‘থুসিডাইডস ফাঁদে’ পা দিয়ে আটকে পড়তে যাচ্ছে দেশের রাজনীতি?

‘থুসিডাইডস ফাঁদে’ পা দিয়ে আটকে পড়তে যাচ্ছে দেশের রাজনীতি?
ফরিদ খান :

মা তাঁর ছোট্ট শিশুকে বুকের পাঁজরে লুকিয়ে রেখেও বাঁচাতে পারেননি। অঙ্গার হয়েছেন দুজনই। বাবা আগুন থেকে তাঁর শেষ সম্বল বাঁচাতে গিয়ে আর ফিরে আসেননি।

অন্ধকার নামলেই এই জনপদে বাড়ে মৃত্যুভয়। বাসে আগুন, ট্রেনে আগুন। হিংসার হিংস্র আগুনে পুড়ছে জীবন, দগ্ধ হচ্ছে। চলন্ত যানবাহনে আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারার মতো বর্বরোচিত ও নিন্দনীয় ঘটনা পৃথিবীতে বিরল। মানুষ হিসেবে আমাদের মর্যাদা ও মনুষ্যত্ব এবং জাতি হিসেবে আমাদের গৌরব ম্লান হয়ে যায়।

অন্যদিকে বাংলাদেশ মনে হয় এখন বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মামলা আর আসামির দেশ। কারাগার এখন ঈদ মৌসুমের লঞ্চ কিংবা ট্রেন। আসামিদের উপচে পড়া ভিড়, গাদাগাদি, ঠাসাঠাসি—ধারণক্ষমতার বহুগুণ। এমনকি কনডেমড সেলেও সাধারণ আসামি। অসুস্থ হয়ে পড়ছে অনেকে। মারাও যাচ্ছে কেউ কেউ। আদালতপাড়ায়ও বিরাম নেই। বিচার এখন রাতেও গড়াচ্ছে।

গ্রামে কিংবা শহরে গ্রেপ্তার আর প্রতিপক্ষের ভয়ে ঘরছাড়া বহু মানুষ। ভয় ও আতঙ্ক নিয়ে ঘুমাতে যাচ্ছে হাজার হাজার পরিবার। অস্থিরতা আর অনিশ্চয়তার মধ্যে অসংখ্য জীবন। ক্ষমতার ছোবলে দীর্ণ মানবাধিকার, পাতানো খেলায় ক্ষয়ে যাচ্ছে গণতন্ত্র, ক্ষীণ হচ্ছে স্বাধীনতার স্বপ্ন। দেশ অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে। ক্ষয়ে যাওয়া গণতন্ত্রে উড়ে যায় স্বপ্ন, পুড়ে যায় জীবন।

সাধারণ অর্থে রাজনীতি হলো আপসের একটি কৌশল। রাজনীতিতে যখন ‘আমাদের’ বনাম ‘তাদের’ মানসিকতা শক্তিশালী হয়ে ওঠে, একটি পক্ষের মধ্যে নিয়ন্ত্রণ, আধিপত্য ও অনমনীয়তা প্রকট আকার ধারণ করে, যখন পরস্পরের মধ্যে মতবিরোধ প্রবল হয়ে ওঠে, তখন সমাধানের পথ সংকুচিত হয়। দূষিত রাজনীতি তখন সমাজকে কলুষিত করে এবং প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে।

যে প্রশ্ন উঠছে এখন—সংঘাত কি তাহলে বাংলাদেশে অনিবার্য হয়ে পড়ছে? এ প্রসঙ্গে হার্ভার্ডের অধ্যাপক গ্রাহাম অ্যালিসনের ‘থুসিডাইডস ট্র্যাপ’ তত্ত্ব বেশ প্রাসঙ্গিক।

ইতিহাসে থুসিডাইডস ফাঁদের মূল কথা হলো, যখন একটি উদীয়মান শক্তি একটি প্রতিষ্ঠিত শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করে, তখন সংঘাত, যুদ্ধের হুমকি বা বিপদের আশঙ্কা তৈরি হয়। এর ফলাফল হয় মারাত্মক, যা পুরো জাতির জন্য হয় পরাজয়ের। প্রাচীন গ্রিসকে ধ্বংসকারী পেলোপোনেশিয়ান যুদ্ধ সম্পর্কে ঐতিহাসিক থুসিডাইডস ব্যাখ্যা করেছিলেন যে এথেন্সের উত্থানে প্রতিষ্ঠিত শক্তি স্পার্টাতে যে ভয় ও আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছিল, তা যুদ্ধকে অনিবার্য করে তুলেছিল।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে চলছে অধিকার হরণের পালা। অনিয়মতান্ত্রিকভাবে একটি পক্ষ অন্য পক্ষের অধিকার কেড়ে নিচ্ছে, অন্যায্য সমাধান চাপিয়ে দিচ্ছে এবং দলীয় স্বার্থে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে নিপীড়ন চালাচ্ছে। দেশের মানুষ এখন ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন না, নিজেদের মতপ্রকাশে নিরাপদ বোধ করেন না। ভিন্নমতকে শুধু অগ্রাহ্যই করা হয় না, শাস্তির মুখোমুখি করা হয়। দিনে দিনে জনগণের মধ্যে হতাশা বাড়ছে, অসন্তোষ তৈরি হচ্ছে। বাড়ছে সংঘাতের ভয় এবং আতঙ্ক।

