নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা টাইমস
বৈধ-অবৈধ বা পাচারকৃত অর্থ গচ্ছিত রাখতে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশের বিত্তশালীরাই সুইস ব্যাংকগুলোকে পছন্দ করেন। পরিসংখ্যান বলছে, বিগত নির্বাচনি বছরগুলোতে অন্য বছরের তুলনায় সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থ জমা রাখার পরিমাণ বাড়ছিল। কিন্তু দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সুইস ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের অর্থ জমার পরিমাণ বৃদ্ধির ধারণা করা হলেও ঘটেছে উল্টো।
এবার নির্বাচনি বছরে সুইস ব্যাংকগুলো থেকে ৯৩ দশমিক ৭ শতাংশ অর্থ তুলে নিয়েছেন বাংলাদেশিরা, যার পরিমাণ সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু এ টাকা বাংলাদেশে আসেনি। তাহলে টাকাগুলো সরানো হলো কোথায়- সে প্রশ্নের উত্তর মেলাতে কাজ করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিটসহ (বিএফআইইউ) একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা।
নির্বাচনি বছরে সুইস ব্যাংকে টাকা জমা রাখার বদলে কেন টাকা সরিয়ে নিচ্ছেন বাংলাদেশিরা? কোথায় সরানো হচ্ছে এসব অর্থ? এ বিষয়ে সুইস ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদনে কিছুই উল্লেখ নেই।
আর সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা অর্থের পরিমাণ একলাফে এক বছরে ৯৪ শতাংশ কমে যাওয়ায় তথ্যটি এমন এক সময়ে এসেছে, যখন দেশে অর্থ পাচারের বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এসেছে।
অর্থনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন, সুইজারল্যান্ডে গোপনীয়তা কমতে থাকায়, অনেক ধনী এখন অবৈধ টাকা জমা রাখার জন্য ঝুঁকছেন, লুক্সেমবার্গ, কেম্যান আইল্যান্ড, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড কিংবা বারমুডার মতো ট্যাক্স হ্যাভেনের দিকে।
হঠাৎ সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে যাওয়ার জন্য দেশের চলমান ডলার সংকটকেও বড় কারণ বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদেরা। তারা বলছেন, দেশে ডলারের সংকট দেখা দেওয়ায় দেশটিতে অর্থ জমার বা বিনিয়োগের সক্ষমতা হারিয়েছে অনেক প্রতিষ্ঠান। আবার অনেক প্রতিষ্ঠান সেখান থেকে অর্থ তুলে নিয়েছে।
এদিকে একাধিক বিশেষজ্ঞ ও গোয়েন্দা সূত্র বলছে, সুইস ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশি নাগরিকদের রাখা অধিকাংশ টাকাই অবৈধভাবে উপার্জিত। প্রতি বছর আমানতের তথ্য প্রকাশ করায় এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা পাচার তদারকি সংস্থাগুলো নজর ও তদারকি বৃদ্ধি করায় সুইস ব্যাংকগুলোকে আগের মতো নিরাপদ মনে করছেন না বাংলাদেশিরা। তারা এখন দুবাইকে নির্ভরশীল মনে করছেন। কেননা- দুবাই পাচারকৃত অর্থ কোনো দেশের অনুরোধে ফেরত দেয় না। দুবাই বা সংযুক্ত আরব আমিরাতে অর্থ পাচারকারীদের তথ্য প্রকাশ করা হয় না। সেখানে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ কর দিয়ে যে কেউ যে কোনো পরিমাণ অর্থ রাখতে পারে। যে কেউ যেকোনো সম্পদের মালিক হতে পারে। দুবাই বা সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রধান নীতি হলো- সেখানে বসে যদি কেউ কোনো অপরাধ না করে তাহলে অন্য দেশের অপরাধের জন্য তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না। ফলে শুধু বাংলাদেশ নয়, বিভিন্ন দেশের লুণ্ঠনকারী, দুর্নীতিবাজ, দুর্বৃত্তদের নিরাপদ স্থানে পরিণত হয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত।
গত বৃহস্পতিবার প্রকাশিত সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের (এসএনবি) বার্ষিক প্রতিবেদন বলছে, ২০২১ সাল শেষে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা হওয়া অর্থের পরিমাণ ছিল ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ। গত বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫ কোটি ৫৩ লাখ সুইস ফ্রাঁতে। বাংলাদেশে সুইস ফ্রাঁর খুব বেশি লেনদেন হয় না। তবে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রতি সুইস ফ্রাঁর বিনিময় মূল্য প্রায় ১২১ টাকা। সেই হিসাবে ৫ কোটি ৫৩ লাখ সুইস ফ্রাঁতে দাঁড়ায় প্রায় ৬৬৯ কোটি টাকা।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে শুধু যে বাংলাদেশিদের অর্থ কমেছে, তা নয়। ভারত, পাকিস্তান, সিঙ্গাপুর, চীন, রাশিয়া, সৌদি আরব, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ জমার পরিমাণও কমেছে। ২০২১ সালে সুইস ব্যাংকে ভারতীয়দের জমা অর্থের পরিমাণ ছিল প্রায় ৩৮৩ কোটি সুইস ফ্রাঁ। গত বছর তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩৪০ কোটি সুইস ফ্রাঁতে। একইভাবে ২০২১ সালে দেশটিতে পাকিস্তানিদের জমা অর্থের পরিমাণ ছিল প্রায় ৭১ কোটি সুইস ফ্রাঁ। গত বছর তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩৯ কোটি সুইস ফ্রাঁতে। আর সৌদি আরবের জমা অর্থের পরিমাণ অর্ধেক হয়ে গেছে এক বছরের ব্যবধানে। ২০২১ সালে সুইজারল্যান্ডে সৌদি আরবের মানুষের জমা অর্থের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৪৫ কোটি সুইস ফ্রাঁ, সেটি গত বছর কমে ৫২১ কোটিতে নেমে এসেছে।
এ ছাড়া ইউরোপের দেশ ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া রাশিয়ার অর্থও কমেছে সুইজারল্যান্ডে। তবে কমার হার সৌদি আরবের চেয়ে কম, সাড়ে ২৮ শতাংশ। ২০২১ সালে সুইজারল্যান্ডে রুশ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের জমা অর্থের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ১৩৭ কোটি সুইস ফ্রাঁ। গত বছর তা কমে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৫২৬ কোটি সুইস ফ্রাঁতে।
এসএনবির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত এই ২২ বছরে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে বাংলাদেশিদের সবচেয়ে কম অর্থ ছিল ২০০৩ সালে। ওই বছর দেশটির ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা অর্থের পরিমাণ ছিল মাত্র আড়াই কোটি সুইস ফ্রাঁ। এরপর দেশটিতে বাংলাদেশিদের সর্বোচ্চ পরিমাণ অর্থ জমা হয়েছিল ২০২১ সালে, ৮৭ কোটি সুইস ফ্রাঁর বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের যেসব অর্থ জমা রয়েছে, সেগুলো যে সব পাচারের অর্থ, তা বলা যাবে না। কারণ, সুইজারল্যান্ড ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারীরাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী বাংলাদেশিরা বৈধভাবেও দেশটিতে অর্থ জমা রাখেন। ব্যক্তির পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিকভাবেও অর্থ জমা রাখা হয় দেশটির বিভিন্ন ব্যাংকে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, নানা কারণে সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, সিঙ্গাপুর ইত্যাদি দেশ এখন পাচার করা অর্থ রাখার জন্য নিরাপদ জায়গা বলে বিবেচিত হচ্ছে না। কারণ আন্তর্জাতিক অর্থ পাচার তদারকি এবং তদন্ত এখন আগের চেয়ে অনেক জোরদার হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশগুলো একটি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে অর্থ পাচার রোধ করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশ থেকে যারা অর্থ পাচারকারী তাদেরকেও নানাভাবে চিহ্নিত করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।
