কামরুল হাসান, সমকাল ।। আদালত পাড়ায় দৌড়ঝাঁপ করে জামিন লাভ করেও কারামুক্তি মিলছে না বিএনপি নেতাদের। একের পর এক পুরোনো মামলায় আটক করা হচ্ছে তাদের। উচ্চ আদালত থেকে ‘নো অ্যারেস্ট, নো হ্যারেজ’ নির্দেশনা থাকার পরও প্রতিকার মিলছে না বেশির ভাগ নেতার। পুরোনো মামলায় ‘অজ্ঞাত’ আসামি হিসেবে তাদের জেলগেট থেকে আটক কিংবা জামিন পাওয়ার পরই নতুন মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে। এর মাধ্যমে তাদের কারাজীবনকে দীর্ঘায়িত করা হচ্ছে বলে অভিযোগ দলটির। আইনজীরীরা বলছেন, উচ্চ আদালতের নির্দেশনাও মানছেন না নিম্ন আদালত। এটা নজিরবিহীন।
বিএনপি নেতারা জানান, সক্রিয় নেতাদের টার্গেট করে একের পর এক পুরোনো মামলায় আটক দেখিয়ে চরমভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। এর মধ্যে বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য শেখ রবিউল আলম রবি, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সদস্য সচিব রফিকুল আলম মজনু, ভারপ্রাপ্ত সদস্য সচিব তানভীর আহমেদ রবিন, যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম নীরব, বর্তমান সাধারণ সম্পাদক মোনায়েম মুন্না, সাবেক সহসভাপতি এসএম জাহাঙ্গীর, যুবদলের যুগ্ম সম্পাদক গোলাম মাওলা শাহীন, ঢাকা মহানগর উত্তর স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক আজিজুর রহমান মোসাব্বিরসহ আরও অনেকে রয়েছেন। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সমকালকে বলেন, প্রতিদিন পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। যেভাবেই হোক সরকার বিরোধী দলকে মাঠ থেকে সরিয়ে দিয়ে আবার ক্ষমতায় থাকতে চায়। এটাই একমাত্র লক্ষ্য। তাই নির্বাচনের আগে সরকার মাঠ খালি করার মিশন নিয়ে নেমেছে। তিনি বলেন, অবৈধ সরকারের নির্দেশে পুলিশ এসব করছে। বিচার বিভাগ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও অন্যান্য বাহিনী একইভাবে কাজ করছে। বিচারপতিদের বলা হচ্ছে, দ্রুত সাজার রায় দিতে। এটা আওয়ামী লীগের পুরোনো খেলা।
আইনজীবীরা জানান, কারাগারে আটক নেতাকর্মীরা এক মামলায় জামিন পেলে পুরোনো আরেকটিতে গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে। যেমন কোনো মামলায় এজাহারে নাম না থাকলে নতুন কোনো মামলায় রফিকুল আলম মজনুকে গ্রেপ্তার না করতে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা ছিল। কিন্তু গত ২১ মে ঢাকা থেকে গোয়েন্দা পুলিশ তাঁকে আটক করে। গত বছরের ডিসেম্বরে পল্টন থানার একটি মামলায় তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়। ওই মামলায় এজাহারে মজনুর নাম ছিল না। এ মামলায় গত ৪ জুন জামিনের পরপরই পুলিশ মতিঝিল থানায় ২০২০ ও ২০২১ সালের দুটি পুরোনো মামলায় শ্যোন অ্যারেস্ট দেখাতে আদালতে আবেদন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে মজনুর আইনজীবীরা উচ্চ আদালতের নির্দেশনাকে নিম্ন আদালতের বিচারকের নজরে আনেন। কিন্তু তাঁকে আমলে না নিয়ে ওই দুই মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। একই সঙ্গে এ মামলায় তাঁকে দুই দিনের পুলিশের রিমান্ডও হয়। এই দুই মামলায় ২৫ জুন জামিন হলে পুনরায় ২০২২ সালে বংশাল থানার একটি মামলায় শ্যোন অ্যারেস্ট দেখানো হয়। ওই মামলাতেও ২৭ জুলাই জামিন হলে তাঁকে এবার ২০২২ সালে ওয়ারী থানার তিনটি মামলা এবং যাত্রাবাড়ী থানার একটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন করে পুলিশ। এসব মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে গত ১৩ আগস্ট ওয়ারী থানার একটি মামলায় এক দিনের রিমান্ডও দেওয়া হয় তাঁকে।
জানা গেছে, মজনু দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। কারাগারে তা আরও প্রকট আকার ধারণ করায় গত রোববার তাঁকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাঁর পিত্তথলিতে পাথর অপসারণে অপরেশন দরকার। এ ছাড়া শারীরিক আরও অনেক জটিলতা রয়েছে তার। মজনুর আইনজীবী মহিউদ্দিন চৌধুরী সমকালকে বলেন, একের পর এক পুরোনো ও অজ্ঞাতপরিচয় আসামির মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আটক রাখা হচ্ছে। আদালত থেকে হয়রানি না করার আদেশের পরও পুরোনো মামলায় আসামি করা হচ্ছে, রিমান্ডে নেওয়া হচ্ছে। একটি মামলা থেকে জামিন পেলে আরও একাধিক মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। এবার চারটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।
