মাহমুদুর রহমান
বাংলাদেশে ভারতের দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে আন্দোলন অনেক দেরিতে এবং ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও সম্প্রতি দানা বাঁধতে শুরু করেছে। বিপুল মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ আঠারো কোটি জনসংখ্যার দেশটি যে ভারতীয় কট্টর হিন্দুত্ববাদের আগ্রাসনের বলি হতে যাচ্ছে সেই ভয়ংকর বিপদ সম্পর্কে ২০১৩ সালের শাহবাগী নাটকের বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই নয়া দিগন্ত এবং আমার দেশ পত্রিকায় বিভিন্ন লেখালেখিতে দেশবাসীকে সতর্ক করার চেষ্টা করেছিলাম। বলাই বাহুল্য, সেই সময় আমার সেই চেষ্টা একেবারেই ব্যর্থ হয়েছিল। জনগণ ইন্ডিয়াপ্রেমে উন্মত্তের মত মজে গিয়ে দেশপ্রেম বিস্মৃত হয়েছিল।
অতি বাঙ্গালী হতে গিয়ে দেশের মুসলমান জনগোষ্ঠীর বড় অংশই হিন্দু সংস্কৃতি দ্বারা মোহাবিষ্ট হয়ে পড়েছিল। আড়ম্বরবিহীন, একেশ্বরবাদী ও সাম্যের ধর্ম, ইসলামের বিপরীতে চাকচিক্যময় পৌত্তলিকতার পূজা-অর্চনা, নাচগানবাদ্য, বাংলাদেশের মুসলমান তরুন শ্রেণিকে খুব সহজেই আকর্ষিত করেছে। গত পনেরো বছরে হিন্দুত্ববাদের এজেন্টরা সরকারের সর্বত্র শিকড় ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। অধিকন্তু, প্রথম আলো, চ্যানেল আই জাতীয় মিডিয়া হিন্দুকরণ প্রক্রিয়ায় বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। অধিকাংশ জনগণ ভুলে গেছে যে, আজকে যারা ইউটিউবে শেখ হাসিনা এবং ভারতবিরোধী বক্তব্য দিয়ে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন তাদের মধ্যে অনেকেই দেশ ও ইসলামবিরোধী “শাহবাগ আন্দোলনের” খুবই উৎসাহী উদ্যোক্তা ছিলেন। বছর দশেক বাদে তাদের সম্বিত ফিরেছে দেখে কিছুটা হলেও সান্তনা পাই। আমি সান্তনা পেলেও এদের এই বিলম্বে উপলব্ধি অবশ্য সমাজের সার্বিক সর্বনাশ ঠেকাতে পারে নাই। তাদের ভুলের মাশুল দিতে গিয়ে ইতিমধ্যে, ভারত এমনভাবে বাংলাদেশকে করায়ত্ত করে ফেলেছে যে, শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক পন্থায় শাসক পরিবর্তনের আর কোন উপায় আমি অন্তত: দেখতে পাই না।
পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, হিন্দুত্ববাদের শিকড় সরকারের সর্বত্র ক্যানসারের মত বিস্তার লাভ করেছে। আগামী প্রজন্মকে সাংস্কৃতিক হিন্দুত্ববাদে দিক্ষিত করবার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে বাংলাদেশের পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাকে ভারতের কট্টর হিন্দু ও ইসলামবিদ্বেষী সংগঠন বিজেপি ও আরএসএস এর আদর্শে সাজানো হয়েছে। বাঙ্গালী মুসলমানের ঐতিহ্য এবং আত্মপরিচয় বিনষ্ট করবার জন্য পাঠ্যপুস্তকে এই অঞ্চলের ছয়শ বছরের গৌরবজ্জল মুসলমান শাসনের ইতিহাস (স্বাধীন সুলতানি আমল, মুগল আমল এবং তৎপরবর্তী ১৭৫৭ সালের পলাশীর বিপর্যয় পর্যন্ত মুসলমান শাসনামল) বিকৃত করা হয়েছে। ভারতে বিজেপি সরকার যেমন করে মুগল আমলসহ সাতশ বছরের মুসলমান শাসনামলের ইতিহাসকে বিকৃত করছে, তাদের অবদানকে অস্বীকার করছে, একইভাবে হিন্দুত্বকরণ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে বাংলাদেশেও ফ্যাসিস্ট হাসিনা মুসলমানের সকল গৌরবগাঁথাকে স্কুল-কলেজের ইতিহাস বইয়ের পাতা থেকে বেমালুম উধাও করে দিয়েছে। মুসলমান নায়কদের জায়গায় হিন্দু চরিত্রদের প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে।
অপরদিকে সেনাবাহিনীসহ রাষ্ট্রের সকল নিরাপত্তা বাহিনী দিল্লি থেকে পরিচালিত হচ্ছে। আমলাতন্ত্রের শীর্ষে হিন্দু এবং ভারতীয় দালাল শ্রেণি খুঁটি গেড়েছে। উচ্চ আদালতে খায়রুল হক, এস কে সিনহার আমল থেকেই বেছে বেছে ইসলামবিদ্বেষীদের বসানো হয়েছে। বর্তমান প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান শাহীন এবং আপীল বিভাগের দ্বিতীয় প্রভাবশালী বিচারপতি এনায়তুর রহীম বাকশাল ছাত্রলীগের যথাক্রমে সাবেক সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক। দুজনাই তথাকথিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল নামক ক্যাঙ্গারু আদালতে জামাতে ইসলাম ও বিএনপির নেতৃবৃন্দসহ অন্যান্য ইসলামী নেতাদের কথিত যুদ্ধাপরাধের অপরাধে বিনা প্রমাণে ফাঁসি দিয়ে ভারতীয় এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে এসেছেন। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও এমনভাবে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার অনুপ্রবেশ ঘটেছে যে, ক্রমান্বয়ে রাষ্ট্রের স্বাধীনতা দিল্লির পদপ্রান্তে বিসর্জন দেয়া হলেও তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তো দূরের কথা, প্রতিবাদ করার মত কন্ঠও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। প্রতিটি দলই আশা করে আছে যে, দিল্লির কাছে আনুগত্য প্রমাণ করতে পারলেই তারা ক্ষমতায় যেতে সক্ষম হবে।
উপরোক্ত লজ্জাকর পরিস্থিতিতে কয়েকজন সোশ্যাল মিডিয়া কর্মী এবং কিছু ক্ষুদ্র রাজনৈতিক দল সাহস করে ভারতীয় উপনিবেশবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ডাক দিয়েছে। ভারত সমর্থিত হাসিনার “ডামি নির্বাচনের” পরিপ্রেক্ষিতে, সংগ্রামের একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে, তারা দেশবাসীর কাছে ভারতীয় পণ্য ও সেবা বর্জনের আহ্বান জানিয়েছে। সেই আহ্বানে কোন কাজ হচ্ছে কিনা এটা মূল্যায়নের সময় এখনও আসে নাই। আশ্চর্যজনকভাবে, “ইন্ডিয়া বয়কট” কথাটি উচ্চারিত হওয়া মাত্রই দিল্লির এসট্যাবলিশমেন্ট দৃশ্যতই বিচলিত হয়ে পড়েছে। ঢাকায় দালাল হাসিনা সরকার “ইন্ডিয়া বয়কট” সংক্রান্ত সকল সংবাদের উপর মিডিয়া সেন্সরশিপ আরোপ করেছে। গত পরশু দিন ১২টি ক্ষুদ্র দল “ইন্ডিয়া বয়কট” আন্দোলনের সমর্থনে একটি ছোট সমাবেশের আয়োজন করলে পুলিশ সেটিও হতে দেয় নাই। সমাবেশস্থল থেকে ব্যানার ছিনিয়ে নিয়ে ফ্যাসিস্ট হাসিনার পুলিশ উদ্যোক্তাদের জানিয়েছে যে, ভারতের বিরুদ্ধে কোন বক্তব্য কথিত স্বাধীন বাংলাদেশে দেওয়া যাবে না। আমি এই পুলিশি আক্রমনকে ভারতের কাছ থেকে লুন্ঠিত স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের একেবারেই প্রাথমিক সংগ্রামের এক ক্ষুদ্র বিজয় হিসেবেই বিবেচনা করি। এরা ভীত না হলে এমন আচরণ করতো না। এভাবেই দেশপ্রেমিক জনতাকে এগিয়ে যেতে হবে।
