বাংলাদেশে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণ ব্যয় এত বেশি কেন

bonikbarta.net

আবু তাহের

একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করতে গিয়ে খরচ হওয়া স্থায়ী ও দীর্ঘমেয়াদি ব্যয়গুলোকে ধরা হয় কেন্দ্রটির মূলধনি ব্যয় হিসেবে। এর মধ্যে রয়েছে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণ ব্যয়, ভূমি অধিগ্রহণ ব্যয়, গ্রিডে সংযুক্তির খরচ, প্রাথমিক অর্থায়ন খরচ ইত্যাদি। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, কিলোওয়াটপ্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা তৈরি করতে গিয়ে ব্যয় হওয়া মূলধনি খরচ সবচেয়ে বেশি হয় বাংলাদেশে।

দেড় দশক আগেও দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট। বর্তমানে এ সক্ষমতা দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার ৩৬১ মেগাওয়াটে (ক্যাপটিভ বাদে)। এ অনুযায়ী, গত দেড় দশকে বিদ্যুৎ খাতের সক্ষমতা বেড়েছে ১৯ হাজার ৪১৯ মেগাওয়াট বা প্রায় চারশ শতাংশ। ২০২৫ সালের মধ্যে কমিশনিংয়ের জন্য পাইপলাইনে আছে আরো প্রায় পাঁচ হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্র। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ও বিশেষজ্ঞদের হিসাব অনুযায়ী, এ সক্ষমতা অর্জন করতে গত দেড় দশকে অন্তত ৩৫ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে বাংলাদেশকে। যদিও দেশী-বিদেশী বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মূলধনি ব্যয় বিশ্লেষণের ভিত্তিতে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এ ব্যয় সমসক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণ ব্যয়ের বৈশ্বিক গড়ের চেয়ে অন্তত ৫-৭ বিলিয়ন ডলার বেশি।

যুক্তরাজ্যের কার্ডিফ ইউনিভার্সিটির স্কুল অব ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের দুই গবেষক কুমার বিশ্বজিৎ দেবনাথ ও মঞ্জুর মোরশেদ বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে বিগত দশকের মূলধনি ব্যয় নিয়ে এক গবেষণা করেন। আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থার (আইইএ) ২০১৫ সালের এবং বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) তথ্যের ভিত্তিতে করা ওই গবেষণায় উঠে আসে, দেশের জ্বালানি তেল, কয়লা, প্রাকৃতিক গ্যাস ও পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর কিলোওয়াটপ্রতি মূলধনি ব্যয় বৈশ্বিক গড়ের চেয়ে অনেক বেশি। গ্যাস টারবাইন প্রযুক্তিতে চালিত প্রাকৃতিক গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কিলোওয়াটপ্রতি মূলধনি ব্যয়ের বৈশ্বিক গড় ৫৫১ ডলার। বাংলাদেশে সরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর ক্ষেত্রে এর পরিমাণ দ্বিগুণেরও বেশি—১ হাজার ১৭৭ ডলার। আর বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর কিলোওয়াটপ্রতি মূলধনি ব্যয় ৮১৯ ডলার।

তাদের এ গবেষণার ফলাফল স্প্রিঙ্গারে ২০১৮ সালে ‘‌করাপশন সিগনিফিক্যান্টলি ইনক্রিয়েজেস দ্য ক্যাপিটাল কস্ট অব পাওয়ার প্লান্টস ইন ডেভেলপিং কনটেক্সটস’ শিরোনামে প্রকাশ হয়। তাদের এ গবেষণায় আরো দেখানো হয়, বাংলাদেশে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সক্ষমতা বাড়াতে গিয়ে খাতটিতে দুর্নীতির মাত্রা বেড়েছে।

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) ২০২১-২২ অর্থবছরের হিসাব অনুযায়ী, দেশে গ্যাস টারবাইনচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সক্ষমতা ১ হাজার ৫০২ মেগাওয়াট। বৈশ্বিক গড় হিসাবে সমান সক্ষমতার ও একই প্রযুক্তির বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মোট মূলধনি ব্যয় হওয়ার কথা ৮২ কোটি ৭৬ লাখ ডলার। সেখানে বাংলাদেশে দেড় হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে মোট মূলধনি ব্যয় হয়েছে ১২৩ কোটি ১ লাখ থেকে ১৭৬ কোটি ৭৮ লাখ ৫৪ হাজার ডলার।

