আমরা বারুদের স্তূপের ওপর বসে আছি

আগুনে জ্বলেপুড়ে ছারখার হওয়া বেইলি রোডের ভবনটি

আগুনে জ্বলেপুড়ে ছারখার হওয়া বেইলি রোডের ভবনটিছবি: প্রথম আলো

বেইলি রোডের রেস্তোরাঁ—বহুতল ভবনটির সামনে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম। আমি বিশেষজ্ঞ নই, পোড়া-ভারী বাতাস ভরা সেই ভবনে ঢুকে কোনো উপকার করতে পারব না বলে সে চেষ্টা করিনি। আমার বন্ধু-সহপাঠী স্থপতি ও পরিবেশ আন্দোলনের নেতা ইকবাল হাবিব ভবনের ভেতরটা পরিদর্শন করে বেরিয়ে এলেন।

সকালেই ইকবাল হাবিবকে ফোন করেছিলাম। বাংলাদেশের স্থাপত্যে এই যে কাচঘেরা ভবন বানানোর চল শুরু হলো, এটা বিপজ্জনক কি না! ইকবাল বলেছিলেন, প্রধান বিবেচ্য হলো, যে ভবন যে উদ্দেশ্যে তৈরি, তা সেই উদ্দেশ্যেই ব্যবহার করা হচ্ছে কি না।

সেই প্রসঙ্গে পরে আসছি।

খুব মন খারাপ করে আছি। ৪৬ জন মানুষ মারা গেল। কী মর্মান্তিক মানবিক কাহিনি গণমাধ্যমে আসছে। একটা কাগজে দেখলাম তিন কিশোরীর হাস্যোজ্জ্বল ছবি। দুজন মারা গেছে, আরেকজনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

ড. মুমিত আল রশিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি বিভাগের প্রধান, প্রথম আলো বন্ধুসভার সভাপতি ছিলেন, এখন উপদেষ্টা। তাঁর ভাগনে জুনায়েদ আগুনে পুড়ে মারা গেছেন।

মুমিত ভাই সারা রাত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছিলেন। ভাগনে তাঁর খুব ঘনিষ্ঠ, সর্ব বিষয়ে মামার পরামর্শ নিতেন। ব্যারিস্টারি পড়তে যাবেন যুক্তরাজ্যে। তার আগে এই দুর্ঘটনা।

ছয় বন্ধু একসঙ্গে খেতে গিয়েছিলেন। তিনজন মারা গেছেন। মেয়েসহ ভিকারুননিসা স্কুলের এক শিক্ষিকা মারা গেছেন। শিক্ষিকার নাম লুৎফুন নাহার করিম লাকী। তাঁর মেয়ে জান্নাতিন তাজকিন ছাত্রী ছিলেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের। মৃত্যুর আগে মা-মেয়ে ফোনে বলেন, ‘দম বন্ধ হয়ে আসছে।’

প্রথম আলোর অনলাইনে খবরের শিরোনাম, ‘মর্গে বিবর্ণ পুতুলের মতো পড়ে থাকা মৃত শিশুটি কার?’ মর্গের মেঝেতে শুইয়ে রাখা হয়েছে আড়াই থেকে তিন বছর বয়সী মেয়েশিশুটির মরদেহ। মাথার মাঝখানে বাঁধা ঝুঁটিটি তখনো অক্ষত। হাতে, মুখে ও জামাকাপড়ে ছাই লেগে আছে। পায়ে জুতা নেই, দুই পায়ে দুটো মোজা। দেখে মনে হচ্ছে কোনো শিশুর অনেক দিন ধরে খেলতে থাকা বিবর্ণ কোনো পুতুল মেঝেতে শুইয়ে রাখা হয়েছে।

বুয়েটের দুজন শিক্ষার্থীও মারা গেছেন। প্রতিটা প্রাণ অমূল্য। প্রত্যেকের আছে জন্মের গল্প, বেড়ে ওঠার কাহিনি, ভাইয়ের মায়ের ভালোবাসা। একেকটা মৃত্যু একেকটা পৃথিবীকে শূন্য করে দিয়েছে।

আবার আছে ফায়ার ব্রিগেডের সাহসিকতার গল্প। ছাদ থেকে অনেককেই জীবিত উদ্ধার করতে সম্ভব সবকিছু করেছেন এই ফায়ার ব্রিগেডের নিঃস্বার্থ নিবেদিতপ্রাণ কর্মীরা। কীভাবে মরতে মরতে বেঁচে ফিরে এসেছেন এক বাবা তাঁর দুই সন্তানসহ, সে কাহিনিও পড়ছি।

