশ।

যদিও সাকিব রোহিত শর্মার উইকেট নিয়েছেন, তবে তার আগেই অধিনায়ক রোহিত ১১ বলে ২৩ রান করে ভারতকে একটা ঝড়ো শুরু এনে দিয়েছেন ব্যাট হাতে।

ভনের মতে, ‘বা হাতি ফাস্ট বোলার মুস্তাফিজুর রহমানকে দিয়ে শুরু না করাটাও বোধগম্য না।’

বাংলাদেশের এসব সিদ্ধান্তকে ‘খুব খুব অদ্ভুত’ বলে আখ্যা দিয়েছেন মাইকেল ভন।

ম্যাচ শেষে প্রেস কনফারেন্সে সাকিব আল হাসানও বলেন, ‘ক্যারিবিয়ান কন্ডিশনে টস জয়ের পর ব্যাটিং করাটাই বেশি ভালো হতো, হয়তো অধিনায়ক ও কোচ ভেবেছেন ভারতকে আরেকটু কম রানে আটকে রাখতে পারলে ব্যাটাররা জয়ের চেষ্টা করতে পারেন।’

ব্যাটারদের চেষ্টা ছিল একেবারেই অপ্রতুল
বাংলাদেশের ব্যাটাররা জয়ের চেষ্টা করতেন বলেছেন সাকিব আল হাসান। কিন্তু এই চেষ্টাটাই মাঠে দেখা যায়নি।

এই ব্যাপারে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক তামিম ইকবাল ইএসপিএন ক্রিকইনফোর বিশ্লেষণে বলেছেন, ‘বাংলাদেশ যদি ১০০ রান করেও অলআউট হতো, তাতেও আমি খুশি হতাম যদি দেখতাম যে জয়ের জন্য চেষ্টা করছে।’

এমন একটা উইকেটে বাংলাদেশ ব্যাট করেছে যেখানে বল সহজেই ব্যাটে আসছিল, এখানে বাংলাদেশের ওপেনার তানজিদ তামিম করেছেন ৩১ বলে ২৯ রান, যা একেবারেই টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট সুলভ নয়।

ওপেনার তানজিদ তামিম ওভারপ্রতি ১০ রানের লক্ষ্য নিয়ে ব্যাট করতে নেমেছিলেন, তিনি দশম ওভারে যখন আউট হন ততক্ষণে ওভারপ্রতি ১৩ রান দরকার, এভাবেই এই ৩১ বলের ইনিংসটি বাংলাদেশের ব্যাটারদের রানের চাপ আরো বাড়িয়ে তুলেছে।

এই ৩১ বলে ১৩টি ডট বল দিয়েছেন তানজিদ তামিম, মানে প্রায় অর্ধেক বলেই তিনি কোনো রান পাননি।

অথচ পাওয়ারপ্লেতে যখন মাত্র দু’জন ফিল্ডার বাউন্ডারিতে থাকতে পারেন, এই সময়েই দ্রুত রান তুলে লক্ষ্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করেন ব্যাটাররা।

এই ম্যাচ নিয়ে নিজের পর্যবেক্ষণে তামিম ইকবাল বলেন, ‘এই ম্যাচে রান তাড়া করার সময় কোনো সময়েই মনে হয়নি বাংলাদেশ ম্যাচে আছে। ভারতের বোলাররা অনেক ভালো বল করেছেন আমি তাদের কোনো কৃতিত্ব কেড়ে নিতে চাই না, তবে প্রতিপক্ষের ব্যাটাররা তাদের কাজটা সহজ করে দিয়েছেন।’

বাংলাদেশের ব্যাটিং অর্ডার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ভারতের কিংবদন্তী লেগস্পিনার অনিউল কুম্বলে।

মূলত তিনি চেয়েছিলেন সাকিবকে ব্যাট হাতে আরো আগে নামতে।

‘সাকিবের উচিৎ পাওয়ারপ্লেতে ব্যাট করা। সাকিব যখন স্পিনারদের সামনে নামেন তখন ততটা স্বাচ্ছন্দ্যে থাকেন না, পেস বোলারদের সামনে তিনি আরো ভালো ব্যাট করেন।’

অনিল কুম্বলের মতে, সাকিব যখন ব্যাট করতে নামেন ততক্ষণে ৫০ বলে ১০০ এর বেশি রান লাগে, ম্যাচ অনেকটাই শেষ তখন।

সাকিব আল হাসানও ম্যাচ শেষে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘যখনই ১৮০-১৯০ এর লক্ষ্য থাকে তখন আমাদের চিন্তা ওইভাবে আসে না। আমরা এইসব জায়গায় ফেইল করেছি, আমরা ১৪০-১৫০ রানের খেলাটা ভালো বুঝি।’

এখানে বাংলাদেশের ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি লিগের প্রসঙ্গ টেনে সাকিব বলেন, ‘বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগেও বিদেশীরা যখন ভালো করে, তখন সাধারণত এসব টার্গেট তাড়া করে। স্থানীয় ব্যাটাররা এভাবে তেমন রান তাড়া করছেন সেটা দেখা যায়নি।’

এটা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এক্স-এ মজা করে পোস্ট করেছে আইসল্যান্ড ক্রিকেটও, ‘ম্যাচ ড্র করার জন্য ব্যাট করা একটা শিল্প যদি হতো, তবে বাংলাদেশ সেটা আজ ভালোই করছে।’

