বেলেন ফার্নান্দেজ
গত আগস্টে ওয়াশিংটন ডিসিতে আমার বাবা মারা যাওয়ার পরের দিনের ঘটনা। আমি মা–বাবার ফ্ল্যাটের ময়লা–আবর্জনা সাফ করে বাইরে ফেলতে যাচ্ছিলাম। এমন সময় ওই অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের বছর ষাটেক বয়সী একজন দারোয়ান আমার সঙ্গে কথা বললেন। ধরা যাক তাঁর নাম সিজার। তিনি জানালেন, আমার সদ্য প্রয়াত বাবার সঙ্গে তাঁর অল্প দিনের পরিচয় ছিল। তাঁর বাড়ি এল সালভাদর।
সিজার যখন আমার কাছ থেকে জানলেন, আমার বাবা প্রোস্টেট ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং চিকিৎসকদের দেওয়া অত্যন্ত ব্যয়বহুল কেমোথেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তাঁর মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করেছিল; তখন তিনি যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্যসেবাব্যবস্থা সম্পর্কিত নিজের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা বললেন। তিনি বললেন, কিছুদিন আগে রাস্তায় হাঁটার সময় তাঁর হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। তিনি মাতাল অবস্থায় আছেন মনে করে পথচারীরা ডাক্তার না ডেকে পুলিশ ডেকেছিলেন।
এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যুগে প্রবাহিত মিথ্যা সুখের বিজ্ঞাপন আমেরিকান ড্রিমকে আরও উসকে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে সুস্পষ্টভাবে হতাশাজনক পরিস্থিতির মধ্যে কাটানো সত্ত্বেও আমার কলম্বিয়ান বন্ধুরা আমেরিকায় নিজের উপস্থিতি জানান দেওয়া টিকটক ভিডিও বানিয়ে সেগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করে দেশে থাকা বন্ধুদের কাছে আত্মপ্রচার করতে চান।
যা হোক, পরে তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। কয়েক দিন পর হাসপাতাল ছাড়ার সময় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মৃত্যুবরণ না করার মতো বিলাসিতা দেখানোর জন্য তাঁর হাতে ৮০ হাজার ডলারের একটি বিল ধরিয়ে দেয়। এই বিল এখন তাঁকে কিস্তিতে বাকি জীবনে শোধ করে যেতে হবে।
সিজার বলেছেন, হাসপাতালে থাকা অবস্থাতেই তাঁর চাকরিদাতার কাছ থেকে একটি ফোন পেয়েছিলেন। চাকরিদাতা তাঁকে ফোনে জানিয়ে দেন কাজে না গিয়ে হার্ট অ্যাটাকের শিকার হওয়ার ‘ধৃষ্টতা দেখানোর জন্য’ তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
সিজার জানালেন, ২০ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রে থাকার পরও তিনি বৈধ কাগজপত্র পাননি। এ কারণে তিনি এল সালভাদরে ফিরে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেটা তাঁকে যেতে দিচ্ছে না। সেই ছেলের চোখে এখনো ‘আমেরিকান ড্রিম’ (আমেরিকান স্বপ্ন) লেগে আছে। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি এই তথাকথিত মুক্ত ভূমিতে এখনো পড়ে রয়েছেন।
