সমঝোতার আসনের বাইরে লাঙ্গল নামকাওয়াস্তে

সমঝোতার আসনের বাইরে লাঙ্গল নামকাওয়াস্তে

আওয়ামী লীগকে হারিয়ে ‘ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর’ থাকার কথা বললেও জাতীয় পার্টি (জাপা) অধিকাংশ আসনে প্রচার ও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেই। ক্ষমতাসীনদের কাছ থেকে ছাড় পাওয়া ২৬ আসনের বাইরে মাত্র ৮-১০টিতে নৌকার বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছে লাঙ্গল। আরও কয়েকটিতে প্রচার চালাচ্ছে। বাকি দুই শতাধিক আসনে জাপার দৌড় প্রার্থী রাখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ।

আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাসহ শীর্ষ নেতারা জেলায় জেলায় প্রচার চালালেও জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের নীবর। অথচ ৭ জানুয়ারির বিএনপিবিহীন নির্বাচনে কাগজে-কলমে ক্ষমতাসীনদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয় পার্টি। রংপুর-৩ আসনে প্রার্থী হওয়া জি এম কাদের নিজ আসনের বাইরে রংপুর-১, রংপুর-৫, রংপুর-৬ এবং গাইবান্ধা-৪ আসনে পথসভা করেছেন। জাপার শীর্ষ নেতারা নিজের আসনের বাইরে দলীয় প্রার্থীদের পক্ষে ভোটের প্রচারে নামেননি।

জাপা নেতারা খোলাখুলি বলছেন, ভোটের মাঠে অবস্থান ক্রমাগত দুর্বল হওয়ায় ছাড় না পাওয়া আসনের আট-দশটি বাদে সবগুলোতে লাঙ্গলের জামানত বাজেয়াপ্ত হতে পারে। এ কারণে দলের কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদসহ অন্তত ১১ প্রার্থী আসন ছাড় না পেয়ে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছেন। প্রার্থিতা বহাল থাকলেও তিনজন ভোট থেকে সরে গেছেন। দলটির নির্বাচন পরিচালনা কমিটির একাধিক সদস্য সমকালকে বলেছেন, ২৬ আসনের বাইরে লাঙ্গলের অধিকাংশ প্রার্থী ‘ডামি’। নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ দেখাতে তাদের মাঠে রাখা হয়েছে।

অন্তত ১০ প্রার্থী সমকালকে জানান, ভোটে নামিয়ে প্রতিশ্রুত সহায়তা করছে না জাপা। দলটির সূত্রের দাবি, নির্বাচনে অংশ নেওয়ার তহবিল শীর্ষ নেতারা পেয়েছেন। জাপা প্রেসিডিয়াম সদস্য ও  নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব জহিরুল ইসলাম জহির সমকালকে বলেছেন, ‘অনেক প্রার্থীই সহযোগিতা চেয়েছেন। এখনও কাউকে আর্থিক ও নির্বাচনী প্রচারসামগ্রী দিয়ে সহযোগিতা করা যায়নি। সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা রয়েছে।’

আওয়ামী লীগ সরকার ও নির্বাচন ব্যবস্থার কড়া সমালোচক ছিলেন জি এম কাদের। অংশগ্রহণমূলক না হলে নির্বাচন বর্জনের হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। গত ১৪ নভেম্বরও জাপার কেন্দ্রীয় কমিটি এবং জেলার সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকদের যৌথসভায় ৫৯ নেতার দুইজন বাদে সবাই একই মতামত দেন। কিন্তু পরদিন তপশিল ঘোষণার পরই অন্তরালে চলে যান জাপা চেয়ারম্যান। এক সপ্তাহ পর নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দেয় তাঁর দল। নির্বাচন পরিচালনার কমিটির এক সদস্য সমকালকে বলেছেন, ‘৯৮ শতাংশ নেতাকর্মীই নির্বাচনের বিরুদ্ধে, প্রচারে কেন নামবে?’

সূত্রের খবর, নির্বাচনে অংশ নিতে জাপার শর্ত ছিল, সম্মানজনক সংখ্যক আসন ছেড়ে দিয়ে আগামী সংসদেও বিরোধী দল বানাতে হবে। রওশন এরশাদ নন, জি এম কাদের হবেন বিরোধীদলীয় নেতা। শর্ত পূরণের আশ্বাসে গত ৬ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের সঙ্গে প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠকে ৫০ আসন চান জাতীয় পার্টির নেতারা। ১১ দিনের দেনদরবারে গত ১৭ ডিসেম্বর প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিনে আওয়ামী লীগ ২৬ আসন ছাড়ে। এসব আসন থেকে নৌকার প্রার্থী প্রত্যাহার করা হলেও আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা রয়ে গেছেন। নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ দেখানোর কৌশলের কারণে আওয়ামী লীগ স্বতন্ত্রদের সরায়নি।