গত ৮ মার্চ মোনায়েম মুন্নাকে আটক করে পুলিশ। পরে গত বছরের নভেম্বর মাসে শাহজাহানপুর থানার একটি মামলায় তাঁকে আটক দেখানো হয়। এ মামলার এজাহারে তাঁর নাম ছিল না। অজ্ঞাতপরিচয় আসামির তালিকায় তাঁকে কারাগারে নেওয়া হয়। এ মামলায় তিনি জামিন পাওয়ার পর একের পর এক ৯টি পুরোনো মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে রাখা হচ্ছে। এক মামলা থেকে জামিন পেলে আরেক মামলায় আটক দেখানো হচ্ছে।
গত ৯ ফেব্রুয়ারি আটক করা হয় ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের সাবেক আহ্বায়ক গোলাম মাওলা শাহীনকে। তাঁকেও এ পর্যন্ত ১১টি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। তাদেরকে নতুন কোনো মামলায় আটক না করতে উচ্চ আদালতের নির্দেশনার পরও পুরোনো মামলায় আটক করা হচ্ছে। মুন্না ও শাহীনের আইনজীবী নীহার হোসেন ফারুক সমকালকে জানান, একসঙ্গে সব পেন্ডিং মামলায় আটক দেখানো হলে তাদের জন্য আইনি লড়াই সহজ হতো। কিন্তু একটি মামলা অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে জামিন করার দিনই নতুন আরেকটি মামলায় আটক করা হচ্ছে, হয়রানি করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের নির্দেশনাও মানা হচ্ছে না। কোনো সুনির্দিষ্ট মামলায় শাহীনের নাম না থাকলে এবং কোনো আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা না থাকলে তাঁকে গ্রেপ্তার না করতে নির্দেশনা দেন উচ্চ আদালত। কিন্তু একের পর এক পুরোনো মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে। একইভাবে মোনায়েম মুন্নার ক্ষেত্রেও তারা উচ্চ আদালতে রিট করেন। কিন্তু সেই নির্দেশনাও মানা হচ্ছে না। ৮ ডিসেম্বর আজিজুর রহমান মোসাব্বিরকে আটক করে পাঁচ দিন নিখোঁজ রাখা হয়। পরে আদালতে হাজির করে পুলিশ। প্রায় দেড় মাস পর তিনি সব মামলায় জামিনলাভ করেন। ২ ফেব্রুয়ারি জেলগেট থেকে মতিঝিল থানায় একটি পুরোনো মামলায় সন্দেহভাজন হিসেবে তাঁকে পুলিশ আটক করে। পরে উচ্চ আদালত থেকে সব মামলায় জামিন লাভ করার পর গত ১১ এপ্রিল জেলগেট থেকে তাঁকে আবারও শেরেবাংলা নগর থানায় একটি পুরোনো মামলায় সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেপ্তার করে। এ পর্যন্ত ছয়টি মামলা দিয়ে কারাজীবন দীর্ঘায়িত করা হয়েছে।
সর্বশেষ গত ২৩ এপ্রিলের একটি ঘটনায় হাতিরঝিল থানায় করা একটি ডিজিটাল সিকিউরিটি মামলায় তাঁকে আটক করা হয়েছে। কিন্তু তখন তিনি কারাগারেই ছিলেন। এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ‘সিগন্যাল’ গ্রুপের জন্য ওই মামলা হয়, সেখানেও নেই মোসাব্বির। এর পরও তাঁকে ওই মামলায় আটক দেখানোর পর উচ্চ আদালতে জামিন পান তিনি। কিন্তু চেম্বার জজ আদালত সেই জামিন স্থগিত করেন। এখন সেই আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতের আপিল বিভাগে শুনানির জন্য আগামী ২২ নভেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষায় আছেন বলে জানান তাঁর আইনজীবী দেলোয়ার জাহান রুমি। বিএনপি নেতারা জানান, জাতীয় সংসদ নির্বাচন এগিয়ে এলেই এ ধরনের গায়েবি মামলা, পুলিশের হয়রানি বাড়তে থাকে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগেও একই ঘটনা ঘটেছিল। এবারও সেই কাজ হচ্ছে। তবে এবার অনেক আগে থেকেই সেটি শুরু হয়েছে। কারণ পরিস্থিতি ভিন্ন। বিএনপি এখন আন্দোলনে রয়েছে। আন্দোলন ভণ্ডুল করতেই সরকার নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ বলেন, সরকার বিএনপিকে চাপে রাখতে গায়েবি ও পেন্ডিং মামলার ঝড় তুলেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে এবার বিচার বিভাগকে দিয়ে ২০১৮ সালের মতো পুরোনো খেলা শুরু করেছে। সারাদেশে বিএনপি নেতাকর্মীর নামে গায়েবি মামলার হিড়িক পড়েছে। বিনা পরোয়ানায় শত শত নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। কিন্তু এভাবে আর পার পাওয়া যাবে না। এই সরকারের সময় শেষ। এবার বিদায় নেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে।