এম সাখাওয়াত হোসেন : আজ ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হচ্ছে। উন্নয়ন ও গণতন্ত্র যে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত, সে কথা সর্বজনবিদিত।
নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন ১৯৯৯ সালে তাঁর লেখা ডেভেলপমেন্ট অ্যাজ ফ্রিডম বইয়ে লিখেছেন, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচন; বৈষম্য ও গোত্রে গোত্রে সংঘাত এড়ানো এবং দেশকে উন্নতির শিখরে পৌঁছানোর জন্য কার্যকর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা অত্যাবশ্যক। তিনি লিখেছেন, গণতন্ত্রে ঘাটতি রেখে দেশের টেকসই উন্নয়ন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সবচেয়ে জরুরি উপাদান হলো বিশ্বাসযোগ্য, গ্রহণযোগ্য ও সর্বজনগৃহীত নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন। অথচ বাংলাদেশে এ পর্যন্ত আমরা যতগুলো নির্বাচন দেখেছি, তার মধ্যে হাতে গোনা দু–একটি ছাড়া বাকিগুলো ছিল প্রশ্নবিদ্ধ ও অগ্রহণযোগ্য।
প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত সরকারগুলোকে আর যা-ই হোক, সেগুলোকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াসম্মত সরকার বলা যাবে না। ব্যাপক জনসমর্থন থাকা কয়েকটি দল ১৯৯০ সালে দেশে গণতন্ত্র, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ও জবাবদিহিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠার আশায় গণ-অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিল। কিন্তু ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনে সে আশা ভঙ্গ হয়েছে।
২০১৪ এবং তারপর ২০১৮ সালের দুটি নির্বাচন যে অবাধ, সুষ্ঠু ও গণতান্ত্রিক ছিল না, তা নতুন করে বলার বিষয় নয়।
এ দুটি নির্বাচন বাংলাদেশের মতো ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক দেশের জন্য মোটেও সুখকর ছিল না। ২০১৪ সালের নির্বাচন ‘বিনা ভোটের নির্বাচন’ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচন ‘রাতের ভোট’ বলে চিহ্নিত হয়ে আছে।
২০১৮ সালের নির্বাচনপ্রক্রিয়া যে গণতান্ত্রিক বিশ্বে এক নতুন ধারার কথিত নির্বাচন হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছে, তা আজ সর্বজনবিদিত। সেটি কী ধরনের নির্বাচন ছিল, তা এখন সরকারি দলের নেতারা এবং নির্বাচন কমিশনের প্রধানসহ সদস্যরাও অকপটে বলছেন। এমনকি একজন (প্রয়াত) নির্বাচন কমিশনার সে কথা লিপিবদ্ধ করে গেছেন।
২০১৪ সালের নির্বাচনের আগেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল হয়েছে। কিন্তু বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সেই নির্বাচন বর্জন করে।
২০১৮ সালের নির্বাচনটি সব দলের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হওয়ায় সেই নির্বাচনকেই প্রকৃত অর্থে দলীয় সরকারে অধীনে নির্বাচন হিসেবে বিবেচনা করা যায়। দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হওয়ার প্রয়োজন ছিল বাংলাদেশের গণতন্ত্র বিকাশের জন্য। কিন্তু তেমনটি হয়নি।
কাজেই পরপর দুটি নির্বাচন বহুলাংশে জনবিচ্ছিন্ন হওয়ায় প্রকৃত গণতন্ত্রের বলয় দারুণভাবে সংকুচিত হয়ে পড়েছে।