হতাশার বিষয়টা অন্যখানে। বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল, বিএনপির তরফ থেকে পুলিশের উপরোক্ত কাজের নিন্দা করে একটা বিবৃতি পরদিন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। সেই বিবৃতিতে আমি কোথাও ভারতীয় আগ্রাসনের প্রসঙ্গ খুঁজে পেলাম না। এমনও হতে পারে যে, বিএনপির মূল বিবৃতিতে ভারতের প্রসঙ্গ থাকলেও সেন্সরের কারণে মিডিয়া সেটি এড়িয়ে গেছে। আমার ভুল হয়ে থাকলে পাঠকদের কাছে ভুল ধরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি। বিএনপির বিবৃতিতে বাক স্বাধীনতার বিরুদ্ধে পুলিশী হস্তক্ষেপের নিন্দা করে সম্ভবত: ভারতের অসন্তুষ্টির ভয়ে মূল বিষয়ে নীরবতা পালনের কৌশল নেওয়া হয়েছে। যদি আমার ধারনা সঠিক হয়ে থাকে, তাহলে বিএনপির রাজনীতির ভবিষ্যত সম্পর্কে আমি আশাবাদী হতে পারছি না। রাজনীতিতে কৌশল নিতেই হয়, কিন্তু সেটি অবশ্যই আদর্শ বিসর্জন দিয়ে নয়। এমনিতেই ২০১৫ সালের পর থেকে বিএনপি দিল্লির মন পাওয়ার জন্য সব ধরনের চেষ্টা চালিয়েছে। দলটির নব্য প্রভাবশালী নেতারা দিল্লিতে গিয়ে শহীদ জিয়া এবং বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক আদর্শের সমালোচনা করার ধৃষ্টতাও দেখিয়েছে। তাদের রাজনীতি জানালা দিয়ে ফেলে দেয়া উচিৎ এমন মন্তব্যও করা হয়েছিল। এতখানি নতজানু হওয়ার পরও বিএনপির দিল্লি মিশন একেবারেই ব্যর্থ হয়েছিল। হাসিনার ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে, ২০১৮ এবং ২০২৪ এর নির্বাচনী নাটক ভারতের স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী তাদের গোয়েন্দা দ্বারাই পরিচালিত হয়েছে। সুতরাং, বর্তমান পরিস্থিতিতে স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের সর্বাত্মক লড়াই ব্যতীত জনগণের অধিকার ফিরে পাওয়ার কোন সুযোগ নাই।
আদর্শিক দূর্বলতার জন্য একা বিএনপিকে দায়ী করাও উচিৎ হবে না। জামাতে ইসলামসহ ইসলামী দলগুলোও “ইন্ডিয়া বয়কট” আন্দোলন নিয়ে নীরব রয়েছে। তারা সম্ভবত: এখনও বুঝতে পারছে না যে, হাসিনার ফ্যাসিবাদ এবং ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, একই দানবের দুই মাথা। উভয় মাথা সংহার ব্যতীত বাংলাদেশের আঠারো কোটি জনগণের মুক্তি মিলবে না। আমি বিশ্বাস করি, “ইন্ডিয়া বয়কট” আন্দোলন সেই বৃহত্তর মুক্তি সংগ্রামেরই প্রথম ধাপ। মনে রাখতে হবে, এটি একটি দীর্ঘ মেয়াদী লড়াই। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে এই জাতীয় একটি আন্দোলন (Boycott, Divestment and Sanctions, BDS)২০০১ সাল থেকে আরম্ভ হয়ে আজও চলছে।
বাংলাদেশের সকল দেশপ্রেমিক দলের কাছে “ইন্ডিয়া বয়কট” আন্দোলনে আনুষ্ঠানিকভাবে সমর্থন জানানোর আহ্বান জানাচ্ছি। সামনে রোজা এবং ঈদ আসছে। এখন থেকেই আপনারা ভারতীয় পণ্য বর্জন শুরু করুন। নিজেও কিনবেন না, অন্যকেই না কেনার জন্য উৎসাহিত করুন। দোকানে গিয়ে প্রথমেই বলুন, ভারতীয় পণ্য দেবেন না। আমি বলছি না যে, এই এক আন্দোলনেই আমাদের মুক্তি মিলবে। এটা শত্রুকে আঘাত করবার একটি পন্থা মাত্র। প্রাথমিক লড়াইটাতো অন্তত: আমাদের শুরু করতে হবে। আমি জানি, বাংলাদেশের মানুষ এক ভয়াবহ দানবীয় সরকারের অধীনে ভীতসন্ত্রস্ত জীবন কাটাচ্ছে। তাই বলে আপনারা নিশ্চয়ই এতটা মেরুদন্ডহীন হয়ে পড়েন নাই যে, ভারতীয় পণ্য বয়কট করতেও ভয় পাবেন। যে ক্ষুদ্র দলগুলোর নেতাকর্মীরা সীমিত সামর্থ্য সত্ত্বেও “ইন্ডিয়া বয়কটের” আহ্বান নিয়ে রাজপথে নেমেছেন তাদের প্রতি সালাম ও শুভেচ্ছা জানাই। বিএনপির প্রতি তাদের ভারতনীতি পর্যালোচনার পরামর্শ রইলো।
লেখক: সম্পাদক, আমার দেশ।