এই ক্রিকেট পেইজটি হাস্যরসাত্মক টুইটের জন্য জনপ্রিয়।

ইংল্যান্ডের সাবেক ব্যাটার মাইকেল কারবেরি বিবিসির লাইভ ম্যাচ রিপোর্টে বলেন, বাংলাদেশ যেন আস্তে আস্তে পাঙ্কচার হচ্ছে। ধীরে ধীরে দলটির হাওয়া বের হচ্ছে। ভারতের এই বোলিং লাইন আপের বিপক্ষে কাজটা কঠিন এবং বাংলাদেশ কখনোই গা ঝাড়া দিয়ে উঠতে পারেনি।

তার কাছে মনে হয়েছে, বাংলাদেশ খোলসবন্দি ক্রিকেট খেলেছে।

বিশেষত ভারতের বিপক্ষে লিটন দাশ, তানজিদ হাসান তামিম ও নাজমুল হোসেন শান্ত মিলে ৭৩ বল ব্যাট করেছেন, এই ৭৩ বলে ৮২ রান তুলেছেন এই তিনজন টপ অর্ডার ব্যাটার।

অন্যদিকে ভারতের টপ অর্ডারে রোহিত শর্মা, ভিরাট কোহলি ও রিশাভ পান্ত মিলে ৬৩ বলে ৯৬ রান তুলেছেন।

এই পার্থক্যটা অনেক বড়, সাথে যোগ হয়েছে হার্দিক পান্ডিয়ার ২৭ বলে ৫০।

অভিজ্ঞ ক্রিকেটারদের ব্যর্থতা
বাংলাদেশের এই দলে সাকিব আল হাসানের সাথে আছেন অভিজ্ঞ লিটন দাশ, মুস্তাফিজুর রহমান ও মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ।

সুপার এইটে ভারতের বিপক্ষে এমন গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে এই চার জনের কেউই ভালো করতে পারেননি।

লিটন দাশ পঞ্চম ওভারে হার্দিক পান্ডিয়ার বলে দারুণ এক শটে ছক্কা হাঁকান, ঠিক তার পরের বলেই প্রায় অফ স্ট্যাম্পের বাইরের বল লেগে টেনে মারতে গিয়ে ক্যাচ আউট হয়ে যান লিটন।

ভারতের ইনিংস পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, বেশিরভাগ সময়েই একটি ছয় বা চার মারার পরের বলেই ভারতীয় ব্যাটাররা ১ বা ২ নেয়ার জন্য শট খেলেছে।

ওভারপ্রতি কমপক্ষে ১০ রান ধরে রাখতে সাহায্য করেছে এই চিন্তাধারা।

বাংলাদেশের শুধু লিটন নন, অভিজ্ঞ সাকিব আল হাসানও ছয় মারার পরের বলেই কুলদীপ যাদবকে তুলে মারতে গিয়ে আউট হয়ে যান।

কুলদীপ সময়ের অন্যতম সেরা চায়নাম্যান বোলার, তার বলে আরো ধৈর্য এবং চিন্তা করে ব্যাট করা প্রয়োজন ছিল সেই সময়ে।

ওদিকে বোলিং-এও সাকিব ছিলেন অনেক খরুচে, ১৮ বলে ৩৭ রান দিয়েছেন তিনি।

দলের আরেক অভিজ্ঞ বোলার মুস্তাফিজুর রহমান দিয়েছেন চার ওভারে ৪৮ রান।

বল হাতে একমাত্র মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ ছিলেন স্বল্প খরুচে, তবে তিনি ব্যাট হাতে একেবারেই ব্যর্থ হয়েছেন।

রিয়াদ ১৫ বলে ১৩ রান করেছেন।

হার দিয়ে রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ
এই ম্যাচের আগে বাংলাদেশের হেড কোচ চন্দিকা হাথুরুসিংহে বলেছিলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য ছিল সুপার এইট পর্বে ওঠা, এখান থেকে যা পাবো তা বোনাস।’

ভারতের বিপক্ষে হারের পর সাকিব আল হাসান বলেন, ‘রেজাল্টের কথা যদি বলেন, আমি অবশ্যই বলব যে রেজাল্ট ওয়াইজ আমরা মোটামুটি একটা অবস্থানে আছি। আমরা ছয়টা ম্যাচ খেলেছি, তিনটা জিতেছি, তিনটা হেরেছি। ৫০% যদি ধরেন, সে দিক থেকে খুব একটা খারাপ না।’

অর্থাৎ বাংলাদেশের মধ্যে একটা আত্মতৃপ্তির ব্যাপার ছিল একইসাথে পরবর্তী রাউন্ডে খেলতে যাওয়ার যে তাড়না সেটা অনুপস্থিত এই দুই বক্তব্যে।

তবে সাকিব যোগ করেন, ‘আমি যেটা ফিল করি, আমরা দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে যেভাবে ফাইট করেছি (চার রানের হার), এই দুইটা ম্যাচের একটাতেও যদি সেভাবে ফাইট করতে পারতাম, আমাদের জন্য অনেক ভালো সাসেক্সফুল একটা ওয়ার্ল্ড কাপ হতো বলে আমার মনে হয়।’

ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বাংলাদেশ বেশ বড় ব্যবধানে হেরেছে এবং টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ইতিহাসে বাংলাদেশ ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও পাকিস্তানের বিপক্ষে টানা হারের রেকর্ড গড়েছে।

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে ছয়টি, অস্ট্রেলিয়া ও পাকিস্তানের বিপক্ষে পাঁচটি ম্যাচ হেরেছে বাংলাদেশ- একই প্রতিপক্ষের বিপক্ষে অন্য কোনো দলের টানা এতোগুলো ম্যাচ হারের রেকর্ড নেই।

ওদিকে ভারত সব ধরনের দলের বিপক্ষে টানা ৯টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচে অপরাজিত।

সূত্র : বিবিসি