চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ সরকার ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে বিশেষ মনোযোগ দিচ্ছে। বিশেষ করে ব্যবসা, বিনিয়োগসহ নানা পরিসরে ইউরোপের দেশগুলো বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক নিবিড় করতে আগ্রহী। ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার অংশ হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জার্মানি দিয়ে চলতি মেয়াদে তাঁর প্রথম বিদেশ সফর শুরু করছেন।
গতকাল বুধবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ১৬ থেকে ১৮ ফেব্রুয়ারি জার্মানির মিউনিখে অনুষ্ঠেয় নিরাপত্তা সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী বৃহস্পতিবার রওনা হবেন। চার দিনের মিউনিখ সফরের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিরাপত্তা সম্মেলনে একটি বিশেষ অধিবেশনে বক্তৃতা দেওয়ার ফাঁকে জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ, নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুট ও ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী মেটে ফ্রেডারিকসনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন। এ ছাড়া ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করসহ বেশ কয়েকটি দেশের প্রতিনিধিদলের নেতা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন।
ঢাকায় ও ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে কর্মরত বাংলাদেশের কূটনীতিকেরা এই প্রতিবেদককে বলেছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে অবাধ, সুষ্ঠু এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের বিষয়ে ধারাবাহিকভাবে আহ্বান জানাচ্ছিল ইইউ। কিন্তু ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর ইইউর উচ্চপদস্থ প্রতিনিধি জোসেপ বোরেল ৯ জানুয়ারি একটি বিবৃতি দেন। তিনি ওই বিবৃতিতে নির্বাচনে প্রধান সব কটি রাজনৈতিক দল অংশ না নেওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেন। এর পাশাপাশি নির্বাচনে অনিয়মের যেসব খবর এসেছে, সেগুলোর সময়োচিত ও পূর্ণাঙ্গ তদন্ত নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান।
অবাধ, সুষ্ঠু আর অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের আয়োজনের যে তাগিদ ইইউ দিয়েছিল, সেখান থেকে ইউরোপের জোটটির সরে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে বাংলাদেশের একাধিক রাষ্ট্রদূত মন্তব্য করেছেন, সহিংসতার আশঙ্কা করা হলেও কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে শেষ পর্যন্ত নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হয়েছে। এর পাশাপাশি ইউরোপের দেশগুলো, বিশেষ করে জার্মানি, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস মানবাধিকারের পাশাপাশি ব্যবসা, বিনিয়োগ ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতায় বিশেষভাবে আগ্রহী। যদিও নরডিক অঞ্চলের দেশ হিসেবে পরিচিত সুইডেন, ডেনমার্ক, নরওয়ে মানবাধিকার, সুশাসনসহ মূল্যবোধের ওপর বিশেষ জোর দেয়। এ বিষয়গুলো তাদের পররাষ্ট্রনীতিতে বিশেষভাবে গুরুত্ব পায়। এমন এক পরিস্থিতিতে ইইউর বড় শক্তিগুলো বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান, আর্থসামাজিক অগ্রগতি এবং ২০১৪ সালের নির্বাচন–পরবর্তী অভিজ্ঞতার আলোকে সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক ধারাবাহিকভাবে এগিয়ে নেওয়ার বিষয়টিতে জোর দিয়েছে। তাই সামগ্রিকভাবে ইইউ মানবাধিকার ও সুশাসনের মতো মূল্যবোধের কথা ভবিষ্যতে সামনে আনলেও ব্যবসা, বিনিয়োগসহ নিজেদের স্বার্থের বিষয়গুলোতে জোর দেবে।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা কাল
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনের এবারের প্রতিপাদ্য চারটি বিষয়ে। এগুলো হচ্ছে বৈশ্বিক নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ, আন্তর্জাতিক কাঠামো, আঞ্চলিক সংঘাত এবং বিশ্বে ইউরোপের গুরুত্ব। বৈশ্বিক নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জের আওতায় জলবায়ুর নিরাপত্তা, কারিগরি নিরাপত্তা ও মিয়ানমারের সংঘাত নিয়ে আলোচনা হবে। আন্তর্জাতিক কাঠামোর আলোকে শান্তিরক্ষা কার্যক্রম ও ভূরাজনীতি, আঞ্চলিক সংঘাত এবং বিশ্বে ইউরোপের গুরুত্বের প্রেক্ষাপটে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি ও ভূরাজনীতি নিয়ে আলোচনা হবে।
জ্যেষ্ঠ একজন কূটনীতিক জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৬ ফেব্রুয়ারি মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে বক্তৃতা দেবেন। তাঁর বক্তৃতায় জলবায়ুর নিরাপত্তা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় অর্থায়নের ওপর বিশেষ গুরুত্ব পাবে।
মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনের আলোচনার বিষয় নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের কারণে আমাদের দেশে নিরাপত্তাঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া মিয়ানমারে যে চলমান সমস্যা, সেটির কারণে আঞ্চলিক নিরাপত্তায় ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন আলোচনা হবে এবং সেখানে রোহিঙ্গা বিষয়টি আসতে পারে।’
মিউনিখে তিন গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক
নিরাপত্তা সম্মেলনের ফাঁকে প্রধানমন্ত্রী ১৭ ফেব্রুয়ারি জার্মান চ্যান্সেলর, নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রী ও ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করবেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ২০১৭ সালের পর জার্মানির কোনো চ্যান্সেলরের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর এটাই প্রথম কোনো বৈঠক।
জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈঠকে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলার বিষয়টি উন্নয়ন সহযোগিতার মধ্যে যুক্ত করা, নিরাপত্তা সহযোগিতা বাড়ানোর মধ্য দিয়ে সম্পর্ককে কৌশলগত পর্যায়ে উন্নীত করতে প্রতিরক্ষা ও কৌশলগত অংশীদারত্বের উপাদান যুক্ত করা, ব্যবসা ও বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রসঙ্গগুলো আসবে। দুই দেশ ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরের প্রেক্ষাপটে নিজেদের অবস্থাপনপত্র ঘোষণা করেছে। এর আলোকে কীভাবে সহযোগিতা বাড়ানো যায়, তা নিয়েও আলোচনা হবে।
নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুটের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে পানিসম্পদ খাতে সহযোগিতার পাশাপাশি ডেলটা প্ল্যান, কৃষি খাতের উন্নয়নে সহযোগিতা, সরবরাহব্যবস্থার বিকাশের পাশাপাশি প্রতিরক্ষা সহযোগিতার বিষয়গুলো আসবে।
ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী মেটে ফ্রেডারিকসনের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈঠকে বন্দর অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ, চট্টগ্রামের লালদিয়ায় একটি গ্রিন টার্মিনাল করার প্রস্তাব, কক্সবাজারের মহেশখালীতে বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার কথা রয়েছে।
prothom alo