গাজায় নতুন একটা দিন আসে আর নতুন একটা ট্র্যাজেডির জন্ম হয়। যে মুহূর্তে এই লেখা লিখছি, ঠিক তখন দক্ষিণ রাফা এলাকায় ইসরায়েলি বিমান হামলায় ধসে পড়া ভবনের ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে উদ্ধারকর্মীরা চাপা পড়া লাশ উদ্ধারের কাজে ব্যস্ত ছিলেন।
ঠিক সেই সময় তার কয়েক মাইল দূরে খান ইউনিস এলাকায় নাসের হাসপাতালের মাঠে পুঁতে রাখা অসংখ্য লাশ তোলার কাজ চলছিল।
ইতিমধ্যেই গাজায় নিহত ফিলিস্তিনির সংখ্যা ৩৪ হাজার ছাড়িয়ে গেছে এবং সেখানে ১১ লাখ মানুষ ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে।
দামেস্কে ইসরায়েলি কনস্যুলেটে ইসরায়েলের হামলার প্রত্যাঘাত হিসেবে ইরান ইসরায়েলকে নিশানা করে ড্রোন ও রকেট হামলা চালানোর পর অনেকে আঞ্চলিক যুদ্ধ বেঁধে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন। ফলে বাকি বিশ্বও যুদ্ধের কিনারায় চলে গেছে।
ইসরায়েল ইরানের দিকে হামলা করার পর ইরানের ইস্পাহান শহরের আকাশ থেকে ইরানি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কমপক্ষে তিনটি ইসরায়েলি ড্রোন ভূপাতিত করেছে।
এর মধ্যে ইসরায়েল তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ অংশীদার ও রক্ষক হিসেবে পরিচিতি যুক্তরাষ্ট্রের বারণ উপেক্ষা করে রাফায় আশ্রয় নেওয়া লাখ লাখ ফিলিস্তিনির ওপর সেনা অভিযান চালানোর বিষয়ে অনড় অবস্থানে রয়েছে।
বিভিন্ন রাজনৈতিক ভাষ্যকার ও নেতারা ইতিমধ্যেই ইসরায়েলকে তার পশ্চিমা মিত্রদের জন্য ‘বোঝা’ হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেছেন, ইসরায়েলের নেতারা তাঁদের ‘পথ হারিয়েছেন’।
এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠছে, তাহলে কী ইসরায়েলকে ‘দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র’ হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার সময় এখনো আসেনি?
কোনো দেশের গায়ে ‘দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র’-এর তকমা সেঁটে দেওয়ার একটি জঘন্য ইতিহাস রয়েছে। যেসব দেশকে পশ্চিমারা তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে পড়া হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে এসেছে, সেসব দেশকে ঘায়েল করতেই এই শব্দবন্ধকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।
‘দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র’-এর এই তকমা সাঁটার সবচেয়ে ‘সুদিন’ ছিল ক্লিনটনের আমলে। এই সময় যখন যুক্তরাষ্ট্রের মনে হতো কোনো দেশ অপ্রত্যাশিত আচরণ করছে বা তাদের কথা শুনছে না বা আন্তর্জাতিক আইন অনুসরণে গড়িমসি করছে, তখন তারা সেই দেশকে ‘দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র’ বলে উল্লেখ করত।
একটা পর্যায়ে ক্লিনটন প্রশাসন ‘দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র’ কথাটা বলা থেকে আস্তে আস্তে সরে আসতে থাকে এবং রাজনৈতিকভাবে তুলনামূলক যথার্থ শব্দবন্ধ হিসেবে ‘উদ্বেগের রাষ্ট্র’ কথাটা বলা শুরু করে। কিন্তু তারপর বুশ প্রশাসন ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের’ মাধ্যমে বিশ্বকে ‘ভালো ও মন্দ’ এই ভাগে ভাগ করে ফেলে এবং সে সময় তারা ‘শয়তানি চক্র’ বলে নতুন একটি শব্দবন্ধের ব্যবহার শুরু করে।
এখন পরিহাসের বিষয় হলো, যে ইসরায়েল এত দিন মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমা স্বার্থের সৈকতভূমি হিসাবে বিবেচিত হয়ে এসেছে, সেই ইসরায়েলের মধ্যে এখন ‘দুর্বৃত্ত রাষ্ট্রের’ সব বৈশিষ্ট্য দেখা যাচ্ছে।
প্রথমত, গাজায় লাগাতারভাবে গণহত্যা চালিয়ে ইসরায়েল সমস্ত আন্তর্জাতিক আইন কানুন লঙ্ঘন করেছে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, সশস্ত্র সংঘাতে রত থাকা রাষ্ট্র এবং অ-রাষ্ট্রীয় গোষ্ঠীগুলোকে বেসামরিক নাগরিক, চিকিৎসা কর্মী এবং মানবিক সহায়তা কর্মীদের রক্ষা করতে সচেষ্ট থাকতে হবে।
