আজ সরস্বতী পূজা। সবাইকে শুভেচ্ছা ও ভালবাসা। 

 

 

আজ সরস্বতী পূজা। সবাইকে শুভেচ্ছা ও ভালবাসা।
ফরহাদ মজহার    14 February 2024
এই সময় আমাদের নয়াকৃষি কেন্দ্রগুলোতে পলাশ  ফুল ফুটে আছে। পলাশ গাছ (Butea monosperma)  আমরা দেখেছি কি? রবীন্দ্রনাথের আধিপত্যে আমরা কিঞ্চিত নাকি সুরে ফুলের নাম হিশাবে ‘কিংশুক’ শুনেছি। তবে ‘কিংশুক’ মানে যে পলাশ ফুল, এটা খুব কম বাঙালি জানে। শিম গাছের মতো পলাশের পাতা তেকোনো। ঠিক।
নয়াকৃষিতে পলাশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ বৃক্ষ ও ফুল। বাস্তব অর্থে শুধু না, প্রতীকী বা রূপকল্প চর্চার দিক থেকেও।  সৃষ্টির যে লীলা তার কিঞ্চিত রূপ আমরা দেখি পলাশ ফুলে, পরাগায়নের উৎসবে, বসন্তের আনন্দে। অনেকে নয়াকৃষি কেন্দ্রে পলাশ ফুল দেখে প্রশ্ন করেন, পলাশ কেন? নয়াকৃষিতে আমরা পলাশ গাছ ও ফুল প্রচার করি। পলাশ গাছ কাটলেও তার শাখা প্রশাখা আরও গজায়। সেটা জ্বালানির কাজে লাগে। কৃষির প্রধান একটা কাজ  নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন। ভাইয়েরা বোনেরা, আমরা আমরা কৃষক।
কিন্তু বাংলাদেশে আমরা বাংলার ফুল লতা পাতা গাছ পালা পশু পাখি জীব জন্তু  চিনিনা। কেন? চিনি হয়তো, কিন্তু আমাদের জীবন যাপনের সঙ্গে তাদের কোন সম্পর্ক নাই। থাকলেও সেটা শুধু ধর্ম পরিচয়ে, যেমন সরস্বতীয় পূজায় পলাশ চাই। কিন্তু এই থাকা আমাদের আবাস, ঐতিহ্য ও ইতিহাসের সঙ্গে বিযুক্ত বা বিচ্ছিন্ন ভাবে থাকা। কেন? কেন আমাদের ভাষা, শিল্প, সাহিত্য, শিল্পকলা উদ্বাস্তু, নিজের আবাস থেকে উন্মূল? কারন কলোনিয়ালিজমের মধ্যে যে ‘ইথনিক ক্লিন্সিং’ বা আবাসসুদ্ধ স্থানীয়দের উৎখাত প্রকল্প রয়েছে সেটা ফিলিস্তিনীরা যেভাবে বুঝেছে আমরা বুঝি নি। তবে ব্রিটিশ শক্তি জায়নিস্টদের চেয়ে অনেক চতুর। কলোনিয়াল শিক্ষা ও সংস্কৃতি এখানে অস্ত্র হিশাবে ব্যবহৃত হয়েছে, এখনও চলছে।
আজকাল শুধু বাঙালিত্বগিরি ফলানো দেখি, কিন্তু নিজের ঘর ও সম্পদ আগলে রাখার কর্তব্যবোধ কোত্থাও নাই। ভয়ানক অবস্থা!!  বাংলা যে আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি ছাড়াও আবাসের নাম — এই বোধ আমরা হারিয়ে ফেলেছি।  ফলে গ্রহনক্ষত্রসহ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গে আমাদের যে গভীর সম্বন্ধ ও আদানপ্রদান রয়েছে সেই সবের সাথে আমরা নিজেরাই সম্পর্ক ছিন্ন করেছি। আমরা ‘মডার্ন’ হয়েছি, যেন বৃহৎ কর্পোরেশানগুলো আমাদের সম্পদ নিশ্চিন্তে লুটতরাজ করে নিয়ে যেতে পারে। আমরা তাদের বরকন্দাজ হতে পারি। এই হোল ‘মডার্ন’ হওয়া।
গ্রহ নক্ষত্রের কথা কেন? কারন সরস্বতীর স্মরণ, শরণ ও পুজার সময় মাঘ মাসের শুক্লা পঞ্চমি তিথিতে। গ্রহ নক্ষত্রের বিশেষ অবস্থান ও তিথি মেনে। সরস্বতী চিনলে গ্রহ নক্ষত্রকেও চিনতে হবে। বসন্তপঞ্চমী কথাটা এখান থেকেই আসে।
কথাটা ‘হিন্দু’ নয়, ‘সনাতন – ইতিহাস, ঐহিহ্য, সংস্কৃতি, আচার, জ্ঞান, প্রজ্ঞা, দর্শন, ইত্যাদি্র বহমান ধারা বা ঐতিহ্য। এই দিনটিতে শিশুদের হাতেখড়ি অনুষ্ঠান মানে শুধু মাত্র মৃত অক্ষরের সঙ্গে পরিচিত করাবার জন্য না, সেও মডার্ন সংস্কৃতি। বই তো ঐ কয়েক দিন আগের ব্যাপার। ছাপাখানার আগে গ্রহনক্ষত্র ছিল। তাই কোরানুল করিম দাবি করে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডই আল্লার আয়াত, চিহ্ন বা অক্ষর। তাঁর সৃষ্টিকে পাঠ করতে শেখ।