জ্বালানি তেল ও গ্যাসে উভয় জ্বালানিভিত্তিক কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্লান্টের ক্ষেত্রে মূলধনি ব্যয়ের গড় বিশ্বব্যাপী প্রতি কিলোওয়াটে ৯৭৪ ডলার। বাংলাদেশের সরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে তা ১ হাজার ১৬৪ ডলার। যদিও কখনো কখনো তা কিলোওয়াটে ৩ হাজার ৫ ডলারে ওঠার রেকর্ডও আছে। এ প্রযুক্তির জ্বালানি তেলভিত্তিক বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্ষেত্রে এ ব্যয় কিলোওয়াটপ্রতি ৭০৪ ডলার। দেশে বর্তমানে কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্লান্টের সক্ষমতা রয়েছে ৭ হাজার ৯৬৩ মেগাওয়াট। কিলোওয়াটপ্রতি বৈশ্বিক মূলধনি গড় ৯৭৪ ডলার হিসাব করলে এ সক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে মোট ব্যয় হওয়ার কথা প্রায় ৭৭৫ কোটি ৬০ লাখ ডলার। যদিও বাংলাদেশের কম্বাইন্ড সাইকেল প্রযুক্তির সরকারি-বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মোট মূলধনি ব্যয় কমপক্ষে ৭৫০ কোটি থেকে ৯২৬ কোটি ৮৯ লাখ ডলার।

দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে আট্রা-সুপারক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করেছে সরকার। বর্তমানে এ প্রযুক্তির প্রায় ২ হাজার মেগাওয়াট (১ হাজার ৯৮০) সক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্র চলমান রয়েছে। উৎপাদনের অপেক্ষায় রয়েছে আরো সাড়ে চার হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্র।

আল্ট্রা-সুপারক্রিটিক্যালের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী কিলোওয়াটপ্রতি গড় মূলধনি ব্যয় ১ হাজার ৬০০ ডলার। বাংলাদেশে তা কিলোওয়াটে ৩ হাজার ৩৪৩ ডলার। বৈশ্বিক গড় হিসাব করলে এ সক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মোট মূলধনি ব্যয় হওয়ার কথা ৩১৬ কোটি ৮০ লাখ ডলারে। বর্তমানে চালু থাকা ১ হাজার ৯৮০ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে মূলধনি ব্যয়ের পরিমাণ প্রায় ৬৬২ কোটি ডলার।

জাপানের অর্থায়নে বাংলাদেশে নির্মাণ হচ্ছে মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। আল্ট্রা-সুপারক্রিটিক্যাল এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রতি কিলোওয়াট সক্ষমতা অর্জন করতে মূলধনি ব্যয় হয়েছে চীনে নির্মাণাধীন বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর তুলনায় আট-দশ গুণ। জ্বালানি খাতের গবেষণা সংস্থা মার্কিন ‘ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালিস্টসের’ (আইইইএফএ) গত বছরের জুনে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে সংস্থাটি জানায়, এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে ব্যয়বহুল কয়লাচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে এ প্রকল্প। ‘‌জাপান ফান্ডেড মাতারবাড়ী কোল প্লান্ট ইন বাংলাদেশ কস্টস ৮ টু ১০ টাইমস মোর দ্যান কমপেয়ারেবল প্লান্টস ইন চায়না’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ধারাবাহিকভাবে মূল্যবৃদ্ধি এবং প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি করার কারণে এশিয়ায় কয়লাচালিত বিদ্যুতের সবচেয়ে বেশি ব্যয়বহুল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে মাতারবাড়ী।

আইইইএফএর হিসাব অনুযায়ী, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্রে প্রতি গিগাওয়াট সক্ষমতা অর্জনে মূলধনি ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৩৯০ কোটি ডলারে। সে অনুযায়ী, প্রতি কিলোওয়াট (১ গিগাওয়াট=১০ লাখ কিলোওয়াট) সক্ষমতা অর্জনে মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মূলধনি ব্যয় করতে হয়েছে ৩ হাজার ৯০০ ডলার।

