বিশ্বব্যাপী ‘দরিদ্রদের ব্যাংকার’ হিসেবে পরিচিত একজন নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ীকে তার নিজ দেশে কারারুদ্ধ করা হতে পারে কারণ তিনি একাধিক আইনি অভিযোগের মুখোমুখি। এগুলোকে রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অভিহিত করে ৮৩ বছর বয়সী ইউনূস সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। বিশ্বজুড়ে নিজের সমর্থকদের মতো তিনিও বলছেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার তার বিরুদ্ধে বিচারিক হয়রানির প্রচারণা চালাচ্ছে।
ঢাকা থেকে গত বৃহস্পতিবার জুমে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের সাক্ষাৎকার নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত এনবিসি নিউজ। সেখানে ইউনূস বলেছেন, ‘তিনি (শেখ হাসিনা) আমাকে খুবই ঘৃণা করেন। আমি জানি না কেন এমনটা হলো।’
যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট ০৭ই জানুয়ারির নির্বাচনকে দুর্বল করার জন্য অভিযুক্ত বাংলাদেশি ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে’ জানিয়ে এনবিসি নিউজ এর প্রতিবেদনে বলা হয়ঃ ওই নির্বাচনে হাসিনা টানা চতুর্থবারের মতো জয়ী হয়েছেন। স্টেট ডিপার্টমেন্ট বলেছে, ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলায় ‘অস্বাভাবিক দ্রুততার সাথে বিচার করা হয়েছে’ যা কিনা তাকে ‘হয়রানি এবং ভয় দেখানোর’ প্রচেষ্টা হতে পারে।
স্টেট ডিপার্টমেন্ট-এর মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার গত ১৩ ফেব্রুয়ারি সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আমরা উদ্বিগ্ন যে, শ্রম আইন এবং দুর্নীতি বিরোধী আইনের অপব্যবহারের ফলে আইনের শাসন নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে এবং ভবিষ্যতে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। আমরা বাংলাদেশ সরকারকে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলার বিচার ও আপিলে ন্যায্য ও স্বচ্ছ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণের জন্য আহ্বান জানাচ্ছি’।
ইউনূসকে বিচারিক হয়রানি করা হচ্ছে বলে সাংবাদিকদের কাছে মন্তব্য করার পর সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশের একজন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলকে বরখাস্ত করা হয়।
ইউনূস বিশ্বজুড়ে সমর্থন পেয়েছেন। গত আগস্টে ১০৮ জন নোবেল বিজয়ী সহ প্রায় ২০০ জন বিশিষ্ট বিশ্ব ব্যক্তিত্ব, নিরপেক্ষ বিচারকদের প্যানেল দ্বারা ইউনূসের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ পর্যালোচনা করার জন্য হাসিনার কাছে একটি খোলা চিঠিতে স্বাক্ষর করেছিলেন। ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, আমরা নিশ্চিত যে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতিবিরোধী এবং শ্রম আইনের যে কোনো মামলার পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা করলে তিনি খালাস পাবেন’।
১৭ কোটি জনসংখ্যার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্র বিদ্যমান। বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশগুলোর মধ্যে এটি অষ্টম এবং একটি স্বল্পোন্নত দেশ।
নরওয়ের অসলো ইউনিভার্সিটির পোস্টডক্টরাল রিসার্চ ফেলো এবং অস্ট্রেলিয়ার ওয়েস্টার্ন সিডনি ইউনিভার্সিটির এডজাংক্ট ফেলো মুবাশ্বার হাসান বলেন, ‘ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে যা ঘটছে তা আমাদের বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে দেখতে হবে। সেই বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে যে, কিভাবে বিরোধীদের দমন করতে বিচার বিভাগকে অস্ত্র বানানো হচ্ছে’।
জানুয়ারির নির্বাচনে ৭৬ বছর বয়সী হাসিনা এবং তার দল আওয়ামী লীগ জয়ী হয়। বিরোধীরা ওই নির্বাচন বয়কট করে। স্টেট ডিপার্টমেন্ট অবাধ বা সুষ্ঠু নয় বলে এর সমালোচনা করে। বাংলাদেশের নির্বাচনী কর্মকর্তারা বলেছেন, নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল প্রায় ৪০%। যেখানে ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত এর আগের নির্বাচনে ৮০% এর বেশি ভোটার উপস্থিতি ছিল।
মুবাশ্বার হাসান বলেন, হাসিনা ইউনূসের মধ্যে (নিজের) সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীকেও দেখতে পারেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য ২০০৭ সালে ইউনূস একটি রাজনৈতিক দল শুরুর পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেছিলেন, যেই ধারণা তিনি ওই বছরের শেষের দিকেই ত্যাগ করেছিলেন। বৃহস্পতিবার ইউনূস বলেন, তিনি ‘কখনও রাজনীতিতে আসতে চাননি’।
হাসিনা কেন তাকে রাজনৈতিক হুমকি হিসেবে দেখতে পারেন তার একমাত্র কারণ হিসেবে ইউনূস বলেন, ‘তিনি দেখছেন যে, আমি জনগণের মধ্যে খুব জনপ্রিয় কারণ আমি তাদের জন্য কাজ করেছি এবং আমি আমার কাজ নিয়ে দেশের প্রায় প্রতিটি গ্রামে গিয়েছি’।
মুবাশ্বার হাসান বলেন, ‘নিঃসন্দেহে দেশ শাসন করার জন্য তাদের হাতে আরও অন্তত চার বছর সময় আছে। এটা ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসের জন্য, বিরোধীদের জন্য, মানবাধিকার কর্মী ও গণতন্ত্রের পক্ষের কর্মীদের জন্য ভালো খবর নয়’।
যদিও যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্য জায়গার বন্ধুরা ইউনূসকে বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন, কিন্তু তিনি বলেছেন, এটি কোনো বিকল্প নয় ‘কারণ আমি এখানেই বড় হয়েছি’। যাদের সাথে কাজ করেন তাদের জন্য ইউনূস উদ্বিগ্ন বলেও মন্তব্য করেন।
‘আমি যদি চলে যাই, তাদের কী হবে?’ এমন প্রশ্ন করে তিনি বলছিলেন, তারা জেলে থাকবে এবং আমি নিজেকে দোষারোপ করবো এই বলে যে, ‘কেন আমি তাদের জেলে রেখেছিলাম যেখানে আমি অন্য দেশে সুন্দর জীবনযাপন করছি?’
manabzamin