বড় ধরনের সংঘাত ও সহিংসতা ছাড়াই সম্পন্ন হয়েছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ফের ক্ষমতায় এসেছে আওয়ামী লীগ। ‘সরকার পতনের’ এক দফার আন্দোলনও এখন অনেকটা ‘উত্তাপহীন’। রাজপথে হরতাল-অবরোধ নেই। নেই আগের মতো ধরপাকড়। গ্রেপ্তার আতঙ্কও অনেকটা কেটে গেছে। উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে আদালতপাড়ায় বাড়ছে কারাবন্দি নেতাকর্মীর স্বজন আর সতীর্থের ভিড়। তাদের কেউ এসেছেন ছেলে বা ভাইকে, কেউ এসেছেন স্বামীকে দেখতে। আবার প্রিয় নেতার সঙ্গে দেখা করতেও এসেছেন কর্মীরা। নিজের মামলার সর্বশেষ খোঁজ নিতেও এসেছেন অনেকে। গ্রেপ্তার স্বজনকে আইনি প্রক্রিয়ায় দ্রুত মুক্ত করতে পরিবারের সদস্যরা ভিড় করছেন আইনজীবীদের চেম্বারে।
সরেজমিনে গতকাল রোববার সকাল থেকেই ঢাকার নিম্ন আদালত প্রাঙ্গণে এমন চিত্র দেখা গেছে। সেখানে কারাবন্দি বিএনপি নেতার ছোট শিশুটিও অপেক্ষায় আছে কখন বাবাকে দেখতে পাবে। কখন একটু ছুঁয়ে বাবাকে স্পর্শ করতে পারবে। কেরানীগঞ্জ ও কাশিমপুর কারাগার থেকে যখনই কোনো প্রিজনভ্যান আদালতপাড়ায় আসে, তখনই ছোটাছুটি চলে অপেক্ষমাণ স্বজন আর নেতাকর্মীর মধ্যে। ভ্যানের গ্রিল ভেদ করে স্বজনের চেহারাটা দেখার জন্য শুরু হয় দীর্ঘ আকুতি, প্রাণপণ চেষ্টা।
আদালত চত্বর কিংবা আইনজীবীর চেম্বারে স্বজনের অপেক্ষা, কান্না এখন স্বাভাবিক ঘটনা। তাদের মধ্যে কোনো কোনো পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি গ্রেপ্তার হওয়ায় জীবন চালানোই দায় হয়ে পড়েছে। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা স্বজনরা জানান, ঢাকায় রাজনীতি করার কারণে তাদের প্রিয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আন্দোলন আর নির্বাচনের কারণে এতদিন কোনো জামিন হয়নি। এখন আশায় বুক বেঁধে অপেক্ষা করছেন, তাদের পরিবারের সদস্যরা এবার হয়তো জামিন পাবেন। এ জন্য অনেকে দলীয় আইনজীবীর কাছে ছুটছেন, অনেকে এর বাইরে ভিন্ন আইনজীবীকেও নিযুক্ত করেছেন।
বিএনপির দাবি, গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশ পণ্ড হয়ে যাওয়ার পর থেকে সারাদেশে তাদের ২৭ সহস্রাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই গণগ্রেপ্তারে প্রভাব পড়ছে ওইসব নেতাকর্মীর পরিবারে। ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে ব্যবসায়িক, পারিবারিক, সামাজিক এমনকি তাদের কর্মজীবনও হুমকির মুখে। অনেক শিক্ষার্থীর ছেদ পড়েছে লেখাপড়ায়।
নিম্ন আদালতে কথা হয় ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্য সচিব আমিনুল হকের বড় ভাই মঈনুল হকের সঙ্গে। আমিনুল হক জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক। সেরা গোলরক্ষক হিসেবে তাঁর সারাদেশে নামডাক। অসাধারণ নৈপুণ্যে ২০০৩ সালে প্রথমবারের মতো সাফ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশ।
মঈনুল হক জানান, শুধু রাজনীতিতে নাম লিখিয়ে এখন আমিনুল হক কারাগারে। গত ২ নভেম্বর গ্রেপ্তার হওয়ার পর দুই দফায় ১১ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয় তাঁকে। গত ৬ ডিসেম্বর রিমান্ডে থাকা অবস্থায়ই কিডনিতে পাথর ধরা পড়ে। ব্যথায় ঠিকমতো দাঁড়াতেও পারেন না। আর কত মামলায় রিমান্ডে যেতে হবে, কবে জামিনে মুক্তি পাবেন– কেউ জানেন না।
