তারিক চয়ন : আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সমপ্রতি বলেছেন, জাতীয় নির্বাচনের তফসিল হবে নভেম্বরের মাঝামাঝি বা তার আগে এবং নির্বাচন হবে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে। সে হিসেবে আড়াই মাসেরও কম সময়ের মধ্যে দেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। অর্থাৎ, নির্বাচন দরজায় কড়া নাড়ছে। প্রায় সব নির্বাচনের আগেই নানা ইস্যুতে দেশের রাজনীতি সরগরম হয়ে উঠে। এবারো তার ব্যতিক্রম নয়। তবে, এবার একেবারে অভিনব একটি ইস্যু নিয়ে ইতিমধ্যেই আলোচনা-সমালোচনা ডানা মেলেছে। সেটি হলো- নির্বাচনকে সামনে রেখে আনসারকে গ্রেপ্তার ও তল্লাশির ক্ষমতা দেয়া হচ্ছে।
আনসার ব্যাটালিয়ন সদস্যদের অপরাধীকে আটক, দেহ তল্লাশি ও মালামাল জব্দের ক্ষমতা প্রদান, সেই সঙ্গে বিদ্রোহের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে ‘আনসার ব্যাটালিয়ন বিল, ২০২৩’ সোমবার সংসদে উঠেছে। প্রস্তাবিত বিলের ৮ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যাটালিয়ন সদস্যের সামনে সংঘটিত অপরাধের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অনুমোদনক্রমে অপরাধীকে আটক করে অবিলম্বে পুলিশের কাছে সোপর্দ করবে এবং ক্ষেত্রমতো জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট অথবা দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নির্দেশক্রমে আটক ব্যক্তির দেহ তল্লাশি; কোনো স্থানে প্রবেশ ও তল্লাশি এবং মালামাল জব্দ করতে পারবে।’
অবশ্য সংসদে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ফখরুল ইমাম আপত্তি জানান। তার আপত্তি কণ্ঠভোটে নাকচ হয়ে যায়। বিলটি তিন দিনের মধ্যে পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দেয়ার জন্য সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়েছে।
সংসদ সচিবালয় সূত্রে জানা গেছে, একাদশ সংসদের সর্বশেষ চলমান অধিবেশন আগামী ২রা নভেম্বর শেষ হয়ে যাচ্ছে। চলতি এই অধিবেশনেই বিলটি পাস হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর আগে গত ৪ঠা সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে ‘আনসার ব্যাটালিয়ন আইন, ২০২৩’-এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়েছিল। তবে, তারও সাত মাস আগে
আনসার বাহিনীর বিভিন্ন সমস্যা ও চাহিদার বিষয়ে ঢাকার একটি পত্রিকার সঙ্গে আলাপচারিতায় বাহিনীর মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল একেএম আমিনুল হক এ আইনের কথা নিশ্চিত করে বলেছিলেন, ‘আনসার আইন প্রক্রিয়াধীন। এই আইন হয়ে গেলে এসবের আর কিছু দরকার হবে না। সবকিছুই এই আইনের মধ্যে আছে।’ তিনি বলেছিলেন, ‘আনসার বাহিনী আগের তুলনায় অনেক উন্নত হয়েছে। আগে বাহিনীর থ্রি নট থ্রি রাইফেল ছিল, এখন শটগান চলে এসেছে। একটার পর একটা উন্নয়ন হচ্ছে।’ (জাতীয় নির্বাচনের আগে পরিচালক পদসহ যাবতীয় সুবিধা চায় আনসার, বাংলা ট্রিবিউন/১১ই ফেব্রুয়ারি ২০২৩)।
নিকট অতীতে আনসার-ভিডিপিকে আধুনিক ও যুগোপযোগী বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার অনেক উদাহরণই দেখা গেছে। যেমন: মহাপরিচালক হিসেবে আমিনুল হকের নিয়োগের পরদিনই (১৮ই জানুয়ারি) শিক্ষা সফরের অংশ হিসেবে বসুন্ধরা গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ইস্ট-ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপ লিমিটেড পরিদর্শন করেছিলেন আনসার ভিডিপি’র ৩৮তম বিসিএস কোর্সের পরিচালক সারওয়ার জাহান চৌধুরী ও ৩৮তম বিসিএস কোর্সের