রাজনৈতিক মতানৈক্যের পাশাপাশি যে বিষয়গুলো নেতিবাচক ভূমিকা রাখে, তা হচ্ছে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের একে অপরের প্রতি অবজ্ঞা, আক্রোশ, প্রতিহিংসা ও বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব। দেশের রাজনৈতিক বড় দল দুটির পরস্পরের প্রতি বিরূপ ও আক্রমণাত্মক মনোভাব পারস্পরিক সম্পর্ককে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং দলীয় বিভাজনগুলোকে প্রকট করে তুলেছে, যার প্রভাব এখন সমাজের গভীর থেকে গভীরে বিস্তৃত ও অনুসৃত।

সংকটকালে সংলাপের মাধ্যমে সমাধানের প্রক্রিয়া শুরু হলে সংঘাতের আশঙ্কা বা তাঁর নেতিবাচক দিকগুলো অনেকখানি দুর্বল হয়ে যায়। দুঃখজনক হলো, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ দেশের সার্বিক মঙ্গলের কথা ভেবে সমাধানের জন্য ঐকমত্যে আসার পথ খোঁজেনি। এখানে রাজনৈতিক বিতর্ক এতটাই বিতর্কিত ও উত্তপ্ত এবং রাজনৈতিক বিরুদ্ধাচারণ ও বিভাজন এতটাই নগ্ন ও নির্লিপ্ত হয়ে উঠেছে যে অনেকে আশঙ্কা করছেন, দেশ আবারও ভয়াবহ সংকটের দিকে এগোচ্ছে।

বিগত দিনে যার পরিণতি হয়েছিল সংঘাত-সহিংসতা, অগণতান্ত্রিক শক্তির উত্থান কিংবা গৃহযুদ্ধের গর্জন। বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশে ‘থুসিডাইডস ফাঁদ’ অনস্বীকার্য হয়ে উঠছে—অত্যধিক অভ্যন্তরীণ বিভাজন দেশকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে দুর্বল করে এমন একটি জায়গায় নিয়ে যেতে পারে, যেখান থেকে ফেরার উপায় থাকবে না। জাতিকে ক্রমেই সংঘাতের দিকে ঠেলে দেবে।

গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ক্ষয়ে যাচ্ছে। রাজনীতি নিয়ে খেলা করতে গিয়ে জাতি হিসেবে আমরা খেলো হয়ে যাচ্ছি, পিছিয়ে পড়ছি। আমরা অপরাজনীতির সঙ্গে আপস করছি, স্বৈরতন্ত্রের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছি। নিজেকে নিজের বিরোধী সাজিয়ে ডামিতন্ত্র দিয়ে গণতন্ত্রের মান রক্ষার চেষ্টা করছি। পাতানো খেলায় নিজের গোলপোস্টে নিজেই গোল করে জয়ী হওয়ার আয়োজন করছি।

আমরা নিশ্চিতভাবেই এক পরাজয়ের খেলায় মেতেছি। আমরা চাই না ভবিষ্যতের কোনো ইতিহাসবিদ আমাদের পরাজয় নিয়ে বই লিখুক। যেখানে ‘সহাবস্থান’, ‘পরমতসহিষ্ণুতা’ শব্দ খুঁজে পাওয়া যাবে না, শুধু থাকবে ‘সংঘাত’, ‘সহিংসতা, ‘নাশকতা’ শব্দগুলো। আমরা হারতে চাই না—আমাদের মুক্তি অনেক দাম দিয়ে কেনা, অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতা। রাজনীতির মূল কথা যদি হয় দেশ ও জাতির কল্যাণ, তবে সংঘাত যেন আমাদের শেষ কথা না হয়।

  • ড. ফরিদ খান অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
    প্রথম আলো