আদালত অবমাননার দায়ে অতিরিক্ত জেলা জজ পদমর্যাদার বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা মো. সোহেল রানাকে হাইকোর্টের দেওয়া এক মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ডের রায় ৫ ঘণ্টার ব্যবধানে স্থগিত করেছেন আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে হাইকোর্টের এক রায়ে সোহেল রানাকে এক মাসের সাজা দেওয়ার পাশাপাশি ৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এই রায় দেওয়ার তিন ঘণ্টা পর হাইকোর্টের একই বেঞ্চ তাঁকে আপিল করার শর্তে জামিন দেন। এর পর বিকেলে আপিল দায়েরের পর তাঁর ওই সাজার রায় স্থগিত করা হয়।
একাধিক বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, উচ্চ আদালত সংবিধান অনুযায়ী অধস্তন আদালতের অভিভাবক। কিন্তু বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তার শৃঙ্খলাজনিত কোনো বিষয় থাকলে সেটি নিষ্পত্তির জন্য প্রধান বিচারপতি ও সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন রয়েছেন। এ-সংক্রান্ত বিধিও আছে। সোহেল রানা আদালত অবমাননার মামলায় নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়েছেন। এর পরও তাঁকে সাজা দেওয়া এবং জামিন না দেওয়ার (তিন ঘণ্টা পরে জামিন দেওয়া হয়) বিষয়টি বিচার প্রশাসনের জন্য ভিন্ন বার্তা দেয়। দেশে-বিদেশে এটি নজিরবিহীন ঘটনা। বিষয়টি প্রধান বিচারপতিসহ সংশ্লিষ্টদের নজরে নেওয়ার পর আইনি প্রক্রিয়ায় আপাতত বিষয়টি সুরাহা হয়েছে।
কুমিল্লার একটি মামলায় উচ্চ আদালতের আদেশ অমান্য করার অভিযোগে সোহেল রানার বিরুদ্ধে গত আগস্টে আদালত অবমাননার রুল জারি করেন হাইকোর্ট। ওই রুলের চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে গতকাল বেলা সোয়া ১১টায় সোহেল রানাকে এক মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ডের পাশাপাশি ৫ হাজার টাকা জরিমানা করে রায় দেওয়া হয়। বিচারপতি মো. বদরুজ্জামান ও বিচারপতি এস এম মাসুদ হোসাইন দোলনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এই রায় দেন। পরে সাজার রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার শর্তে তিন ঘণ্টার মাথায় একই বেঞ্চ দুপুর সোয়া ২টার দিকে সোহেল রানাকে ৩০ দিনের জামিন দেন। এরপর হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবেদন করেন তিনি। বিকেল ৫টার পর আবেদনের শুনানি নিয়ে চেম্বার আদালত তাঁর কারাদণ্ড ও জরিমানার রায় স্থগিতের আদেশ দেন। আদালতে সোহেল রানার পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহ মঞ্জুরুল হক, সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী পলাশ চন্দ্র রায় ও সেলিম আশরাফ চৌধুরী। অন্যদিকে, হাইকোর্টে আবেদনকারী মামুনের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী প্রণয় কান্তি রায়। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, সোহেল রানা নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়েছিলেন। তাঁর নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা গ্রহণ না করে হাইকোর্ট ৩০ দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড ও জরিমানার রায় দিয়েছিলেন। চেম্বার আদালত ২০ নভেম্বর পর্যন্ত রায়ের কার্যকারিতা স্থগিত করেছেন। সোহেল রানার আইনজীবী শাহ মঞ্জুরুল হক বলেন, হাইকোর্টের রায় চেম্বার আদালত স্থগিত করে দিয়েছেন। বিষয়টি আপিল বিভাগেই নিষ্পত্তি হবে।
জানা যায়, ২০১৭ সালের ২৭ মার্চ কুমিল্লার কোতোয়ালি মডেল থানায় টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনে মামুন চৌধুরী ও রিয়া আক্তার দম্পতির বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়। মামলার কার্যক্রমের বৈধতা নিয়ে তারা হাইকোর্টে একটি আবেদন করেন। ওই আবেদনের শুনানি শেষে ২০১৮ সালের ৪ নভেম্বর রুল জারি করে মামলার কার্যক্রম স্থগিত করেন হাইকোর্ট। এই স্থগিতাদেশ থাকা সত্ত্বেও কুমিল্লার সাবেক চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সোহেল রানা গত ১০ এপ্রিল মামলায় অভিযোগ গঠন করেন। উচ্চ আদালতের আদেশ উপেক্ষা করে বিচার কাজ পরিচালনা করায় হাইকোর্টে আবেদন করেন মামুন। পরে চলতি বছরের ১৪ আগস্ট হাইকোর্ট সোহেল রানাকে তলব করেন। এরই ধারাবাহিকতায় এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে ২১ আগস্ট তাঁকে হাইকোর্টে হাজির হতে বলা হয়েছিল। পরে ধার্য তারিখে সোহেল রানা হাইকোর্টে হাজির হন এবং পরবর্তী সময়ে জবাব দাখিল করেন। তবে জবাব সন্তোষজনক না হওয়ায় গত ২৮ আগস্ট সোহেল রানার প্রতি স্বপ্রণোদিত হয়ে আদালত অবমাননার রুল জারি করেন হাইকোর্ট। পাশাপাশি ৯ অক্টোবর তাঁকে হাইকোর্টে হাজির হতে নির্দেশ দেওয়া হয়। ওই দিন সোহেল রানা সময়ের আর্জি জানান। হাইকোর্ট বৃহস্পতিবার পরবর্তী তারিখ রাখেন। আদালত অবমাননার রুলের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল সোহেল রানা নিঃশর্ত ক্ষমা চান। তবে তাঁর ক্ষমা প্রার্থনা নাকচ করে কারাদণ্ডের আদেশ দেন হাইকোর্ট। এর আগে গত আগস্টে কুমিল্লার মামলায় সোহেল রানাকে হাইকোর্টে তলবের পরপরই আইন মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করা হয়।