ভারতে গিয়ে অস্ত্রের মুখে কিডনি খোয়ালেন রবিন

ভারতে গিয়ে অস্ত্রের মুখে কিডনি খোয়ালেন রবিন 

গতকাল রোববার সেই ‘দুর্ভাগা’ রবিন সমকালকে শোনালেন তাঁর জীবন-গল্পের অনুতাপের অধ্যায়। বললেন, ‘ভালো চাকরির আশায় উড়াল দিয়েছিলাম। চাকরি নয়, তারা আমার একটি কিডনি কিনতে চায়। এ জন্য দিনের পর দিন আটকে রাখা হয় হোটেলকক্ষে। কেড়ে নেওয়া হয় পাসপোর্ট। ওদের হাত-পা ধরে কত কান্নাকাটি করেছি। কোনো লাভ হয়নি। বলা হয়, কিডনি না দিলে দেশেও ফেরা হবে না, ঠাঁই হবে জেলে। এক পর্যায়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে হত্যার ভয় দেখিয়ে বাঁ কিডনি বেচতে বাধ্য করা হয়।’

কিডনি খোয়ানো রবিন বলেন, ‘দেশে ফেরার পর স্ত্রী প্রথম জানতে পারে, আমার এক কিডনি নেই। গ্রামে মা জানতে পারলে তিনি সহ্য করতে পারবেন না। যে দোকানে দর্জির চাকরি করতাম তারাও জানে, ভারতে ভালো চাকরি করছি। ফাঁদে পড়ে কিডনি হারিয়ে এখন মৃত্যুর মুখে– এটি কাউকে লজ্জায় বলতে পারছি না। অভাবের কারণে সামনের দিনগুলো কীভাবে চালিয়ে নেব, সেটি ভেবে পাচ্ছি না।’

নেত্রকোনার ছেলে রবিন জানান, ২০২৩ সালের এপ্রিলের কোনো একদিন মিরপুর ১০ নম্বর শাহআলী মার্কেটের পেছনে এক বন্ধুর সঙ্গে তিনি সংসারের অনটন নিয়ে কথাবার্তা বলেছিলেন। তাদের পাশেই বসে ছিল অচেনা এক ব্যক্তি। মাছুম পরিচয়ে আগ বাড়িয়ে ওই ব্যক্তি তাদের সঙ্গে আলাপ করে। এক পর্যায়ে বলে, ভারতে তার ব্যবসা আছে। সেখানে চাকরি দিতে পারবে। পরে তাদের মধ্যে মোবাইল ফোন নম্বর দেওয়া-নেওয়া হয়। অন্তত ২০ দিন রবিনকে ফোন দেয় মাছুম। ভারতে নিতে পাসপোর্ট থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় সবকিছুর দায়িত্ব নেওয়ার কথা জানায় সে। তবে ভারতে চাকরি করতে হলে কিছু ডাক্তারি পরীক্ষা দেশ থেকে করে যেতে হবে জানিয়ে ২০২৩ সালের ২১ সেপ্টেম্বর রবিনকে ধানমন্ডির একটি হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে চক্রের আরেক সদস্য রাজু হাওলাদার আরেকজনের সঙ্গে রবিনের পরিচয় করিয়ে দেন। রবিনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট সংগ্রহ করে ভারতের ভিসা করানোর জন্য তাঁর পাসপোর্ট রেখে দেয় মাছুম ও রাজু।

