দেশের ডজনখানেক ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ছাড়াই চলছে। দীর্ঘদিন ধরে এসব প্রতিষ্ঠান এমডি খুঁজে পাচ্ছে না। তাই এখন বাংলাদেশ ব্যাংক এসব প্রতিষ্ঠানে এমডি নিয়োগের জন্য একটি প্যানেল গঠন করেছে। প্রতিষ্ঠানগুলো এমডি না পেলে এই প্যানেল থেকে তাদের পছন্দমতো এমডি নিয়োগ করতে পারবে। পাশাপাশি এ প্যানেল থেকে স্বতন্ত্র পরিচালকও নিয়োগ করা যাবে। ইতোমধ্যে অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা ও অভিজ্ঞ ব্যাংকারের খোঁজে কয়েকটি বাণিজ্যিক ব্যাংককে চিঠিও দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা যায়।
জানা যায়, এক থেকে দুই বছর ধরে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান এমডি ছাড়াই চলছে। আবার কিছু প্রতিষ্ঠান কয়েক মাস ধরে চলছে এমডি ছাড়া। এসব প্রতিষ্ঠান চলাচ্ছেন অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি), উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) এবং অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তারা ভারপ্রাপ্ত এমডি বা সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
এমডি ছাড়া চলছে ইউনিয়ন ক্যাপিটাল, ফাস ফাইন্যান্স, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফএস), দি ইউনাইটেড আরব আমিরাত-বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড, জিএসপি ফাইন্যান্স কোম্পানি (বাংলাদেশ), আভিভা ফাইন্যান্স, বে লিজিং, ফার্স্ট ফাইন্যান্স, ফিনিক্স ফাইন্যান্স, এসএফআইএল, আইপিডিসি ফাইন্যান্স এবং অগ্রণী এসএমই ফাইন্যান্স।
তবে অভিযোগ রয়েছে বোর্ডের পছন্দমতো কাজ না করলে কিছু প্রতিষ্ঠান এমডিদের বিদায় করে দিচ্ছে। আবার নিজস্ব লোক নিয়োগ দেয়ার জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যোগ্য এমডি পেলেও নিয়োগ দিচ্ছে না।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, একটি প্রতিষ্ঠান কয়েকবার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়েও এমডি পায়নি। মূলত প্রতিষ্ঠানটি বোর্ডের পছন্দের লোক নিয়োগ দেয়ার জন্য যোগ্য প্রার্থী পেলেও তারা নিয়োগ দেয়নি। তাদের নিজস্ব প্রার্থীর স্নাতকোত্তর শেষ না হওয়ার কারণে নিয়োগ দিতে পারেনি। তবে প্রতিষ্ঠান এমডি নিয়োগে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন উদ্যোগে এই প্যানেল থেকে এমডি নিয়োগ করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের এই প্রক্রিয়ায় এমডি নিয়োগ হলে প্রতিষ্ঠানগুলোয় আরও স্বচ্ছতা ফিরে আসবে।
সূত্র জানায়, বিভিন্ন ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও অভিজ্ঞ ব্যাংকার দ্বারা প্যানেল তৈরি করার কাজ শুরু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্যানেল তৈরির জন্য সরকারি-বেসরকারি ৭-৮টি ব্যাংককে অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের তালিকা পাঠাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে চিঠিও দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছেÑসোনালী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, উত্তরা ব্যাংক ও পূবালী ব্যাংক। ব্যাংকগুলোকে অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) থেকে তার ঊর্ধ্বতন ব্যাংক কর্মকর্তাদের তালিকা পাঠাতে বলা হয়, যাদের বয়সসীমা হবে সর্বোচ্চ ৬৫ বছর। পাশাপাশি কর্মজীবনে স্বচ্ছ ও ভাবমূর্তি এবং যোগ্য লোকের তালিকা পাঠাতে বলা হয়েছে। ইতোমধ্যে একটি ব্যাংক ২০ থেকে ২৫ জনের তালিকা পাঠিয়েছে। সব মিলিয়ে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে এখন পর্যন্ত ৩০ থেকে ৪০ জনের তালিকা এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক শেয়ার বিজকে বলেন, বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান এমডি নিয়োগে ব্যর্থ হচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন ধরে এমডি ছাড়াই চলছে। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগে প্যানেল করা হচ্ছে। কোনো প্রতিষ্ঠান এমডি না পেলে এই প্যানেল থেকে নিতে পারবে। ইতোমধ্যে অভিজ্ঞ ব্যাংকারদের কাছ থেকে কিছু সিভি পেয়েছি, যারা এসব প্রতিষ্ঠানে এমডি হিসেবে নেতৃত্ব দিতে আগ্রহী প্রকাশ করেছেন।
উল্লেখ্য, আলোচিত প্রশান্ত কুমার (পিকে) হালদারের অনিয়মের কারণে ডুবছে ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান। পিকে হালদার বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে যে অনিয়ম করেছেন, পুরো খাত এখন তার জের টানছে। তার মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় ছিল, এমন কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে খেলাপি ঋণের হার সবচেয়ে বেশি। পাশাপাশি এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানেও খেলাপি ঋণ বাড়ছে, যে কারণে সার্বিকভাবে এ খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েই চলেছে।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বিভিন্ন অনিয়মের ঘটনার কারণে এ খাতের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে; যা এখনও ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। মানুষ আর্থিক প্রতিষ্ঠানে টাকা রাখতে আস্থা পাচ্ছে না, যার কারণে প্রতিষ্ঠানগুলো তারল্য সংকটে ভুগছে। অন্যদিকে ঋণ আদায় না হওয়ার কারণে খেলাপি ঋণও বাড়ছে। নানা কারণে এ খাতে ভালো কোনো এমডি আসতে চাচ্ছেন না। আবার যারা আসছেন তারা বোর্ডের নানা চাপে থাকতেও পারছেন না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩ মাসে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ঋণ ১ হাজার ৭০৭ কোটি টাকা বেড়েছে। গত সেপ্টেম্বর শেষে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ২১ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা, যা এই খাতে বিতরণ করা মোট ঋণের ২৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ।
জুন শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৯ হাজার ৯৫১ কোটি টাকা, যা ছিল ওই সময়ে বিতরণ করা ঋণের ২৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ। গত মার্চ শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপির পরিমাণ ছিল ১৭ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা, যা ছিল ওই সময়ের বিতরণ করা ঋণের ২৫ শতাংশ।
গত বছরের সেপ্টেম্বরভিত্তিক তথ্য অনুযায়ী, পিকে হালদার-সংশ্লিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে পিপলস লিজিংয়ের খেলাপি ঋণের হার ৯৯ শতাংশ বা ১ হাজার ৯৬ কোটি টাকা, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি লিমিটেডের (বিআইএফসি) খেলাপির হার ৯৬ দশমিক ৮৫ শতাংশ বা ৭৪৩ কোটি টাকা, ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের খেলাপি ঋণ ৯৪ দশমিক ৭৬ শতাংশ বা ৩ হাজার ৯১২ কোটি টাকা। এছাড়া পিকে হালদার সংশ্লিষ্ট এফএএস ফাইন্যান্সের খেলাপি ঋণ ৮৯ দশমিক ৫৬ শতাংশ বা ১ হাজার ৬৪৫ কোটি টাকা ও আভিভা ফাইন্যান্সের খেলাপি ঋণ ৭১ দশমিক ৭২ শতাংশ বা ১ হাজার ৯০২ কোটি টাকা।
Share Biz