সহকারী পরিচালক রোকসানা বেগমের নেতৃত্বে ৩৬ জনের একটি প্রতিনিধিদল। সারওয়ার জাহান চৌধুরী সেদিন বলেছিলেন, ‘আমরা ৩৮তম বিসিএসের ৩৬ জন কর্মকর্তাকে নিয়ে শিক্ষা সফরের অংশ হিসেবে ইস্ট-ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপে এসেছি। আমরা সবাই জানি যে, এই প্রতিষ্ঠানের মিডিয়ার ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি। কারণ তারা ৩টি প্রথম সারির পত্রিকা প্রতিনিয়ত বের করছে, যারা সব সময় বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশ করে থাকে। এই কারণে আমাদের কর্মকর্তাদের এখানে নিয়ে আসা। গণমাধ্যমের সঙ্গে আমাদের সুন্দর যোগাযোগ থাকে সব সময়। আমরা চাই, ইস্ট-ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপ এখনকার মতো ভবিষ্যতেও একই ধারা বজায় রাখুক।’ (ইস্ট-ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপ পরিদর্শনে আনসার-ভিডিপি’র কর্মকর্তারা, বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম/ ১৮ই জানুয়ারি, ২০২৩)।
এভাবে, আনসার-ভিডিপিকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করে তোলার প্রচেষ্টাকে অনেকে স্বাগত জানালেও নির্বাচনের আগে ‘আনসার ব্যাটালিয়ন বিল, ২০২৩’ সংসদে উঠা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্ল্যাটফরমে অনেকেই নানা আলোচনা করছেন। বিশেষ করে সরকারের ঊর্ধ্বতন মহল থেকে শুরু করে বর্তমান মন্ত্রী-এমপিরাও যেখানে আনসার সদস্যদের কাছে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে প্রকাশ্যে ভোট চেয়ে আসছেন। মাত্র এক সপ্তাহ আগেই (১৭ই অক্টোবর) আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, ১৪ দলের সমন্বয়ক ও মুখপাত্র, সাবেক মন্ত্রী আমির হোসেন আমু, এমপি ‘সরকারের উন্নয়ন ধারাবাহিকতা’ চলমান রাখতে আনসার সদস্যদের কাছে নৌকা মার্কায় ভোট চেয়েছেন। ওইদিন দুপুরে ঝালকাঠি শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে আনসার-ভিডিপি’র জেলা সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে আমু বলেন, ‘বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, মাতৃত্বকালীন ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা প্রদানসহ গ্রামকে শহরে রূপ দিতে নিরলসভাবে কাজ করছে বর্তমান সরকার। আনসার সদস্যরাও সরকারের সুবিধা পেয়ে যাচ্ছে।’ আগামী সংসদ নির্বাচনে নৌকায় ভোট দিয়ে আবারো শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় আনতে আনসার সদস্যদের প্রতি তিনি আহ্বান জানান। (আনসার সদস্যদের কাছে নৌকায় ভোট চাইলেন আমির হোসেন আমু এমপি, যায়যায়দিন/ ১৭ই অক্টোবর ২০২৩)।
আমুর উক্ত বক্তব্যের কিছুদিন আগে (২৭শে সেপ্টেম্বর) আনসার মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আমিনুল হক স্বপনের ভাই এবং পানিসম্পদ উপমন্ত্রী একেএম এনামুল হক শামীম শরীয়তপুরে আনসার-ভিডিপি’র জেলা সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘আনসার সদস্যরা তৃণমূলে কাজ করে থাকে। এই বাহিনীর মানুষের হাঁড়ি, নারী ও ভালো মন্দের সঙ্গে সেতুবন্ধন করার সুযোগ সবচেয়ে বেশি। আগামী জাতীয় নির্বাচন উপলক্ষে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের অপপ্রচারকারীরা যাতে জনগণকে বিভ্রান্ত করতে না পারে সে বিষয়ে আনসার বাহিনীকে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে।