রবিন আরও জানান, ভিসা কার্যক্রম শেষ হওয়ার পর মাছুম ও রাজু তাদের অন্য দুই সদস্য শাহেদ ও আতাহারের সঙ্গে রবিনকে পরিচয় করিয়ে দেয়। ভারতে তারা ব্যবসায়িক অংশীদার বলে জানানো হয়। ২০২৩ সালের ২২ ডিসেম্বর তাদের দেওয়া বিমান টিকিটে রবিন একাই নয়াদিল্লি যান। ভারতে বিমানবন্দরে রবিনকে নিতে যায় শাহীন ও সাগর ওরফে মোস্তফা। এর পর তাঁকে ভারতের ফরিদাবাদ এলাকার একটি হোটেলে আটকে রাখে কিছুদিন। এর মধ্যে মাছুম ও আতাহার বাংলাদেশ থেকে ভারতে যায়। মাছুমকে পেয়ে রবিন চাকরির কথা জিজ্ঞাসা করে। এরপরই শুরু হয় টালবাহানা। আর্থিক অবস্থার সুযোগ নিয়ে রবিনকে একটি কিডনি বিক্রি করে দিতে প্ররোচিত করে তারা। এক কিডনিতে ছয় লাখ টাকা দেওয়া হবে বলে জানানো হয়। এক পর্যায়ে চাপ প্রয়োগ করে নয়াদিল্লির এশিয়ান হাসপাতালে নিয়ে কিডনি-সংশ্লিষ্ট পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানো হয়। এর কিছুদিন পর ভারতের গুজরাটের মুক্তিনগর এলাকায় দোতলা একটি বাসায় রাখা হয় তাঁকে। গত ৪ মার্চ গুজরাটের কিডনি অ্যান্ড স্পেশালাইজড হাসপাতালে অস্ত্রোপচার করে রবিনের একটি কিডনি নিয়ে নেওয়া হয়। অপারেশন শেষে হাসপাতাল থেকে চার দিন পর ছাড়া পান রবিন।

রবিন জানান, বিমানবন্দর থেকে তাঁকে সরাসরি ফরিদাবাদের যে হোটেলে নেওয়া হয়, সেখানে বাংলাদেশি আরেক ব্যক্তি ছিলেন। তিনিও কান্নাকাটি করছিলেন। ছয়/সাতজন সব সময় তাঁকে পাহারা দিত। এক রাত পর ওই ব্যক্তিকে আরেক জায়গায় নেওয়া হয়। ১০-১১ দিন বিভিন্ন হোটেল ও বাসায় রবিনকে আটকে রাখে চক্রের সদস্যরা। ফোনের ওপাশ থেকে কারও সঙ্গে রবিনের কিডনি ৫০ লাখ টাকা বিক্রির দফারফা চূড়ান্ত করে চক্রের সদস্যরা। এক পর্যায়ে বাংলাদেশে অবস্থান করা কিডনি পাচারকারী চক্রের সদস্যরা রবিনের স্ত্রীর মোবাইল ব্যাংকিং নম্বরে কয়েক দফায় তিন লাখ টাকা দেয়। রবিনের স্ত্রী জানতেন, ভারতে স্বামীর চাকরির অর্থ তিনি পাচ্ছেন। বিভিন্ন সময় ভারত থেকে রবিনকে তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে দেওয়া হলেও কিডনি-সংক্রান্ত কোনো তথ্য যাতে না জানান, তা হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছিল।

রবিন আরও জানান, প্রায় তিন মাস থাকার পর গত ১৯ মার্চ তিনি দেশে ফেরেন। চক্রের ভারতের এক সদস্য বিমানের টিকিট সংগ্রহ করে দিয়েছিল তাঁকে। কিডনির বিনিময়ে ছয় লাখ টাকা দেওয়ার কথা থাকলেও এ পর্যন্ত চক্রটি তিন লাখ টাকা দিয়েছে। বাকি টাকা দিচ্ছে না। শারীরিকভাবে তিনি খুব অসুস্থ। দুই মাসের বাসা ভাড়া বকেয়া পড়েছে। চিকিৎসক তাঁকে বিশ্রামে থাকতে বলেছেন। কিন্তু সংসার চালাবেন কীভাবে– এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় রবিন। বেশ কিছু মেসেঞ্জার ও হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে কিডনি পাচার চক্রের সদস্যরা সক্রিয়। ভারতে থাকার সময় ওই গ্রুপে রবিনকে যুক্ত করা হয়। দেশে ফিরে যখন ওই মেসেঞ্জার গ্রুপের মাধ্যমে চক্রের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তিন লাখ টাকা চাওয়া হয়, তখন রবিনের নাম বাদ দেওয়া হয়। উপায় না দেখে বাসার ফ্রিজ, টিভিসহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র বিক্রি করে এপ্রিলে ফের দিল্লি যান রবিন। পুরোনো ঠিকানায় কিডনি বিক্রি চক্রের সদস্যদের খুঁজতে থাকেন। তবে পুরোনো জায়গা থেকে একজন বাদে সবাই গা-ঢাকা দেয়। এরপর দেশে ফিরে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন তিনি। কীভাবে চক্রের সদস্যদের মুখোশ খোলা যায়, সেই পরিকল্পনা করতে থাকেন।