আমরা যেহেতু ধর্ম ভুলেছি তাই আল্লার সৃষ্টিকে চিহ্নব্যবস্থা বা  কেতাব হিশাবে পাঠ করবার অর্থ এখন আর ধরতে পারি না। বুঝি না। যে দায় আমরা নিয়েছিলাম সেটাও ভুলেছি। আমরা তাই প্রিন্টিং প্রেসের ছাপা বই পড়ি। খোদ সৃষ্টিকে পাঠ এবং স্রষ্টাকে তারিফ করবার যে প্রভূত আনন্দ, সেই আনন্দ থেকে নিজেদের আমরা বঞ্চিত করি। ‘শুক্লাপঞ্চমী’ বা ‘বসন্তপঞ্চমী’ কথাগুলো বোঝার আগেই  তাদের বিধর্মীদের সংস্কৃতি বলে দূরে সরিয়ে দিতে আমাদের বাঁধে না। আমাদের ধারণা পলাশ ফুল আল্লাহ শুধু বিধর্মীদের জন্যি সৃষ্টি করেছেন। তাও আবার বুঝ শুধু সরস্বতীর জন্য! এমনকি আরবরাও কখনও এই কাজ করে নি। জ্যোতিষ্ক বিদ্যা বা জ্যোতির্মণ্ডল পাঠে তাদের অর্জন দেখুন।
আফসোস আজকাল ‘বাঙালি’ আবিষ্কার ডাবল কি ট্রিবল কঠিন কাজ।  সীমান্তের দুই পাশে ভারতীয় আছেন, বাঙালি নাই। বাংলাদেশে যারা নিজেদের ‘বাঙালি’ দাবি করেন তাদের প্রধান কাজ ইসলামের চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করা। হিন্দুত্ববাদী দিল্লির বরকন্দাজের ভূমিকাই তাঁরা বাংলাদেশে পালন করেন। আর যারা দ্বীনের কথা বলেন তারা মুসলমান হওয়া বলতে বোঝান হিন্দুর বিপরীতে আমরা কতোটা আরব সেটা প্রমাণ করা। ফলে বাংলা বা বাঙালির  যে সনাতনী বিপুল ইতিহাস ও তাৎপর্য, সেটা কারুরই আরাধ্য না।
আমরা আছি যাকে বলে মানকা চিপায়। পৌত্তলিকতা বিরোধিতার নামে যা কার্যকর করা হচ্ছে তাকে বলা যায় আবাস, ইতিহাস ও সংস্কৃতির নিরাকরণ। ফলে বাংলা বিভক্ত। এর ষোল আনা দোষ শ্যামাপ্রসাদের ঘাড়ে চাপানো যায়, কিন্তু তাতে ইতিহাসের মোড় ঘোরে না। আমাদেরও দায় নিতে হবে।
একদিকে হিন্দুত্ববাদ আর তার বিপরীতে পেট্রোডলারের শক্তিতে বলিয়ান মধ্য প্রাচ্যের সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ। অথচ আমরা মধ্য প্রাচ্য নই। আমরা পশ্চিম ও দক্ষিণ এশিয়ার সন্ধিস্থল। পূর্বদেশ। এটাই সনাতন, জৈন, বৌদ্ধ, ইসলাম ও আধুনিক খ্রিস্টিয় চিন্তা চেতনার সঙ্গমস্থল। যারপনাই উর্বর। কল্পনা, চিন্তা, সংস্কৃতি, দর্শন – সকল দিক থেকেই। কিন্তু এই উর্বরতার হদিস নেওয়া কখনই জরুরি মনে করি নি আমরা।
অন্যদিকে রাসুলে করিমের (সা) মক্কা বিজয়ের ঐতিহাসিক তাৎপর্যও আমরা বুঝি নি। কখনই বুঝতে চাই নি। ধরে নিয়েছি মার্কিন বা ফরাসী বিপ্লবই বিপ্লবের একমাত্র রূপ, ইরানের বিপ্লবকেও বিপ্লব মানতে আমাদের সেকুলার আপত্তি আছে। গাঁইগুঁই করি। আমরা মহা মুশকিলে আছি।
একদিকে নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহকে মোকাবিলা কতে ব্যর্থ হওয়ায়  – সরস্বতীর অভিশাপে আমরা উইপোকা হয়ে গিয়েছি। বাঙালি হিন্দু মনে করে এই গালি বাঙালি মুসলমানকে দেওয়া হয়েছে, তারাও যে বাঙালি এবং ঘৃণ্য — এটাতারা এখনও টের পায় নি। অন্যদিকে বাংলাদেশে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো চেপে বসেছে গোত্রবাদি কোরেশদের সংস্কৃতি, যাকে কিছু লোক ইসলামি সংস্কৃতি বলে জবরদস্তি আমাদের ওপর চাপিয়ে দিতে চায়। আল্লাও আমাদের ওপর না-রাজি হয়ে আছেন।
আমাদের এই হাল হবার তো কথা না। বসন্ত আসছে। আমরা বদ্ধ দ্বার খুলব না?  নাকি দরজা খুলতেও আমরা ভুলে গিয়েছি।
The article was republished from Farhad Mazhar’s Facebook entry.