বি এন পি,  ভো টা ভু টি র  বা জা র  ও  গ ণ ত ন্ত্র

ফরহাদ মজহার    22 December 2023
১. বি এন পি,  ভো টা ভু টি র  বা জা র  ও  গ ণ ত ন্ত্র
বিএনপি এবং ফ্যাসিস্ট সরকার বিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক দল শেখ হাসিনার সরকারের ২০২৪ সালের নির্বাচনে যাচ্ছে না। ইতোমধ্যে বিএনপি বর্তমান সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত ‘অসহযোগ আন্দোলনের’ ডাক দিয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে সাতই জানুয়ারির ভোট বর্জন করা, ট্যাক্স, খাজনা ও ইউটিলিটি বিল না দেওয়া। এই আহ্বান বিএনপি প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারী থেকে শুরু করে সর্বস্তরের জনগণের প্রতি জানিয়েছে। ক্ষমতা থেকে ফ্যাসিস্ট শক্তি উৎখাত না হওয়া পর্যন্ত এই আন্দোলন চলবে। শুরু থেকেই আমরা বলেছি চরম প্রতারণাপূর্ণ নির্বাচনী ডামাডোলে সময় অপচয় না করে ফ্যাসিস্ট শক্তি ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করাই আমাদের কাজ। দেরিতে হলেও বা নতুন উপলব্ধির পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপি এই নতুন সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
অভিনন্দন। 
জাতীয় রাজনীতি এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ণয়ের দিক থেকে আগামি নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত খুবই সঠিক। ভোটচুরি ও রাষ্ট্রের নির্বাহী ক্ষমতার অপব্যবহার এবং চরম মানবাধিকার লংঘন করে ফ্যাসিস্ট শক্তি ক্ষমতায় রয়েছে। এই সরকার অবশ্যই  ‘অবৈধ’। সুষ্ঠ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হয়ে বর্তমান ফ্যাসিস্ট শক্তি ক্ষমতায় আসে নি। ফ্যাসিস্ট শক্তির বলে ভোট চুরি করে এবং রাতের বেলা ব্যালটে সিল মেরে ফ্যাসিস্ট শক্তি ক্ষমতা দখল করেছে।
সবাইকে সবার আগে একটা বিষয় বুঝতে হবে। সামরিক অভ্যূত্থানের চেয়েও ক্ষমতাসীন দলের  ব্যালট চুরি ভয়ংকর। সামরিক শাসন আইন বা সাংবিধানিক ভাবে বৈধ নয় – এটা দেশের সাধারন জনগণসহ দেশবিদেশের সবাই বুঝতে পারে। কিন্তু ক্ষমতায় থেকে সংবিধান বদলিয়ে, সমস্ত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে ‘দলীয়’ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা এবং ভোট চুরি করে ক্রমাগত ক্ষমতায় থাকা বা ভোট চুরির মাধ্যমে আগামি নির্বাচনে নতুন ভাবে ক্ষমতা দখল করবার কারবার চরম বে-আইনী বা অবৈধ। তাই ক্ষমতাসীন সরকার শুধু ‘ফ্যাসিস্ট’ নয়, ‘অবৈধ’-ও বটে। এ ধরণের অবৈধ সরকার শুধু নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনী ব্যবস্থা নয়, রাষ্ট্রের সকল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দেয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেটাই ঘটেছে।
রাষ্ট্র বিজ্ঞানে তথাকথিত ভোটাভুটির নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্র ব্যবস্থার ফ্যাসিস্ট রূপান্তর ফ্যাসিস্ট শক্তির ‘অভ্যুত্থান’ নামেও সুপরিচিত। জাতীয় সংসদের দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে রাষ্ট্রকে ফ্যাসিস্ট শক্তির হাতিয়ারে পরিণত করা যায়। সেটাই হয়েছে। বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা নতুন কিছু না। আমরা ইতিহাস থেকে জানি ‘এডলফ হিটলার’ সহ অনেক ফ্যাসিস্ট শক্তি তথাকথিত নির্বাচন, নির্বাচনে জাতীয় সংসদে সংখ্যা গরিষ্ঠতার জোরে রাষ্ট্র ব্যবস্থার ফ্যাসিস্ট রূপান্তর ঘটিয়েছে।  কিভাবে নির্বাচনের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদ ফ্যাসিস্ট শক্তি ওঠে এবং  রাষ্ট্র ব্যবস্থা ফ্যাসিস্ট চরিত্র পরিগ্রহণ করে সেটা ইউরোপের ইতিহাস পর্যালোচনা করলেই আমারা বুঝব।  ইউরোপে নাৎসিবাদ ও ফ্যাসিবাদের ইতিহাসে সেটা আমরা দেখেছি। যথারীতি বাংলাদেশেও নির্বাচনের মাধ্যমে গণবিরোধী শক্তি ক্ষমতায় গিয়ে রাষ্ট্রকে সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থায় পরিণত করেছে। এটা নতুন কোন ব্যাপার না। বাংলাদেশে ইতিহাস ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার অভাবে জনগণকে আমরা তা এখনও বোঝাতে পারি নি।