জাতীয় নির্বাচনে আনসার-ভিডিপি দক্ষতা ও সফলতার পরিচয় দিয়েছে বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বহুবার বাহিনীটির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কিছুদিন পর (১২ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯) গাজীপুরের সফিপুরে আনসার-ভিডিপি একাডেমিতে বাহিনীটির ৩৯তম জাতীয় সমাবেশ ও কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতাকালে শেখ হাসিনা আনসার-ভিডিপিকে দেশের সর্ববৃহৎ জনসম্পৃক্ত শৃঙ্খলা বাহিনী উল্লেখ করে উক্ত নির্বাচনে তাদের ভূমিকা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘প্রায় ৫ লাখ আনসার সদস্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন ভোটকেন্দ্র পাহারায় ও ভোটারদের নিরাপত্তার স্বার্থে। অক্লান্ত পরিশ্রম করে তারা বাংলার জনগণকে সুষ্ঠু একটি নির্বাচন উপহার দিয়েছেন।’ তিনি বলেন, ‘২০১৪-১৫ সালে বিএনপি-জামায়াত যখন অগ্নি-সন্ত্রাস চালায়; ককটেল ও বোমা মেরে রেল, গাড়ি, লঞ্চ, সিএনজি পুড়িয়ে যখন সাধারণ মানুষের চলাচলে বাধার সৃষ্টি করছিল, পুড়িয়ে পুড়িয়ে মানুষ হত্যা করছিল, তখন অগ্নি-সন্ত্রাস প্রতিরোধ করার ক্ষেত্রে, বিশেষ করে রেলের নিরাপত্তায় বিশিষ্ট ভূমিকা রাখে।’ (নির্বাচনে আনসার বাহিনী দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে: প্রধানমন্ত্রী, আরটিভি অনলাইন/ ১২ই ফেব্রুয়ারি ২০১৯)।
যাই হোক, ‘পুলিশের মতোই আটক-তল্লাশি-জব্দের ক্ষমতা পাচ্ছে আনসার’ এমন খবরে সরকার পক্ষ ব্যাপক উচ্ছ্বসিত হলেও বিরোধী পক্ষ এমন সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করছেন। সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি এবং রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি উভয়ই ইতিমধ্যে প্রকাশ্যে ও আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানিয়েছে। জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ফখরুল ইমাম সংসদে বলেছেন, ‘কথায় আছে, বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড়। এখানে বাঁশের চেয়ে কঞ্চি শক্ত হয়ে গেছে। পুলিশের কাজটা যদি বিভক্ত এবং সমান্তরাল করা হয়, তাহলে কাজটা করা যাবে না। দেশে সেনা, নৌ, বিমান বাহিনীর আলাদা আলাদা কাজ আছে। এলিট বাহিনীও করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সহায়তার জন্য আনসার বাহিনী তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু এই বিল পাস হলে পুলিশ যা করে, আনসার বাহিনীও তা করতে পারবে।’ (আটকের ক্ষমতা পাচ্ছেন আনসার সদস্যরা, বিল উঠলো সংসদে, প্রথম আলো অনলাইন/ ২৩শে অক্টোবর ২০২৩)।
অন্যদিকে, অবিলম্বে ওই বিল প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘সংসদে একটা বিল এসেছে। এটা একটা ভয়াবহ দুশ্চিন্তা শুধু নয়, আতঙ্কের বিষয়। গোটা রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে এরা (সরকার) কীভাবে ধ্বংস করে দিচ্ছে, ইনস্টিটিউশনগুলোকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। এখন যেখানে সারা পৃথিবীতে পুলিশই প্রতিষ্ঠান হিসেবে গ্রেপ্তারের ক্ষমতা পায়, অথচ এখানে আনসারকেও ক্ষমতা দেয়া হবে। যাদের বেসিক প্রশিক্ষণ পর্যন্ত নেই।’ আইন করে আনসার-ভিডিপি’র রাজনীতিকরণ করা হচ্ছে মন্তব্য করে তিনি বলেছেন, পুলিশিং কিন্তু আলাদা জিনিস। এখানে সবকিছুর কোড অব কনডাক্ট আলাদা, আইন আলাদা। সবকিছু আলাদাভাবে পরিচালিত হয়। আনসারের কাজটা এমন না। তারা একটা ভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সেইভাবে হয়। (আটকের ক্ষমতা দিয়ে আনা আনসার বিল প্রত্যাহার দাবি বিএনপি’র, জাগোনিউজ/২৪শে অক্টোবর ২০২৩)।
মানব জমিন