মীযানুল করীম : আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষ গরিব। ওদের কাছে নির্বাচন একটি ভোটের উৎসবের মতো। সাধারণ মানুষ তাদের ভোট পচতে দেয় না। ভোট পচার অর্থ ভোট নষ্ট হয়ে যাওয়া। এর অর্থ, প্রার্থী না জেতা। সাধারণ মানুষ ভোট দেয় আবার ভোট খায়ও। সে বিষয়ে পরে আসছি। অনেকেই বলেন, নির্বাচন থেকে গণতন্ত্র নির্বাসিত হয়ে গেছে। আসলে গণতন্ত্র পুরো কোনো সময় ছিল না। মায়ের কাছে শুনেছি, ত্রিশের দশকে একজন শক্তিশালী ব্যক্তিকে আটকে রাখা হয়েছিল তাদের বাড়িতে। তিনি ছিলেন গ্রামের সংখ্যালঘুদের নেতা। নমিনেশন পেপার সাবমিট করার পর তাকে ছাড়া হয়।
আমার মনে আছে, ১৯৬৪ সালের ফেনী পৌরসভার নির্বাচনের কথা। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের আবু বকর সিদ্দিক চেয়ারম্যান পদে জয়লাভ করেছিলেন। ওই নির্বাচনের দিন গ্রামের এক সাধারণ মহিলা এসে আমার আম্মাকে বলেন, ‘আপনারা কি কেবল ভোট দিয়েছেন, না খেয়েছেন? আমার আম্মা প্রশ্ন করেন, ভোট কিভাবে খায়। মহিলা বললেন, ভোট খাওয়া, মানে পান খাওয়া, চা খাওয়া, রিকশায় করে আসা-যাওয়া করা। আম্মা উত্তর দিলেন, আমরা এসবের কিছুই করিনি। ওই মহিলা বললেন, ‘আপনারা শুধু ভোট দিয়েছেন, খান নাই।’ ওই মহিলার কথা শুনে আম্মা অবাক হলেন।
এরপর জানুয়ারি মাসে দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে গেলাম ভোটকেন্দ্রে। সেখানে ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা শুধু ভোট দিচ্ছেন। সবাই সরকার পার্টি। অথচ সবাই বিরোধী দল থেকে নির্বাচিত।
আমাদের এক স্যার বলতেন, ‘বেচাকেনার ডেমোক্র্যাসি। আসলে নাম ছিল বেসিক ডেমোক্র্যাসি। শুনেছি, সোহরাওয়ার্দী সাহেব বলেছিলেন ঞযব উবসড়পৎধপু ড়ভ ঃযব নধংব অর্থাৎ- নিম্নমানের গণতন্ত্র। স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান বলতেন, এটিই শিক্ষিতের গণতন্ত্র। প্রফেসর অৎহড়ষফ ঞড়বিহনবব ও প্রফেসর জঁংযনড়ড়শ রিষষরধসধং থেকে সার্টিফিকেট এনে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান খুব প্রচার করেছিলেন তার গণতন্ত্রের। আসলে তিনি আমাদের চরিত্র নষ্ট করে দিয়েছিলেন। এ কারণে সম্মিলিত বিরোধী দল বা ঈড়সনরহবফ ড়ঢ়ঢ়ড়ংরঃরড়হ চধৎঃু-পড়ঢ় বা ‘কপ’ এর প্রার্থী ও ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান-মেম্বাররা প্রেসিডেন্ট পদে সে আইয়ুব খানকেই ভোট দিয়েছিলেন। অথচ তারা বিরোধী দলের নেত্রী এবং জাতির পিতার বোন মিস ফাতিমা জিন্নার লোক
আর সত্তরের ঐতিহাসিক জাতীয় নির্বাচনে জনগণ যা চেয়েছিল, তাই হয়েছে। তখন প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা সিইসি ছিলেন বিচারপতি আবদুস সাত্তার। যিনি পরে জিয়াউর রহমানের সময়ে এ দেশের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর দেশের প্রেসিডেন্ট এবং বিএনপির চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি কলকাতার লোক ছিলেন। কিন্তু সারা পাকিস্তানের প্রধান নির্বাচন কমিশনার হয়েছিলেন। সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের পেছনে তার যথেষ্ট অবদান ছিল বলে মনে করা হয়। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশে প্রথম সংসদ নির্বাচন হয়। এতে আওয়ামী লীগের অন্যতম এক নেতার পরাজয়ের শঙ্কায় তার ভোটের বাক্স হেলিকপ্টারযোগে ঢাকার এনে বঙ্গভবনে গণনা করা হয়। এ নিয়ে রহস্যের ধোঁয়া কখনও কাটেনি। মনে করা হয়, সে আসনে জিতেছিলেন তখনকার বিরোধী দল জাসদের একজন প্রার্থী। এভাবে দেখা যায়, এদেশে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের প্রক্রিয়া কখনও অবাধ ও গণতান্ত্রিক ছিল না।
নয়াদিগন্ত