২৩ মার্চ ১৯৩৩ সালে হিটলারও নির্বাচিত হয়েছিলেন।তার উত্থান নির্বাচনের মাধ্যমে। নির্বাচিত হয়ে হিটলার ‘রাইখস্টাগ’ নামে পরিচিত জার্মানির নির্বাচিত প্রতিনিধিদের  সভায় তার হাতে সকল ক্ষমতা কুক্ষিগত করবার আইন (Enabling Law) পাশ করিয়ে নিয়েছিলেন। এই নতুন আইন হিটলারকে আইন প্রণয়ণের পরিষদ এবং রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে আইন পাস করার পরিবর্তে ডিক্রির মাধ্যমে শাসন করার ক্ষমতা দিয়েছে। অতএব বুঝতে হবে একনায়কী ফ্যাসিস্ট শাসক হিশাবে হিটলারের আবির্ভাব এবং জর্মন রাষ্ট্রের পরিণতি নির্বাচনী ব্যবস্থার মধ্য দিয়েই সম্পন্ন হয়েছে। ২৪ মার্চ ১৯৩৩ তারিখে বিলটি ৯৫ ভোটের বিপক্ষে ৪৪৪ ভোটে পাস হয়।
বাংলাদেশের সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদও একজন ব্যাক্তির হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখবার সংবিধান। জাতীয় সংসদ, বিচার বিভাগ এবং নির্বাহী বিভাগ কার্যত একজন ব্যক্তির হাতেই কেন্দ্রীভূত। তাহলে বাংলাদেশের এই বাস্তবতা আমাদের সকলকে বুঝতে হবে। এটাও জানা ও বোঝা দরকার যে এক ব্যাক্তির হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করবার আইন বা সংবিধান বাংলাদেশে সবসময়ই জারি ছিল। ক্ষমতায় থাকার সময় রাষ্ট্র ব্যবস্থার গণতন্ত্রায়নে  বিএনপি কোন ভূমিকা রাখে নি। দ্বিতীয়ত র‍্যাপিড একশান ব্যাটেলিয়নও বিএনপির আমলেই প্রণীত হয়েছিল।  র‍্যাব যে বিএনপির বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হবে এবং এর জন্য বিএনপিকে চরম মূল্য দিতে হবে সেটা সেই সময় র‍্যাব নিয়ে আমার লেখায় আমি বলেছি। কিন্তু আফসোস, বিএনপিকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছি।
তবে এটা মানতে হবে ফ্যাসিবাদী এবং গণবিরোধী চিন্তা থেকে জনগণকে মুক্ত ও সচেতন করা কঠিন কাজ। সমাজে ফ্যাসিবাদী চিন্তা এবং রাজনীতির নামে ফ্যাসিস্ট শক্তি গঠন অব্যাহত থাকলে নির্বাচন ফ্যাসিস্ট শক্তিকে আরও শক্তিশালী করে এবং ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে আইনী বৈধতা দেয়। যে কারনে আমরা বারবার নির্বাচনী মোহে জনগণকে প্রতারিত করবার কারবার পরিহার করে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে নতুন ভাবে বাংলাদেশ ‘গঠন’ করবার কথা বলি। বলাবাহুল্য রাষ্ট্র বা রাষ্ট্র ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক হলে নির্বাচন ইতিবাচক ফল দিতে পারে। কিন্তু নির্বাচনকে গণতন্ত্র বলা বিদ্যমান বাংলাদেশের বাস্তবতায় মূলত ফ্যাসিস্ট শক্তি ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে বৈধতা দেবার অধিক কিছু না। হতেও পারে না। আমাদের অবশ্যই নতুন ভাবে বাংলাদেশ গঠন করতে হবে যেন নিদেনপক্ষে ব্যক্তির গণতান্ত্রিক অধিকার, সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার বাস্তবায়িত করা যায়। এটাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। এর বিপরীতে জাতিবাদ, সমাজতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতা মূলত বাংলাদেশের বাস্তবতায় ফ্যাসিস্ট মতাদর্শ এবং ইসলাম নির্মূল রাজনীতি।
অন্তঃসারশূন্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বেসামরিক ফ্যাসিস্ট অভ্যুথান ঘটে। সামরিক অভ্যুত্থানের চেয়েও সেটা ভয়ংকর হয়। এই তিক্ত অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছে। নির্বাচন ফ্যাসিস্ট শক্তির চেহারা লুকিয়ে রাখে। ফ্যাসিস্ট শক্তিকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত এবং নতুন ভাবে বাংলাদেশকে গঠন এবং জনগণের দ্বারা নতুন ভাবে গঠিত শক্তিশালী বাংলাদেশেই কেবল ‘ফ্রি এন্ড ফেয়ার ইলেকশান’ বা সুষ্ঠ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন সম্ভব। বাংলাদেশের জনগণের সামনে আর কোন পথ ফ্যাসিস্ট শক্তি খোলা রাখে নি।
অতএব আগামি নির্বাচন বর্জন এবং বিরোধী দলের অসহযোগ আন্দোলন খুবই সঠিক, এবং যৌক্তিক। তবে আমরা চাই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন। যৌথ বা সমান্ততরাল নয় বরং ঐক্যবদ্ধ ভাবে গড়ে তোলাই কৌশলে্র দিক থেকে এখন সঠিক কাজ। ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলা এবং  মতাদর্শিক ও কৌশলগত পার্থক্য শনাক্ত করা এবং আন্দোলনের স্বার্থে নিরসন করা এখন সকলের কাজ।
এর ওপর বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ভর করে। (চলবে)