রাশিয়া থেকে পণ্য নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ অরলিন্স বন্দরে যাওয়ার পথে বাংলাদেশী পতাকাবাহী জাহাজ মেঘনা অ্যাডভেঞ্চার থেকে পালিয়ে গেছেন চার নাবিক। গত ২৭ নভেম্বর এ বন্দরে পৌঁছানোর আগে যুক্তরাষ্ট্রের মিসিসিপি নদী এলাকায় জাহাজ থেকে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে পালান তাঁরা।
জাহাজটি ওই দিনই নিউ অরলিন্স বন্দরে পৌছায়। মেঘনা গ্রুপ এবং সরকারি সমুদ্র পরিবহন অফিস টিবিএসকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। পালিয়ে যাওয়া নাবিকদের বিরুদ্ধে শীঘ্রই মেরিন কোর্টে মামলা করা হবে বলে সমুদ্র পরিবহন অফিস জানিয়েছে ।
মেঘনা গ্রুপের সমুদ্রগামী জাহাজবহরের এর মহাব্যবস্থাপক (কারিগরি) প্রকৌশলী আবু তাহের টিবিএসকে বলেন, ‘মেঘনা এডভেঞ্জার জাহাজটি যুক্তরাষ্ট্রের নিউ অরলিন্স বন্দরে যাওয়ার পথে মিসিসিপি নদী এলাকায় জাহাজ থেকে লাফিয়ে পালিয়ে যান চার নাবিক। পালিয়ে যাওয়া নাবিকরা হলেন: চিফ কুক- মো. আরিফুল ইসলাম; জিএস- মোহাম্মদ ইব্রাহিম; ডেক ক্যাডেট- মো. সোহানুর, এবং আব্দুল কুদ্দুস নামের আরেকজন নাবিক।
এর মধ্যে আরিফুল ইসলামের বাড়ি নাটোর, মোহাম্মদ ইব্রাহিমের বাড়ি চট্টগ্রাম, সোহানুরের বাড়ি কিশোরগঞ্জ এবং আবদুল কুদ্দুসের বাড়ি দিনাজপুর ।
জাহাজের অবস্থান সনাক্তকারী ওয়েবসাইট মেরিন ট্রাফিকের তথ্য অনুযায়ী, ৬২ হাজার ৪৭২ মেট্রিকটন ধারণ সক্ষমতার ১৯৯.৯৮ মিটার লম্বা এবং ১২.৮ মিটার ড্রাফটের জাহাজটি বর্তমানে নিউ অরলিন্স বন্দরে অবস্থান করছে। গত ২৭ নভেম্বর বাল্ক ক্যারিয়ার জাহাজটি ওই বন্দরে পৌছায়।
সরকারি সমুদ্র পরিবহন অফিসের শিপিং মাস্টার মো. জাকির হোসেন চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, “নাবিক পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি আমরা শুনেছি। তবে মেঘনা গ্রুপের পক্ষ থেকে লিখিত কোন অভিযোগ পাইনি। সেটি পেলে, পালিয়ে যাওয়া নাবিকদের সিপিসি বাতিল করা হবে। ঢাকায় মেরিন কোর্টে সমুদ্র পরিবহন অফিসের পক্ষ থেকে মামলা দায়ের করা হবে।”
এদিকে গত ২৯ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ফক্স নিউজ এ সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, যুক্তরাষ্ট্র কোস্টগার্ডের হেলিকপ্টার এবং বেশ কয়েকটি ছোট ছোট নৌকা নিখোঁজ নাবিকদের উদ্ধারে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। ফক্স নিউজ নিখোঁজদের উদ্ধারের জন্য হেলিকপ্টারে করে চালানো অভিযানের ভিডিও প্রকাশ করেছে।
এর আগে আমেরিকার বন্দর থেকে নাবিক পালিয়ে যাওয়ার ঘটনায় ৩১ বছর ওই দেশের বন্দরে বাংলাদেশী পতাকাবাহী জাহাজের চলাচল বন্ধ ছিল। এরপর ২০২২ সালের মার্চে বাংলাদেশী পতাকাবাহী জাহাজ– ‘বাংলার অগ্রগতি’ আমেরিকার হিউস্টন বন্দরে পৌছায়।
১৯৯১ সালে আমেরিকার বন্দরে যাওয়ার পর এমভি মমতার ১৪ নাবিক একযোগে গা ঢাকা দেয়। আমেরিকা থেকে ওই জাহাজ ফেরত আনতে একজন চিফ ইঞ্জিনিয়ারকে পাঠানো হলে তিনিও আমেরিকায় পৌঁছে সটকে পড়েন। পরবর্তীতে বাংলার মমতাকে দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হলেও– দেশীয় পতাকাবাহী, বিশেষ করে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের (বিএসসির) জাহাজ আর আমেরিকার কোনো বন্দরে যায়নি।
ওই সময়গুলোয় আমেরিকার বন্দর থেকে বাংলাদেশী জাহাজের শতাধিক যাত্রী পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছিল। এমন ঘটনায় আমেরিকায় প্রবেশে এক ধরনের অঘোষিত নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ে বিএসসির জাহাজ। আন্তর্জাতিক নৌপরিবহন খাতে যা বিএসসিসহ দেশের ভাবমূর্তিকে সংকটে ফেলে দিয়েছিল।
১৯৭৭ সালে বিএসসির জাহাজ– ‘বাংলার মান’ এর মাধ্যমে সমুদ্রপথে আমেরিকায় পণ্য পরিবহন শুরু হয়। উদ্বোধনী যাত্রায় বাংলার মান জাহাজে ক্যাডেট হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন আনাম চৌধুরী। যিনি বর্তমানে বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, “পৃথিবীর অন্যান্য দেশে নাবিক পালিয়ে যাওয়ার ঘটনায় পরিবারের সম্পত্তি ক্রোক করার বিধান আছে। কিন্তু বাংলাদশের জাহাজ থেকে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটলেও, দেশে এর বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমুলক শাস্তির বিধান নেই। ফলে নাবিক রিক্রুটিং এজেন্সি, ম্যানিং এজেন্ট এবং সংঘবদ্ধ চক্র এসব জালিয়াতির সাথে যুক্ত হচ্ছে।”
তিনি আরো বলেন, জাহাজ থেকে নাবিক পালিয়ে যাওয়ার সাথে কারা যুক্ত, তাদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমুলক শাস্তির ব্যবস্থা নিতে হবে। এটি বন্ধ করা না গেলে বাংলাদেশের ক্রমবিকাশমান মেরিন সেক্টর বিপর্যয়ে পড়বে।