তিনি আরও বলেন, আমিনুল হকের নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছেলে আবরার হক আয়ান বাবার সঙ্গেই দুষ্টুমি আর খেলাধুলায় মেতে থাকত। আর ছোট মেয়ে আলাইনা হক ইসহানা বাবাকে ছাড়া এক রাতও ঘুমাত না। বাবার অবর্তমানে মনমরা সন্তানদের লেখাপড়ায় প্রভাব পড়ছে। আলাইনা হক ঘুমের মধ্যেও বাবার জন্য চিৎকার দিয়ে কেঁদে ওঠে। এর সঙ্গে নিজেদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও বাড়ছে ঝামেলা। এক অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে পুরো পরিবার।
আইনজীবী আবদুস সালাম হিমেল বলেন, তারা জামিনের জন্য জোর চেষ্টা করছেন। নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক মামলায় জামিন বন্ধ থাকলেও এখন সেটা স্বাভাবিক হবে বলে তিনি মনে করছেন। সে ক্ষেত্রে বিএনপির নেতাকর্মীরা আইনের প্রতিকার পাবেন।
অপেক্ষমাণ স্বজন শামসুন নাহার হাসি ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সদস্য সচিব রফিকুল আলম মজনুর স্ত্রী। তিনি জানান, মজনুর পিত্তথলিতে পাথর, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। সম্প্রতি তাঁর পিত্তথলির অপারেশন করা হয়েছে। সেখানে ইনফেকশন হওয়ায় আবারও অপারেশন করতে হয়েছে তাঁকে। এখনও অপারেশনের স্থান দিয়ে পুঁজ বের হয়। তবে আদালতে হাজিরা আর মামলার সাজা থেকে তাঁর রেহাই নেই। প্রায় প্রতিদিন প্রিজনভ্যানে করে অসুস্থ শরীরে তাঁকে আদালতে আসতে হয়। বিনা ওয়ারেন্টে গত বছরের ২২ মে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। এখন কবে মুক্তি পাবেন– সে আশায় আছে পুরো পরিবার।
এদিন যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম নিরব, যুবদলের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক মোনায়েম মুন্না, সাবেক সহসভাপতি এস এম জাহাঙ্গীর, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সম্পাদক কাজী ইফতেখারুজ্জামান শিমুলসহ আরও অনেক কেন্দ্রীয় নেতাকে আনা হয় নিম্ন আদালতে। এর মধ্যে নিরব, মুন্না, জাহাঙ্গীর এক বছর ধরে কারাগারে আছেন। তারা প্রত্যেকেই শারীরিকভাবে অসুস্থ বলে তাদের স্বজনরা জানিয়েছেন।
আইনজীবীরা জানান, ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ পণ্ডের পর সারাদেশে সাঁড়াশি অভিযানও শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এর প্রভাবে আদালতপাড়ায় নেতাকর্মীর আনাগোনা অনেকটা কমে যায়। এর মধ্যেও যারা বিভিন্ন মামলায় হাজিরা দিতে কিংবা গ্রেপ্তার নেতাকর্মীর খোঁজ নিতে আসার চেষ্টা করেন, তাদের অনেককে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ফলে আদালতে নেতাকর্মীর উপস্থিতি শূন্যের কোঠায় চলে আসে। ওই সময় আটক নেতাকর্মীর স্বজনরাই মামলা পরিচালনা করতে আদালতে আসতেন। তবে পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হওয়ায় নেতাকর্মীর ভিড় বাড়ছে। বিগত মামলায় জামিন নেওয়া ছাড়াও কারাবন্দি নেতাদের খোঁজ নিতে প্রতিদিনই তারা হাজির হচ্ছেন আদালতে।
ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির নেতা শামীম পারভেজের স্ত্রী জান্নাত আরা ফেরদাউস জানান, গত ১৪ নভেম্বর শামীম পারভেজকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত ২১ ডিসেম্বর তাঁকে একটি মামলায় তিন বছরের সাজা দিয়েছেন আদালত। এখন শারীরিকভাবে অসুস্থ তাঁর স্বামীকে জামিনে মুক্ত করতে নিরন্তর চেষ্টা করছেন তিনি ও তাঁর পরিবার। কবে মুক্তি পাবেন– তা তারা কেউ বলতে পারছেন না।
গত ২ নভেম্বর রাজধানীর গুলশান থেকে গ্রেপ্তার হন ঢাকা মহানগর উত্তর যুবদলের সদস্য সচিব সাজ্জাদুল মিরাজ। মিরাজের স্ত্রী তাহমিদা আক্তার তন্বি জানান, তাঁর সংসারে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। বড় ছেলে মিনহাজুল ইসলাম রোজান এবার এসএসসি পরীক্ষার্থী। প্রতিদিন আদালতপাড়ায় ছুটতে হয় বলে ছোট দুই ভাইবোনকে দেখাশোনা করতে হয় রোজানকে। আন্দোলনের ডামাডোলে গত দুই মাসে বাসা বদল করতে হয়েছে। এসব মিলে ছেলের লেখাপড়ায় মারাত্মক বিঘ্ন ঘটছে।
আদালতের বারান্দায় বসে আছেন ৭৩ বছর বয়স্ক আম্বিয়া খাতুন। তিনি এসেছেন বরগুনা থেকে। তাঁর ছেলে আমান উল্লাহ আমানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে গত ৪ নভেম্বর। তিন দিন নিখোঁজের পর তাঁকে আদালতে হাজির করা হয়। পরপর ১৩ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয় তাঁকে। এর আগে ৩০ অক্টোবর আমানকে না পেয়ে তাঁর বড় ভাই শহীদুল্লাহ মুসুল্লিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাঁকেও সাত দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। এখনও তাঁর দুই সন্তান রয়েছেন কারাগারে।
আম্বিয়া খাতুনের পাশে থাকা পুত্রবধূ আয়েশা বেগম জানান, তাঁর স্বামী রাজনীতি করেন না। তবে আমানকে না পেয়ে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। সে যখন রিমান্ডে তখন আমানকেও গ্রেপ্তার করে নিখোঁজ রাখা হয়। এ সংবাদ পেয়ে তাঁর মা ছুটে আসেন ঢাকায়। এখন জামিনের জন্য এখান থেকে ওখানে, এক বারান্দা থেকে আরেক বারান্দায় ছুটছেন।
‘ছেলে আমার বড় হবে, মাকে বলত সে কথা; হবে মানুষের মতো মানুষ এক, লেখা ইতিহাসের পাতায়’– জেমসের এই গানের মতোই চাঁদপুরের প্রত্যন্ত গ্রামের দেলোয়ার মুন্সি স্বপ্ন বুনেছিলেন, একদিন ছেলে বড় হবে। নিজেকে নিয়োজিত করবে দেশসেবায়। স্বপ্নবাজ এই মানুষটি নিজের সবটুকু উজাড় করে একমাত্র ছেলে খোরশেদ আলম সোহেলকে পাঠিয়েছিলেন ঢাকায়। ভর্তি করিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। মেধাবী সোহেল লেখাপড়ার পাশাপাশি শুরু করেন ছাত্রদলের রাজনীতি। অনেক চড়াই-উতরাই পার করে হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সভাপতি।
গত ২৭ ডিসেম্বর রাতে দেলোয়ার মুন্সি সংবাদ পান সোহেলকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তখনই ছুটে আসেন ঢাকায়। চোখের কোণে পানি জমানোর অব্যর্থ চেষ্টা করে বলেন, রাজনীতি করা তো অন্যায় নয়। তাহলে কেন অন্যায়ভাবে গ্রেপ্তার করে, মিথ্যা মামলা দিয়ে দিনের পর দিন রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হবে। এই রাজনীতির শেষ কোথায়?
শুধু আমান ও সোহেল নয়; গত ২৮ অক্টোবর থেকে সারাদেশে প্রায় ১ হাজার ৪৩১ ছাত্রদল নেতাকর্মী-সমর্থককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে সংগঠনের তরফ থেকে জানানো হয়েছে। এর মধ্যে ৫০৭ জন শুধু ঢাকা নগরের। তাদের প্রায় প্রত্যেকেই শিক্ষাজীবনে রয়েছেন। কেউ জগন্নাথ, কেউ জাহাঙ্গীরনগর, কেউ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা তিতুমীর, ঢাকা কলেজসহ বেসরকারি কলেজের ছাত্র। তাদের শিক্ষাজীবন এখন অনিশ্চয়তায় পড়েছে। কবে মুক্ত বাতাসে আসতে পারবেন, তা কেউ বলতে পারছেন না। ভবিষ্যৎ কর্মজীবনেও এর প্রভাব পড়বে বলে শঙ্কিত প্রত্যেকের পরিবার।
সমকাল