লাঙ্গলের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির এক সদস্য সমকালকে বলেন, ‘আসন বাটোয়ারার দিনেই ২৬ আসনের বাইরে ভোট শেষ। যারা আসন ছাড় পাননি, তারা মনে করছেন জয়ের সুযোগ নেই। তাই ভোটের প্রচারে টাকা খরচ করতে চান না। ২৬ জন ছাড় পাবেন, আর বাকিদের নৌকার বিরুদ্ধে লড়তে হবে– এভাবে নির্বাচন হয় না। এসব প্রার্থী সরে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সুবিধার জন্য সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোটে রাখা হয়েছে। কিন্তু সহায়তার প্রতিশ্রুতি পূরণ করা হচ্ছে না।’
ছাড় পাওয়া ২৬ আসনের ১৪টিতে জাপার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগে মনোনয়নবঞ্চিত শক্তিশালী স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছেন। দুটিতে জাপার মনোনয়নবঞ্চিত এমপিরাই স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন লাঙ্গলের বিরুদ্ধে। তাই ছাড় পেয়েও এসব আসনে লাঙ্গলের জয় নিশ্চিত নয়। এসব আসনের কয়েকটিতে প্রচারে পিছিয়ে জাপা। যেমন– ময়মনসিংহ-৮ আসনের দু’বারের এমপি ফখরুল ইমাম ঢাকা থেকে আসা-যাওয়া করে প্রচার চালাচ্ছেন।

আগের দুই নির্বাচনে ঢাকা-৪ এবং ঢাকা-৬ আসন জাপাকে ছেড়েছিল আওয়ামী লীগ। এবার রাজধানীতে আসন ছাড়তে রাজি ছিল না ক্ষমতাসীনরা। এতে জি এম কাদের বেঁকে বসেন। খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সন্দেহ ছিল, জাপা নির্বাচন থেকে সরে যেতে পারে। জি এম কাদেরের স্ত্রী শেরিফা কাদেরের জন্য আওয়ামী লীগ ঢাকা-১৮ আসন ছাড়লে জাপা শেষ বেলায় নির্বাচনে থাকার ঘোষণা দেয়। কিন্তু

ভোটের প্রচারে আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত স্বতন্ত্র প্রার্থীর তুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে শেরিফা। জি এম কাদের স্ত্রীর প্রচারেও যাননি।
জাপার সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ নিজ এলাকা চট্টগ্রাম এবং মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু কিশোরগঞ্জের বাইরে যাননি।

শীর্ষ নেতাদের ভোটের প্রচারে না থাকা প্রসঙ্গে লাঙ্গলের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘আওয়ামী লীগের মতো (আমাদের) শক্তি, সামর্থ্য ও টাকা নেই।’ তাহলে কেন ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর থাকার কথা বলছেন জাপা মহাসচিব– এ প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘রাজনীতিতে বলতে হয়। হেরে যাওয়ার কথা বললে কেউ ভোট দেবে?’

ছাড় পাওয়া ২৬ আসনসহ ২৭৯ আসনে লাঙ্গলের প্রার্থী আছে। ছাড়ের বাইরে ঢাকা-৪-এর এমপি সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা রয়েছেন ভোটের প্রচার ও প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। ঢাকা-৭ আসনে জাপা মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় না থাকলেও দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য সাইফুদ্দিন আহমেদ মিলন জোর প্রচার চালাচ্ছেন। রাজধানীতে আরও আট আসনে জাপার প্রার্থী থাকলেও তারা প্রচার ও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেই। ঢাকা-১০, ঢাকা-১২ আসনে লাঙ্গলের কিছু পোস্টার লিফলেট দেখা গেছে।

সাইফুদ্দিন আহমেদ মিলন বলেছেন, জয়-পরাজয় যা-ই হোক, প্রচার চালিয়ে যাবেন। বৃহত্তর ময়মনসিংহ এলাকার এক প্রার্থী সমকালকে বলেন, চাইলে জি এম কাদেরকে প্রচারে আনতে পারতেন। কিন্তু তাঁর গত কয়েক মাসের অবস্থানের কারণে ভোটাররা নাখোশ।

ঢাকা-৪ সহ জাপার দখলে থাকা সাতটি আসন ছাড়েনি আওয়ামী লীগ। এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনে লিয়াকত হোসেন খোকা, সুনামগঞ্জ-৪ আসনে পীর ফজলুল রহমান ও বরিশাল-৬ আসনে নাসরিন হাওলাদার রত্না নৌকার বিপক্ষে  প্রচার ও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন।

জি এম কাদেরের সঙ্গে নেতৃত্বের লড়াইয়ে সরকারের সমর্থন না পেয়ে এবারের নির্বাচন থেকে ছিটকে পড়েছেন রওশন এরশাদ। তাঁর ময়মনসিং-৪ আসনে জাপার প্রার্থী আবু মুসা সরকার ভোটের প্রচারে রয়েছেন। জি এম কাদেরের লালমনিরহাট-৩ আসনে লাঙ্গলের জাহিদ হাসান প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও প্রচারে রয়েছেন।

ঢাকা-১ আসনে সালমা ইসলামও লড়াইয়ে রয়েছেন। স্থানীয় সূত্রের খবর অনুযায়ী ছাড় পাওয়া আসনের বাইরে রংপুর-২, ৪ ও ৫ আসন, সিলেট-২ ও ৩ আসনে জাপার প্রার্থীরা জোরেশোরে প্রচার চালাচ্ছেন। এসব আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে পারে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ এবং সিরাজগঞ্জ-৩ আসনের লাঙ্গলের প্রার্থী ঘোষণা দিয়ে নির্বাচন থেকে সরে গেছেন। আগামীতে এ সংখ্যা বাড়তে পারে।

সমকাল