যে পরীক্ষার ফল আগাম জানা থাকে

যে পরীক্ষার ফল আগাম জানা থাকে 

এম এ আজিজ :  প্রায় সারাবিশ্বের দৃষ্টি এখন বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের দিকে। দেশের জনগণ যে দৃষ্টিতে এই নির্বাচনকে দেখছে; পরাশক্তিগুলো কি একই দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখছে? উত্তর– না।

দেশের জনগণ কি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায়? বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে উত্তর আংশিক সত্য। প্রকৃতপক্ষে জনগণের অংশ হিসেবে বড় যে কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী-সমর্থক এমন একটি নির্বাচন চায়, যাতে তাদের সমর্থিত দলটিই ক্ষমতার নাগাল পায়। এর প্রধান কারণ, রাজনৈতিক দলগুলোর মূল লক্ষ্য যে কোনো কৌশল বা অপকৌশলে ক্ষমতা ধরে রাখা বা ক্ষমতায় আরোহণ করা।

এর বাইরে আওয়ামী লীগ তার প্রার্থীদের প্রত্যাহার না করে ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে পরিচিত তৃণমূল বিএনপি, বিএনএম ও সুপ্রিম পার্টির কিছু নেতাকে জয়ী করার আশ্বাস দিয়েছে। এ ছাড়া কল্যাণ পার্টির মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমকে কক্সবাজার, বিএনএমের শাহ মোহাম্মদ আবু জাফরকে ফরিদপুর, তৃণমূল বিএনপির শমসের মবিন চৌধুরীকে সিলেট এবং তৈমূর আলম খন্দকারকে নারায়ণগঞ্জ থেকে ভোটে জেতার জন্য সরকার অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে দেবে।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ‘সংখ্যাগরিষ্ঠতাভিত্তিক (ওয়েস্টমিনস্টার) সংসদীয় নির্বাচনী ব্যবস্থা’ অনুসরণ করে। এই নির্বাচনী ব্যবস্থায় ‘বিজয়ী সব পায়’ (Winner takes all)। যেহেতু দেশে গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও সুশাসন দুর্বল, তাই সরকারে থেকে বিরোধী দলকে যেমন দমন-পীড়ন করে পুনরায় সহজে ক্ষমতায় যাওয়া যায়, তেমনি বিত্ত ও প্রতিপত্তিশালীও হওয়া যায়।

অন্যদিকে পরাশক্তিগুলো বাংলাদেশের মতো তুলনামূলক দুর্বল দেশে যার যার আধিপত্য ও অর্থ-সম্পদ দখলে নেওয়ার লক্ষ্যে নির্বাচনকে দেখছে। তাহলে স্বাধীন বাংলাদেশের অবস্থানটা কোথায়? উল্লেখ্য, বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক মিত্র দেশ, যেখানে গণতন্ত্র, মানবাধিকার বা সুষ্ঠু নির্বাচন বলতে কিছুই নেই। ওই দেশগুলোকে রেখে কেন দেশটি বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য এত পরিশ্রান্ত ও কৌশলী?

প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক, বিনিয়োগ, প্রবাসী আয়সহ বিভিন্ন ধরনের সম্পর্ক আছে। এ ছাড়া ‘নিরাপত্তা সহযোগিতা’ও রয়েছে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সব মিত্র দেশের সঙ্গেও বাংলাদেশের সম্পর্ক নিবিড়।

দ্বিতীয়ত, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল ঘিরে ভূরাজনীতি। যুক্তরাষ্ট্র নানাভাবে বাংলাদেশকে চাপে রেখে চীনের বলয়ের বাইরে রাখতে চায়। বাংলাদেশ পরাশক্তিগুলোর, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতার ফাঁদে পড়েছে। এ ছাড়া ভারত চিরাচরিতই বাংলাদেশের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে আছে।

অন্যদিকে বাংলাদেশ চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অংশ হয়েছিল। ২০২১ সালের মে মাসে ঢাকার চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং বলেছিলেন, বাংলাদেশ যেন মার্কিন নেতৃত্বাধীন ‘কোয়াড’ নামের ‘বেইজিংবিরোধী ক্লাবে’ যোগ না দেয় এবং এটি করলে চীন-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ভয়াবহ ক্ষতি হবে।

বাংলাদেশ অবশ্য ‘কোয়াড’ অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ভারত ও অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে গঠিত কোয়াড্রিল্যাটেরাল সিকিউরিটি ডায়ালগের অংশ নয়। তবে এ দেশগুলো বাংলাদেশকে বাইডেন প্রশাসনের বৃহত্তর ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির অংশ করতে চায়।

গত ১৭ ডিসেম্বর রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা বলেছেন, বাংলাদেশে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের পর আরব বসন্তের মতো পরিস্থিতি ঘটাতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের বর্তমান সরকারকে পশ্চিমাদের কাছে ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘‌সামনের সপ্তাহগুলোয় বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞাসহ আরও বিস্তৃত মাত্রায় চাপ প্রয়োগ হতে পারে।’
উল্লেখ্য, গত ১৩ ডিসেম্বর মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রধান মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলারের কাছে বাংলাদেশের দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাঁর দেশের অবস্থান জানতে চাওয়া হয়েছিল। তিনি কূটনৈতিক ভাষায় বিষয় দুটির ওপর জবাব দিয়েছিলেন। যেমন, প্রথম প্রশ্নে জানতে চাওয়া হয়েছিল, আগামী ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপের কোনো খবর আছে কিনা? জবাবে ম্যাথিউ মিলার বলেন, ‘আজ আমি নতুন করে কোনো নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দিচ্ছি না।’ তিনি বলেন, কোনো নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার আগে আমরা সে বিষয়ে কোনো পর্যালোচনা করি না। এখানে ম্যাথিউ মিলার নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার ক্ষেত্রে হ্যাঁ-সূচক ইঙ্গিত করেছেন, কিন্তু বিষয়টি পরিষ্কার করেননি।

দ্বিতীয় প্রশ্নে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্রের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, ছয়টি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা বিশ্ব-সম্প্রদায়কে বাংলাদেশে মৌলিক অধিকার রক্ষায় একযোগে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছে। তবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী দাবি করছেন, তারা যুক্তরাষ্ট্রকে ম্যানেজ করতে পারবেন। সে বিষয়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

এর জবাবে ম্যাথিউ মিলার বলেন, ‘হাজার হাজার বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের খবরে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। আমরা সব পক্ষকে সংযম প্রদর্শন ও সহিংসতা এড়াতে আহ্বান জানাই। আমরা বাংলাদেশ সরকারকে পরিস্থিতি তৈরি করে সব অংশীদারের সঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানাই, যাতে সবাই সহিংসতা বা প্রতিশোধের ভয় ছাড়াই প্রাক-নির্বাচন এবং নির্বাচনী পরিবেশে অবাধে অংশগ্রহণ করতে পারে।’

অর্থাৎ ম্যাথিউ মিলার এ বিষয়ে হ্যাঁ-সূচক উত্তর দিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। আবার সহিংসতামুক্ত নির্বাচনের পরিবেশ তৈরির আহ্বানও জানিয়েছেন। বাকিটা বুঝে নেওয়ার জন্য সময়ের অপেক্ষা
করতে হবে।

এম এ আজিজ: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলাম লেখক

সমকাল