মৃত্যুর আগে লাকী বলেছিলেন, ‘দম বন্ধ হয়ে আসছে।’ আমার নিজের ক্লসট্রোফোবিয়া আছে। এমনিতেই আমি বদ্ধ জায়গা ভয় পাই। আর ছোটবেলায় নিজেদের রান্নাঘর আগুনে পুড়ে ছাই হতে দেখেছি, কী ভীষণ শব্দ হচ্ছিল যখন জ্বলন্ত টিন উড়ে উড়ে এসে পড়ছিল আমাদের থাকার ঘরে, সেই সব মনে পড়ে বলে আগুন খুব ভয় পাই।

আমি কিন্তু সব সময়ই সাতমসজিদ রোডে, বেইলি রোডে, বনানীতে এই সব রেস্তোরাঁয় গেলে ভয়ে ভয়ে থাকি। জাপান গার্ডেন সিটির পাশে এক রেস্তোরাঁর তিনতলায় এক বিয়ের দাওয়াতে গিয়ে আমি ১৫ মিনিট পরেই বেরিয়ে এসেছিলাম, কারণ তেতলায় ওঠার সিঁড়িটা খুব ছোট ছিল।

আমাদের আরেক স্থপতি ভাই মুস্তাফা খালিদ পলাশ সাতমসজিদ এলাকার একটা ভবনের আগাপাছতলা রেস্তোরাঁর জ্বলজ্বলে ছবিসহ একটি ফেসবুক পোস্ট দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন:

‘প্রতিনিয়ত এই ভবনটি নিয়ে সত্যি উৎকণ্ঠায় থাকি। নকশা এবং অনুমোদন বাণিজ্যিক ভবন হিসেবে হলেও এর ব্যবহারে বড় রকমের ব্যত্যয় ঘটিয়ে সার্বিকভাবে একে অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ রেস্তোরাঁ ভবনে রূপান্তর করা হয়েছে। স্থপতি হিসেবে শেষ যে ক্ষমতাটুকু রাজউক দিয়েছে অকুপেন্সি সার্টিফিকেটের জন্য রিপোর্ট স্বাক্ষর করার; তার তোয়াক্কাও এখানে করা হয়নি। অকুপেন্সি সার্টিফিকেট না নিয়েই চলছে দেদার ব্যবসা। যেহেতু ভবনটি নির্দিষ্ট ব্যবহারের ব্যত্যয় করে ব্যবহার শুরু করে দেওয়া হয়েছে, তাই স্থপতি হিসেবে রিপোর্ট ও এজবিল্ট ড্রয়িং প্রদান থেকে বিরত থেকে জমির মালিক, ডেভেলপারকে বারংবার লিখিত বার্তায় এ বিষয়ে সতর্ক করা হলেও কোনো ফলপ্রসূ অগ্রগতি হয়নি।…ডেভেলপারকে জিজ্ঞেস করলে উত্তর আসে, তাদের নাকি ফায়ার লাইসেন্স আছে। কী করে সম্ভব সেটা? কপি চাইলে নিরুত্তর।

‘উদ্ভট সব যুক্তির বেড়াজালে একজন স্থপতি হিসেবে নিজেকে অসহায় না ভেবে গত মাসে অত্র এলাকার ফায়ার সার্ভিস বিভাগের স্টেশনমাস্টারকে এক বার্তায় এ বিষয়ে অবগত করলে তিনি বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখবেন বলে জানান। আমার ঘনিষ্ঠ ফায়ার ডিপার্টমেন্টের সাবেক ডিজিকেও তাঁর ক্ষমতা প্রয়োগের জন্য অনুরোধ করলে তিনি তাঁর সাধ্যমতো তা করবেন বলে জানান। আজ আবার স্টেশনমাস্টার সাহেবকে বিস্তারিত তথ্যসমেত লিখলাম। দেখা যাক কী হয়।