পাশাপাশি যুদ্ধকবলিত সাধারণ মানুষের কাছে মানবিক সহায়তা পৌঁছানোয় কোনো ধরনের বাধা সৃষ্টি করা যাবে না।
ইসরায়েল এসব নিয়ম কানুনের ধার ধারেনি। আমরা সবাই জানি, ৭ অক্টোবরের পর থেকে ইসরায়েলের হামলায় যত ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে তার বেশির ভাগই বেসামরিক লোক। এর মধ্যে শিশুই আছে ১৪ হাজারের বেশি।
গত জানুয়ারিতে অক্সফাম ইন্টারন্যাশনাল যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে বলা হয়েছে, গাজায় দৈনিক মৃত্যুর হার একুশ শতকের অন্যান্য যে কোনো বড় সংঘাতের মৃত্যুহারের চেয়ে বেশি।
যুদ্ধক্ষেত্রে ইসরায়েলের সামরিক কৌশলও অমার্জনীয়। তারা প্রথম থেকেই গাজায় চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোকে নিশানা করে হামলা চালিয়েছে।
পুরোটা সময় জুড়ে তারা স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে নয় শরও বেশি হামলা চালিয়েছে এবং অন্তত সাত শ জন চিকিৎসাকর্মীকে হত্যা করেছে। বর্তমানে গাজার ৩৬টি হাসপাতালের মধ্যে মাত্র ১০টি আংশিকভাবে সচল আছে।
ইসরায়েলি বাহিনী একইভাবে সহায়তা কর্মীদেরও নিশানা করেছে। এপ্রিলের শুরুতে খাদ্য ত্রাণ সংস্থা ওয়ার্ল্ড সেন্ট্রাল কিচেনের সাতজন কর্মী ইসরায়েলের নিশানা করা হামলায় নিহত হওয়ার পর বিশ্বব্যাপী ক্ষোভ ও নিন্দার সৃষ্টি হয়েছিল। সেখানে গত ছয় মাসে দুই শর বেশি মানবিক সহায়তা কর্মীকে ইসরায়েলি বাহিনী হত্যা করেছে।
গাজায় দুর্ভিক্ষ আসন্ন—এমন সতর্কতা আসার পরও সমস্ত আন্তর্জাতিক নিয়ম ও আইনের বিরুদ্ধে গিয়ে ইসরায়েল গাজার অভিমুখে যাওয়া ত্রাণ সহায়তার প্রবাহকেও সীমিত করেছে।
জেনেভা কনভেনশনের অতিরিক্ত প্রোটোকলের ৭৯ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা আছে, যুদ্ধকবলিত অঞ্চলে সাংবাদিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু তা লঙ্ঘন করে ইসরায়েল গাজায় সাংবাদিক ও মিডিয়া কর্মীদের তাদের পরিবারের সদস্যদেরসহ পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে।
তবে এত কিছুর পরও ইসরায়েলকে যুক্তরাষ্ট্র ‘দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র’ বলে আখ্যায়িত করেনি। উল্টো জো বাইডেন প্রশাসন রাফায় ইসরায়েলের সেনাভিযানে সবুজ সংকেত দিয়েছে।
তবে অনেক ক্ষেত্রেই ইসরায়েল একা হয়ে পড়েছে। গত ডিসেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যুদ্ধবিরতির যে প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়েছিল, তাতে ১৫৩টি দেশ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছিল এবং যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলসহ মাত্র ১০টি দেশ বিপক্ষে ভোট দিয়েছিল। গত ২৫ মার্চ নিরাপত্তা পরিষদে দ্রুত অস্ত্রবিরতির যে প্রস্তাব উঠেছিল তাতে ১৫ সদস্যের মধ্যে ১৪ সদস্য দেশই এর পক্ষে ভোট দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ভোটদানে বিরত ছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের এই নিরঙ্কুশ প্রশ্রয় ও মদদের কারণে ইসরায়েল সত্যিকারের দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র হয়ে উঠেছে।
তবে কানাডা, নেদারল্যান্ডস, জাপান, স্পেন ও বেলজিয়ামের মতো দেশ ইসরায়েলের এই আচরণের কারণে তেল আবিবের কাছে অস্ত্র বিক্রি স্থগিত করেছে। এ থেকে বোঝা যায়, ইসরায়েলের দুর্বৃত্তায়নকে প্রভাবশালী দেশগুলো স্বীকার করতে শুরু করেছে।
মনে হচ্ছে, যে কারও পক্ষে আশা করা সম্ভব, খুব শিগগিরই ইসরায়েল তার মিত্রদের কাছে, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অসহনীয় বোঝা হয়ে পড়বে এবং এটিই ফিলিস্তিনের মুক্তির পথ খুলে দেবে।
● সোমদীপ সেন রসকিল্ড ইউনিভার্সিটির ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের সহযোগী অধ্যাপক
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত
prothom alo