এই দুই নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষি বিবেচনায় নিয়ে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো নির্বাচনের নিরপেক্ষ ক্ষেত্র তৈরির দাবি করেছিল। ক্রমেই সে দাবি বেশ জোরালো হচ্ছিল। এর জের ধরে দেশে সর্বজনীন গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের পক্ষ থেকে চাপ ছিল।
কিন্তু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার ২০-২৫ দিন আগেই বিরোধী দল ও সমমনাদের মধ্যে গ্রেপ্তার–আতঙ্ক তৈরি হয়। সরকার গোলযোগ ও সন্ত্রাস সৃষ্টি করার অভিযোগে গণহারে বিরোধী নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তার অনেকের বিচার ও সাজা হয়েছে। এ কারণে আজকের নির্বাচনও অন্য ধাঁচে আগের নির্বাচনের মতোই হবে বলে ধরে নেওয়া যায়।
সরকার নিজের উদ্ভাবিত সংজ্ঞায় একটি কথিত সর্বজনীন বা ‘অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন’ অনুষ্ঠিত করতে যাচ্ছে। সরকারি দলের সংজ্ঞামতে, বৃহৎসংখ্যক ভোটার ভোটকেন্দ্রে এলে ও ভোট দিলে সংখ্যার ভিত্তিতে অংশগ্রহণ নির্ধারিত হবে। বিশ্বে প্রচলিত ও গবেষণালব্ধ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের যত সংজ্ঞা আছে, তার সঙ্গে অবশ্য এটি মেলে না।
যাহোক, এবারের নির্বাচনকে প্রচলিত নির্বাচনের সংজ্ঞার বাইরে গিয়ে ‘অংশগ্রহণমূলক’ করতে সরকারি দলের মনোনীত প্রার্থীদের বাইরে দলের অন্যান্য ইচ্ছুক প্রার্থীকেও নির্বাচনে দাঁড়ানোর সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
‘ডামি প্রার্থী’ হিসেবে বিবেচিত এসব প্রার্থীকে ছাড় দেওয়া হয়েছে। সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে কথিত ২৬টি দল, যেগুলোর তিন-চারটি ছাড়া কোনোটিরই নাম ও তৎপরতা আগে কেউ কখনো দেখেনি।
তা ছাড়া আমরা সরকারি দলের কথিত জোটভুক্ত কয়েকটি দলের শীর্ষ নেতাদের নিজেদের প্রতীক ব্যবহার না করে সরকারি দলের প্রতীকে নির্বাচন করতে দেখছি।
বাংলাদেশের একসময় তৃতীয় বৃহৎ দল বলে পরিচিত জাতীয় পার্টির সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধতে সরকার ২৬টি আসনে ছাড় দিয়েছে। কিন্তু সেসব আসনে ‘উন্মুক্ত’ ও ‘ডামি’ প্রার্থী আছেন।
সরকারি দলের ‘ডামি’ ও কথিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা শক্ত প্রতিপক্ষ হওয়ায় জাতীয় পার্টি এবং জোটের নৌকা প্রতীক নিয়ে মাঠে থাকা প্রার্থীদের ভবিষ্যৎ শঙ্কায় পড়েছে।
এ পর্যন্ত জাতীয় পার্টি যাঁদের দাঁড় করিয়েছিল বা সমর্থন দিয়েছিল, তাঁদের মধ্য থেকে এখন পর্যন্ত ৭৬ জন প্রার্থী সরে দাঁড়িয়েছেন। তাঁদের মতে, নেতাদের ‘হঠকারী সিদ্ধান্তের কারণে’ তাঁরা এ ঘোষণা দিয়েছেন। নির্বাচন পর্যন্ত এই দলের আসন ছাড় দেওয়া ২৬ জনের বাইরে কতজন থাকবেন, তা দেখার বিষয়।
পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, বিএনপির দলছুট ও কথিত নতুন কিংস পার্টির কয়েকজনের জয় নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুই করা হবে। এসব বিষয় সরকারি দলের ঘোষিত সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য ভোটের নতুন সংজ্ঞার মধ্যে পড়বে কি না, সন্দেহ। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা হবে লক্ষণীয়। কিন্তু তারা কিছু করতে পারবে বলে মনে হয় না।