জড়িতরা যেভাবে ধরা

রবিন তাঁর কয়েক বন্ধুর সঙ্গে শলাপরামর্শ করে নতুন একটি সিম কার্ড তোলেন। এরপর ওই ফোনের মাধ্যমে কিডনি কেনাবেচা চক্রের মেসেঞ্জার ও হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে ছদ্মবেশে যোগাযোগ শুরু করেন। একজন কিডনি বিক্রি করতে চান– এটি ওদের জানানো হয়েছিল। মেসেঞ্জারে তারা ইতিবাচক সাড়া দেয়। মোটা অঙ্কের টাকায় ওই ব্যক্তির কিডনি তারা কেনার আগ্রহ দেখায়। এরপর ধানমন্ডির একটি হাসপাতালের সামনে দেখা করতে চায় প্রতারক চক্রের সদস্যরা। পুরো বিষয়টি আগেই পুলিশকে জানিয়ে রাখেন রবিন। এরপর ভেক ধরে রবিনের সঙ্গে দেখা করতে এলেই ধানমন্ডি থানা পুলিশের কাছে ধরা খায় তারা। এর সূত্র ধরে বাগেরহাটেও অভিযান চালায় পুলিশ। এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয় তিনজনকে। তারা হলো রাজু হাওলাদার (৩২), শাহেদ উদ্দীন (২২) ও আতাহার হোসেন বাপ্পী (২৮)।

গতকাল রোববার ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন্স) ড. খ. মহিদ উদ্দিন বলেন, চক্রটি নিম্ন আয়ের মানুষকে চাকরি দেওয়ার প্রলোভনে ভারতে নিয়ে যায়। পরে পাসপোর্ট ছিনিয়ে নিয়ে ভয়ভীতি দেখানো হয়। এক পর্যায়ে হাসপাতালে নিয়ে কিডনি বিক্রি করে দেয়। চক্রটি এ পর্যন্ত অন্তত ১০ জনকে ভারতে নিয়ে কিডনি বিক্রি করেছে।

পুলিশের আরেক কর্মকর্তা জানান, ২০২০ সাল থেকে বাংলাদেশকেন্দ্রিক কিডনি কেনাবেচার এ চক্রের সদস্যরা ভারতের দিল্লি, গুজরাট, কলকাতা ও রাজস্থানে সক্রিয়। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে তাদের হয়ে কাজ করে এমন দালালও রয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের আছে কিছু গ্রুপ।

বাংলাদেশে কিডনি বেচাকেনা আইনে নিষিদ্ধ। তবে নিকটাত্মীয়র কাছ থেকে কিডনি নেওয়ার বিধান রয়েছে। ২০১৮ সালের আইনে একটি সংশোধনী অনুযায়ী ২৩ জন নিকটাত্মীয়র বাইরে কেউ কিডনি দান করতে পারবে না। তবে এ আইন সংশোধনীর পর হাইকোর্টে একটি রিট হয়। উচ্চ আদালতের এক রায়ে বলা হয়েছিল, ‘নিকটাত্মীয়র বাইরেও মানবিক ও সহানুভূতিশীল যে কেউ চাইলে কিডনি দান করতে পারবেন। তবে এটি এখনও বাস্তবায়ন হয়নি।’

সমকাল