আরেকটি কারণ হলো, সামনে নির্বাচন। নির্বাচনকে ঘিরে অনিশ্চয়তার মধ্যে যদি ক্ষমতার পট পরিবর্তন হয় তাহলে যে দেশগুলোতে পাচারকৃত অর্থের দিকে নজর যাবে তার মধ্যে অন্যতম হলো সুইস ব্যাংকগুলো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতি এবং অন্যান্য পদক্ষেপের কারণে ইতিমধ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকেও পাচারকারীরা অর্থ সরাতে শুরু করেছে। কিন্তু এসব অর্থ সরিয়ে বাংলাদেশে নিয়ে আসছেন না। বাংলাদেশে টাকা আসার পরিমাণ খুবই কম। দু মাস আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে বেশকিছু অর্থ আসছিল। কিন্তু এ নিয়ে আলোচনার পর এখন সেটিও বন্ধ হয়ে গেছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সুইস ব্যাংকের টাকাগুলো মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যাচ্ছে বলে তাদের আপাতত মনে হচ্ছে। দুবাই এখন অর্থপাচারের বড় হাব হয়েছে। বিভিন্ন ব্যক্তি অর্থ পাচার করে, অর্থ সম্পদ লুট করে দুর্নীতি করে এখন টাকা রাখা নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে বিবেচনা করছেন দুবাইতে। তাদের ভাষ্য, গত কয়েক বছর ধরে দুবাইয়ে সম্পদশালীদের অর্থপাচারের প্রবণতা এবং ঝোঁক বেড়েছে। তারা কথায় কথায় দুবাই যাচ্ছেন এবং দুবাইতে দোকানপাট, শপিং মল, আবাসন খাতে বিপুল পরিমাণ বাংলাদেশিদের বিনিয়োগ হচ্ছে। নানা কারণেই সুইস ব্যাংক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডার চেয়ে দুবাইয়ে টাকা রাখা সুবিধাজনক হচ্ছে।
অন্যদিকে সুইস ব্যাংকগুলোতে গচ্ছিত অর্থ নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে নানারকম লেখালেখি হয়। আন্তর্জাতিক মুদ্রা পাচার তদারকি সংস্থাগুলো সুইস ব্যাংক বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অর্থপাচার গভীরভাবে মনিটরিং করে। এ কারণেই এখন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো পাচারকারীদের নতুন ঠিকানা হয়েছে।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘দেশে ডলার সংকট দেখা দেওয়ায় হয়তো এসব প্রতিষ্ঠান সেখান থেকে অর্থ তুলে নিয়েছে বা নতুন করে অর্থ জমা রাখতে পারেনি। এ ছাড়া হয়তো পাচারের কিছু অর্থ দেশটি থেকে সরিয়ে নিয়েছেন কেউ কেউ।
তিনি আরও বলেন, যেহেতু বিশ্বজুড়ে একধরনের অর্থনৈতিক চাপ তৈরি হয়েছে, তাই হয়তো বৈধভাবে যারা সেখানে অর্থ জমা রাখতেন, তাদের সঞ্চয়ের সক্ষমতা কমে গেছে। তাই সার্বিকভাবে হয়তো বাংলাদেশিদের অর্থের পরিমাণ কমেছে দেশটিতে।
প্রসঙ্গত, আন্তর্জাতিক ৬টি সংস্থার রিপোর্টে বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচারের তথ্য আসছে। এগুলো হলো-যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই), সুইস ব্যাংক, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম (আইসিআইজে), পানামা প্যারাডাইস ও পেনডোরা পেপারস, জাতিসংঘের উন্নয়ন প্রোগ্রামের (ইউএনডিপি) রিপোর্ট এবং মালয়েশিয়া প্রকাশিত সেদেশের সেকেন্ড হোম রিপোর্ট।
এছাড়াও সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও সিঙ্গাপুরে বেশকিছু বাংলাদেশির অর্থ পাচারের তথ্য মিলেছে। গত বছর ডিসেম্বরে প্রকাশিত জিএফআইর প্রতিবেদনে বলা হয়, ৬ বছরে দেশ থেকে ৪ হাজার ৯৬৫ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। প্রতি ডলার ১১২ টাকা হিসাবে স্থানীয় মুদ্রায় ৫ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। গড়ে প্রতিবছর পাচার হচ্ছে প্রায় ৯৩ হাজার কোটি টাকা।