সিজার যেমন ২০ বছর আগে নিজ জন্মস্থান এল সালভাদর ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিলেন, আমিও ঠিক ২০ বছর আগে আমার জন্মভূমি যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে বিভিন্ন দেশে কাটিয়েছি। জরুরি স্বাস্থ্যসেবার খরচ বাবদ অন্তহীন ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ার ভয়ে ভীত হওয়ার মতো আরও কিছু কারণে আমি যুক্তরাষ্ট্রকে এড়িয়ে চলেছি। তবে ২০২১ সালে আমার মা–বাবা করোনা মহামারির কারণে বার্সেলোনা ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসার পর যুক্তরাষ্ট্রকে এড়িয়ে চলাটা আমার জন্য আগের চেয়ে অনেক বেশি দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পাসপোর্টধারী হিসেবে অবশ্যই আমার অনেক দেশে যেকোনো সময় যেতে পারার সুবিধা আছে। এর মধ্যে এল সালভাদরও আছে, যেখানে সুবিধাপ্রাপ্ত বহিরাগত ধনিক শ্রেণি যতটা আরামে আছে, মার্কিন–সমর্থিত ডানপন্থী রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের কারণে স্থানীয় গরিব মানুষ সেখানে ততটাই অরক্ষিত অবস্থায় আছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ধনে ডানপন্থী শাসকদের অত্যাচারে সালভাদোরান নাগরিকেরা অতিষ্ঠ হওয়ার পরও এবং তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রে আসার পর নারকীয় বাস্তবতার মুখে পড়ার পরও সামগ্রিকভাবে তাদের মধ্যে ‘আমেরিকান ড্রিমের’ মোহ আগের মতোই বজায় আছে।
দারিদ্র্য, গৃহহীনতা, গণহারে ধরে কারাগারে ঢোকানো, নির্বিচার গোলাগুলি, অপরাধের পর্যায়ে পড়ে এমন ব্যয়বহুল স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও হাউজিং সেবার মুখে পড়তে হয় এমন ভূখণ্ডে ‘স্বপ্নের ভূখণ্ডের’ উপাদান খুব কমই আছে।
কোনো ধরনের বৈধ কাগজপত্র নেই—এমন অভিবাসীদের অধিকতর বীভৎস অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। ব্যাপক বৈষম্য, অভিবাসীবিদ্বেষ, অভিবাসনশিবির থেকে অভিবাসনপ্রত্যাশী মা-বাবার কাছ থেকে শিশুদের আলাদা জায়গায় নিয়ে যাওয়া—ইত্যাকার বাস্তবতার মুখে তাদের হেনস্তা হতে হয়।
এত কিছুর পরও বৈশ্বিক কল্পনায় কেন আমেরিকান ড্রিম অমলিন হয়ে আছে? এত কিছুর পরও কেন সবাই আমেরিকান ড্রিমে বিভোর?
নিশ্চিতভাবে বলা যায়, কলম্বিয়া, এল সালভাদর, মেক্সিকো বা অন্য অনেক জায়গায় দুর্দশার মধ্যে জীবন কাটানো স্থানীয় দরিদ্র মানুষ একটি সুখের দুনিয়ার কল্পনায় আচ্ছন্ন থাকে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে মানুষ তার শারীরিক ও আর্থিক অবস্থার সুরক্ষা নিয়ে একটি কল্পনাশ্রয়ী জায়গার কথা ভাবে। সেই জায়গা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রকেই তারা কল্পনায় আনে।
এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যুগে প্রবাহিত মিথ্যা সুখের বিজ্ঞাপন আমেরিকান ড্রিমকে আরও উসকে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে সুস্পষ্টভাবে হতাশাজনক পরিস্থিতির মধ্যে কাটানো সত্ত্বেও আমার কলম্বিয়ান বন্ধুরা আমেরিকায় নিজের উপস্থিতি জানান দেওয়া টিকটক ভিডিও বানিয়ে সেগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করে দেশে থাকা বন্ধুদের কাছে আত্মপ্রচার করতে চান।
২০০৮ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ মুক্তবাজার পুঁজিবাদকে ‘আমেরিকান ড্রিমের মহাসড়ক’ বলে অভিহিত করেছিলেন। ভাষাগত জড়তাসম্পন্ন বুশের কথাটি ব্যাকরণগতভাবে হয়তো সঠিক, কিন্তু বস্তুনিষ্ঠতার দিক থেকে কথাটা সত্য নয়। এই ‘মহাসড়ক’ আসলে একটি ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন।
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত আকারে অনূদিত
● বেলেন ফার্নান্দেজ রাজনৈতিক ধারাভাষ্যকার ও লেখক এবং আল–জাজিরার নিয়মিত কলাম লেখক