এবার এমন অভিনব নির্বাচনের কয়েকটি লক্ষণীয় দিক তুলে ধরছি, যা ভবিষ্যতে গবেষণার উপাত্ত হিসেবে কাজে লাগতে পারে। প্রথমত, বাংলাদেশে ভোট দেওয়া বাধ্যতামূলক নয়। এ কারণেই তৃণমূল পর্যায়ে সরকারি দলের মনোনীত প্রার্থীরা ভোটের হার বাড়াতে নানা কৌশল গ্রহণ করেছেন, যার মধ্যে ভয়ভীতি ছাড়াও রাষ্ট্রপ্রদত্ত সুবিধাদি হরণের হুমকি দেওয়া হচ্ছে।
বিভিন্ন পত্রপত্রিকার তথ্য অনুযায়ী এমনকি সরকারি দল প্রায় দুই লাখ কর্মীকে ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আসার জন্য প্রশিক্ষণও দিয়েছে। কাজেই অনেক ভোটার স্বেচ্ছায় নয়, ভয়ভীতির কারণে ভোটকেন্দ্রে আসবেন। তবে তাঁরা কীভাবে এবং কোন প্রার্থীকে ভোট দেবেন, তা দেখার অপেক্ষায় থাকতে হবে।
এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিশেষ করে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকেও এই কাজ দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। তা ছাড়া এবারই প্রথম নির্বাচনের দিন শুধু ব্যক্তিগত গাড়িই নয়, অন্যান্য যানবাহনও চলবে। সে ক্ষেত্রে শুধু মোটরসাইকেলের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে নির্বাচন কমিশন কতখানি সাফল্য অর্জন করবে, তা বলা কঠিন।
এবার সংক্ষেপে এই অভিনব নির্বাচনের বিষয়ে কয়েকটি ভাবনাপ্রসূত বিষয় উত্থাপন করছি। নির্বাচনটি কোন দল দেশ পরিচালনা করবে, তা ঠিক করার জন্য হচ্ছে না, কারণ এই নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে দেশে-বিদেশে কারও কোনো সন্দেহ নেই।
দেখার বিষয় হচ্ছে, সংসদে বিরোধী দল কারা হতে যাচ্ছে? স্বতন্ত্র বা স্বতন্ত্র জোট নতুন কোনো নামসর্বস্ব পার্টির ছত্রচ্ছায়ায় যেমন বিরোধী দল হতে পারে, তেমনি সংকুচিত জাতীয় পার্টিই একধরনের বিরোধী দল হতে পারে। সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন থাকবে যদি ৬০ থেকে ৭০ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী হন, তাঁরা কি সরকারি দল না বিরোধী দল ভারী করবেন।
এবারের নির্বাচন দেশে রাজনীতি ও বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য বিপৎসংকেত হিসেবে ধরে নিতে হচ্ছে। বহু ছোট দল, বিশেষ করে আলোচিত শরিক দলগুলো বিলুপ্তির ঝুঁকিতে পড়বে। অনেক পর্যবেক্ষকের ধারণা, দুর্বল অথবা বিলুপ্ত হতে পারে তৃতীয় বৃহত্তর দল হিসেবে বিবেচিত জাতীয় পার্টি, যার লক্ষণ দৃশ্যমান।
সরকারি দলের অনেক মনোনীত প্রার্থী, যাঁরা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় ছিলেন, তাঁদের অনেকের রাজনৈতিক জীবনের ইতি ঘটতে পারে তাঁদেরই সতীর্থদের হাতে। এ কারণেই বহু জায়গায় সংঘাত ও মরিয়া ভাব দেখা যাচ্ছে। অনেক পর্যবেক্ষকের মতে, এর ফলে সরকারি দলে বিভাজন ও বিভক্তি দেখা দিতে পারে। এমন হলে বাংলাদেশের রাজনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
অন্যদিকে দলের অধিকাংশ নেতা কারাগারে এবং অনেক নেতার শাস্তি হলেও বিরোধী দল এখনো ভেঙে যায়নি, হয়তো তারা টিকে থাকবে। তা না হলে এই নির্বাচনের পর সরকারি দল তার লক্ষ্য অনুযায়ী ক্ষমতায় থাকতে পারলেও বাংলাদেশের নির্বাচন ও রাজনীতি ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এরই মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় সব প্রতিষ্ঠান।
শুধু আশা এবং প্রার্থনা করি, এমন কিছু যেন না হয়, যা দেশের ও দেশের জনগণের জন্য কোনো দুর্বিষহ পরিস্থিতি তৈরি করে।
● ড. এম সাখাওয়াত হোসেন নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (এনএসইউ)