‘যত দূর জানি, এ ভবনের অগ্নিনিরাপত্তার অবস্থা ক্রমান্বয়ে ভয়াবহভাবে অবনমিত করা হয়েছে। ফায়ার ডোর খুলে ফেলা হয়েছে, ফায়ার স্টেয়ার স্টোররুম হয়েছে, যত্রতত্র গ্যাস সিলিন্ডার রাখা হয়েছে ইত্যাদি।…কথাগুলো লিখলাম, কারণ একজন সচেতন স্থপতি তো বটেই; একজন শহরবাসী হিসেবে আমাদের প্রত্যেকেরই দায়িত্ব দৃশ্যমান অশনিসংকেতের মোকাবিলা করা।’

মুস্তাফা খালিদ পলাশ ভাই বলছেন, এটা অফিস ও বাণিজ্যিক ভবন, এখানে তো ২৪টা রেস্তোরাঁ থাকতে পারে না।

এবার আসি আমার বন্ধু ইকবাল হাবিবের কথায়। বেইলি রোডের পোড়া ভবনের সামনে দাঁড়িয়েই আমি তাঁর ভিডিও ইন্টারভিউ নিয়েছি।

ইকবাল হাবিব বলছেন, ছয়টা সংস্থার সনদ লাগে, তাদের দায়িত্ব আছে প্রতিটা ভবনের নিয়মকানুন, নিরাপত্তা, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা, বিল্ডিং কোড, নিরাপত্তা কোড দেখার, নিশ্চিত করার, অনুমতি দেওয়ার, অনুমতি বাতিল করার। কেউ কোনো দায়িত্ব পালন করছেন না। গুরুতর অভিযোগ উঠেছে, ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ এই ভবনের সনদ বাতিল করেছিল, জোর করে, তদবির করে আদায় করা হয়েছে।

এসবই বেইলি রোডে ছাই-ভাসা বাতাসে দাঁড়িয়ে বলা ও শোনা কথা। কিন্তু অভিযোগ গুরুতর। তদন্ত হওয়া উচিত। রানা প্লাজার দুঃখজনক দুর্ঘটনার পর আমাদের পোশাক কারখানার বেশির ভাগকে নিরাপদ ও সবুজ হয়েছে, বিদেশি ক্রেতাদের চাপে। বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডের পর কি বাংলাদেশের বাকি সব ভবন অগ্নিঝুঁকিমুক্ত করা হবে?

বাণিজ্যিক ভবন মানেই কিন্তু রেস্তোরাঁ বা হাসপাতাল বানানো যাবে, এমন নয়। আপনি স্কুলভবন, গোডাউন, হাসপাতাল, রেস্তোরাঁ, পোশাক কারখানা, রাসায়নিক কারখানা একই রকমভাবে নকশা করেন না। কাজেই যে ভবন যে উদ্দেশ্যে তৈরি, সেই ভবন সেই কাজেই ব্যবহৃত হতে হবে।

ফায়ার এসকেপ লাগবে। ফায়ার ড্রিল করতে হবে।

তারপর আসে সেই প্রশ্ন? আমরা কি বাংলাদেশে কাচঘেরা ভবনকে উৎসাহিত করব, নাকি নিরুৎসাহিত। ভবন কাচঘেরা হলে কাচগুলো অগ্নি প্রতিরোধী হতে হয়। ভবনের ভেতরে আগুন থেকে বাঁচার চেম্বার বানাতে হয়। আর আমাদের ইন্টেরিয়র ডেকোরেশনে আমরা খুবই দাহ্য বস্তু ব্যবহার করি।

স্মোক ডিটেক্টর, স্বয়ংক্রিয় পানির ঝরনা, অগ্নিনির্বাপণযন্ত্র ইত্যাদিও আমাদের নিশ্চিত করতে হবে।

আমরা বারুদের স্তূপের ওপর বসে আছি। সার্বিক নৈরাজ্যের প্রতিফলন হচ্ছে এই সব দুর্ঘটনা। এখানে-ওখানে ভবনে বিস্ফোরণ ঘটছে, মানুষ মারা যাচ্ছে। ৪৬টা মূল্যবান প্রাণ ঝরে গেল। তারা বলে গেল, তোমরা কি এই দেশটাতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করবে না? বিধিগুলো কি কেবল কাগজে-কলমে থাকবে? নাকি বিধি মানে বিধি, যা বাস্তবায়িত হয়। ফিটনেস সার্টিফিকেট মানে টাকা দিয়ে কেনা কাগজ নয়, সত্যিকারের ফিটনেস অর্জন।

আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমি আর শ্বাস নিতে পারছি না।

prothom alo