সাবক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের গড় মূলধনি ব্যয় বিশ্বব্যাপী প্রতি কিলোওয়াটে ১ হাজার ৩৯৪ ডলার। বাংলাদেশে তা কিলোওয়াটে ১ হাজার ৫৮৪ ডলার।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে গিয়ে আমরা কখনো এককভাবে, কখনো জয়েন্ট ভেঞ্চারে গিয়েছি। এসব অবকাঠামো করতে গিয়ে এ খাতে বিদেশী বিনিয়োগ হিসেবে আমরা অনেক ঋণ নিয়েছি। বাংলাদেশে শুধু যে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মূলধনি ব্যয় অনেক বেশি করা হয়েছে তা নয়, ভুল জ্বালানি পরিকল্পনার কারণেও এসব বিনিয়োগ বর্তমানে দেশের অর্থনীতির ওপর বড় ধরনের বোঝা হয়ে রয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জ জানা সত্ত্বেও মধ্যম মেয়াদি যে পরিকল্পনার প্রয়োজন ছিল, সেটি করা হয়নি। তার খেসারত হিসেবে আমরা ডলার সংকটে পড়েছি।’

দেশে পাবনার রূপপুরে নির্মাণ হচ্ছে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এটি নির্মাণ করছে রুশ প্রতিষ্ঠান রোসাটম। ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের কুদানকুলামে কাছাকাছি সক্ষমতার আরেকটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করছে প্রতিষ্ঠানটি। নির্মাতা এক হলেও বাংলাদেশে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে প্রতি কিলোওয়াট/ঘণ্টা উৎপাদন ব্যয়ের প্রাক্কলন করা কুদানকুলামের চেয়ে প্রায় ৭৫ শতাংশ বেশি।

পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মূলধনি ব্যয়ের একটি অংশ হলো ওভারনাইট কস্ট। নির্মাণ খরচ, পদ্ধতিগত খরচ, মালপত্র কেনার খরচ, প্রকৌশলসংক্রান্ত খরচ, প্রথম জ্বালানির জোগান এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ (সুদ ছাড়া) যোগ করে এটি হিসাব করা হয়। বিশ্ব পরমাণু সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, যাবতীয় সুদ বাদ দিয়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে কিলোওয়াটপ্রতি মূলধনি ব্যয়ের পরিমাণ ৫ হাজার ৮৩০ ডলার। ভারতে নির্মীয়মাণ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কিলোওয়াটপ্রতি মূলধনি ব্যয়ের পরিমাণ ১ হাজার ৬২৫ ডলার।

সরকারের বিদ্যুৎ বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, দেশে বিদ্যুৎ খাতের সক্ষমতা বাড়াতে গত ১৪ বছরে এ খাতে ২৮ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ হয়েছে। ২০১০ থেকে ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত এই বিনিয়োগ হয়েছে। এর মধ্যে বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ৯ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ হয়েছে।

বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে বৈশ্বিক মূলধনি ব্যয় বিবেচনায় নিলে এ অর্থের পরিমাণ অনেক বেশি। মূলত বিভিন্ন বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণের লক্ষ্যে নেয়া এ ঋণ সুদে-আসলে পরিশোধ এবং এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালনা করতে গিয়ে জ্বালানি আমদানি করতে গিয়ে দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা খরচ হয়ে গিয়েছে।

গত এক দশকে দেশে বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সক্ষমতা বেড়েছে ৯ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে মূলধনি ব্যয় যে পরিমাণ হওয়ার কথা ছিল, তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি হয়েছে বলে বিভিন্ন গবেষণা ও বিশেষজ্ঞদের বক্তব্যে উঠে এসেছে।

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি বিদ্যুৎ খাতের এক উদ্যোক্তা নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌বৈশ্বিক মূলধনি ব্যয় আর বাংলাদেশে মূলধনি ব্যয়ের বিষয়টি ভিন্ন হবে। বিশেষত এখানে ভূমি উন্নয়ন, জমির মূল্য এবং বিদ্যুৎ কেন্দ্র যন্ত্রপাতি আমদানিতেই ব্যয়ের অনেক পার্থক্য হবে। তাছাড়া বিশ্বব্যাপী বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মূলধনি ব্যয়ে জমি ছাড়া মূলত বাকি খরচকে হিসাব করা হয়।’

গত এক দশকে বিদ্যুৎ খাতে বিদেশী ঋণ এসেছে বিপুল পরিমাণে। সরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে নেয়া হয়েছে বেশির ভাগ ঋণ। যেমন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে ১১ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ এসেছে রাশিয়া থেকে। পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে ২ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ নেয়া হয়েছে চীন থেকে। আর রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার ঋণসহায়তা ভারত থেকে নেয়া হয়েছে। এছাড়া মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ অন্যান্য প্রকল্প ঘিরে জাপান থেকে ৪৩ হাজার ৯২১ কোটি টাকা মূল্যের ঋণসহায়তা নেয়া হচ্ছে।

পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক বিডি রহমত উল্লাহ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে গিয়ে শুরুতেই রেন্টাল-কুইক রেন্টাল অনুমোদন দেয়া হয়েছে। বিশেষ আইনের আওতায় এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অনেকগুলোর সঙ্গেই বিদ্যুতের ক্রয় চুক্তি ছিল ডলারে। ফলে ডলার রেটে বিদ্যুতের দাম পরিশোধ করতে হচ্ছে। একই সঙ্গে সক্ষমতা বাড়াতে গিয়ে বিদেশী ঋণ নিয়ে সেই ঋণের সুদ পরিশোধ করতে হয়েছে ডলারে। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের ফলে এখানেও বিভিন্ন সময়ে বড় অংকের আর্থিক ঘাটতি তৈরি হয়েছে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষে দেশের সরকারি-বেসরকারি খাতে বিদেশী ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৬ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ৭১ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছে সরকার ও সরকারি সংস্থা। বিভিন্ন দেশ ও বহুজাতিক সংস্থা থেকে নেয়া ঋণের উল্লেখযোগ্য অংশ সরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিনিয়োগ হয়েছে। বাকি ২৪ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছে দেশের বেসরকারি খাত। ব্যক্তি খাতের উদ্যোক্তাদের নেয়া ঋণের মধ্যে ৪ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলারও বিদ্যুৎ খাতে গিয়েছে।

বিদ্যুতের অতিরিক্ত সক্ষমতা বাড়ানোর ফলে এ খাতে অর্থ ও ডলার সংকট তৈরি হয়েছে এমনটি মনে করছে না বিদ্যুৎ খাতের নীতি ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেল। সংস্থাটির মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌আমরা বিদ্যুতের যে সক্ষমতা বাড়িয়েছি, সেগুলোর বেশির ভাগই হলো প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ, ঠিক ঋণ নয়। বিদেশীরা বা যারা বিদ্যুৎ কেন্দ্র বানিয়েছে, তারা তাদের অর্থে বানিয়েছে। আমরা শুধু তাদের বিদ্যুৎ কিনে নিই। সেই কেনা বিদ্যুতের পেমেন্ট আমাদের করতে হয়, কিন্তু ঋণের পেমেন্ট আমাদের করতে হয় না। এক্ষেত্রে কিছু ডলারের বিষয় আছে। সেটা লাগবেই। সাংবিধানিক দায়িত্ব হলো বিদ্যুৎ দিতে হবে, সেটা ডলার বা টাকা যা দিয়েই কিনি না কেন। বিদ্যুতের অতিরিক্ত সক্ষমতা যে শুধু আমাদের দেশেই আছে, এমনটি নয়। বিদেশেও রয়েছে। সেখানেও ক্যাপাসিটি রিজার্ভ থাকে। তবে এই মার্জিন দেশভেদে ভিন্ন। আমরা কেন বেশি রেখেছি, কারণ আমাদের গ্যাসের স্বল্পতা আছে। তেল, কয়লা আমাদের আমদানি করতে হয়। একক জ্বালানিনির্ভরতার কারণে আমাদের সিস্টেম যেন ধসে না পড়ে। যেমন জার্মানিতে একসময় শতভাগ রিজার্ভ মার্জিন রাখতে হয়েছে। আমাদের রিজার্ভ মার্জিন ২০-৩০ শতাংশ। ভারতে এখন ৭০ শতাংশ রিজার্ভ মার্জিন।’

সক্ষমতা বাড়াতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত বিনিয়োগ করতে হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, ‘‌কোনোভাবেই অতিরিক্ত বিনিয়োগ হয়নি। যতটুকু হয়েছে, সেজন্য আমরা বরং রক্ষা পেয়েছি। আজকে পায়রা বন্ধ হয়ে ৬০০ মেগাওয়াট গ্রিড থেকে আউট হয়ে যাওয়ার কথা এবং লোডশেডিং আরো মারাত্মক হওয়ার কথা। কিন্তু সেটা হয়নি। আমাদের ডাইভারসিফিকেশন ছিল বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। আমি মনে করে বিনিয়োগ যেটা হয়েছে, সেটা দরকার ছিল।’