১০ মে ২০২৩
আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে ব্যয় কিছুটা কমলেও ডলারের সংকট না কমে উল্টো বাড়ছে। আবার আমদানি ব্যয় মেটাতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে চলতি অর্থবছরে রেকর্ড ১২ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে টান পড়েছে। এর মধ্যে রপ্তানি আয় সাড়ে ১৬ শতাংশ ও রেমিট্যান্স প্রায় ১৭ শতাংশ কমায় এ চাপ আরও বাড়ছে। ফলে রিজার্ভের ওপর চাপ আরও বাড়বে। সব মিলিয়ে বিদেশি ঋণ পরিশোধ নিয়ে দুশ্চিন্তা ক্রমেই বাড়ছে। এর মাঝে গত কয়েক বছরে চীন, রাশিয়া ও ভারতের কাছ থেকে নেয়া কঠিন শর্তের ঋণ এ দুশ্চিন্তাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ ও স্থিতি গত কয়েক বছর ধরে দ্রুত বাড়ছে। সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতেই এ ঋণ বাড়ছে। গত দুই অর্থবছর (২০২০-২১ ও ২০২১-২২) দেশে বৈদেশিক ঋণ রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এক দশকে বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে ২২৭ শতাংশ।
বৈদেশিক ঋণ দ্রুত বাড়ায় দক্ষিণ এশিয়ার দুই দেশ পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা বিপদে পড়েছে। যদিও বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে বিপদে নয়; তবে একেবারে ঝুঁকিমুক্ত নয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ ছাড়া রপ্তানি আয় এবং রেমিট্যান্স কমেছে। এ দুই খাতে আয় কমায় বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের চাপ বাড়ছে। একই সঙ্গে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়া এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আরও কমছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, আগে বাংলাদেশ যে বৈদেশিক ঋণ করেছিল তা সাধ্যের মধ্যে ছিল বিধায় পরিশোধে সমস্যা হয়নি। কিন্তু সম্প্রতি মেগা ঋণ করে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে মেগা সংকটের মুখোমুখি হয়ে পড়ছে দেশ।
এদিকে চলতি মাসেই এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) মার্চ-এপ্রিল সময়ের ১.১৮ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া সরকার তেল, গ্যাস ও কয়লা আমদানি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার খরচ বাড়বে। মঙ্গলবার রিজার্ভ ৩ হাজার ৯৬ কোটি ডলারে নেমে এসেছে। আকু বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ ৩০ বিলিয়নের নিচে নেমে আসবে। এর আগে ২০১৫-১৬ অর্থবছর শেষে রিজার্ভ ছিল ৩০.৩৫ বিলিয়ন ডলার। সব মিলিয়ে রিজার্ভের ওপর চাপ আরও বাড়বে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করা হয় আমদানি চাহিদা মেটানোর জন্য। ব্যাংকগুলোকে যাচাই-বাছাই করেই ডলার দেয়া হয়। দেশের রিজার্ভ বাড়া-কমার মধ্যে থাকবে, এটা একটা স্বাভাবিক ঘটনা। তেমনই মে মাসে আকু পেমেন্টও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি রুটিন কাজ। এটি নিয়ে আলাদা করে আলোচনার কিছু নেই।
বৈদেশিক ঋণ ৯ হাজার ৬২৫ কোটি ডলার
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, বেশ কয়েক মাস ধরে লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) খোলা সীমিত করেছে সরকার। এতে আমদানিতে ডলার ব্যয় এবং ঋণ নেয়ার হার কমেছে। কিন্তু তাতেও বিদেশি ঋণের লাগাম টানা যাচ্ছে না। বরং গত এক বছরের ব্যবধানে বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে ৬০০ কোটি বা ৬ বিলিয়ন ডলার। এতে বিদেশি ঋণ বেড়ে ৯ হাজার ৬২৫ কোটি বা ৯৬.২৫ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে, যা গত এক বছর আগেও ছিল ৯ হাজার ৭৯ কোটি ডলার (৯০.৭৯ বিলিয়ন)। বিপুল অঙ্কের এ বৈদেশিক ঋণের মধ্যে ৭১.৯৪ বিলিয়ন বা ৭৪ শতাংশ সরকারের, বাকি ২৬ শতাংশ বা ২৪.৩১ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছে দেশের বেসরকারি খাত। তবে এই বছর শেষে বিদেশি ঋণের পরিমাণ ১১৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়াবে। আর ২০২৪ সাল শেষে এর পরিমাণ দাঁড়াবে ১৩০ বিলিয়ন ডলারে।
তথ্যমতে, মোট বিদেশি ঋণের মধ্যে সরকারের নেয়া ঋণের পরিমাণ ৭ হাজার ১৯৪ কোটি ডলার। বাকি ২ হাজার ৪৩১ কোটি ডলার ঋণ গেছে বেসরকারি খাতে। বেসরকারি খাতের বাণিজ্যিক ঋণের বেশির ভাগই বায়ার্স ক্রেডিট, যা এক বছরের মধ্যে শোধ করতে হয়। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে জানা গেছে, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে সব মিলিয়ে ২৭৮ কোটি ডলার পরিশোধ করতে হবে। এর মধ্যে অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে ১১২ কোটি ডলার ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে।
ঋণ পরিশোধ করতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে লাগবে ৪০২ কোটি ডলার। আর ২০২৯-৩০ অর্থবছরে ঋণ পরিশোধে সর্বোচ্চ ৫১৫ কোটি ডলার খরচ হবে। এর আগে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মাত্র ১১৭ কোটি ডলার বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছিল সরকারকে। এরপর প্রতিবছরই তা বেড়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে যার পরিমাণ ছিল ২০১ কোটি ডলার। এর মধ্যদিয়ে গত অর্থবছরে প্রথমবারের মতো বার্ষিক ঋণ পরিশোধ ২০০ কোটি ডলার ছাড়ায়।
জানা গেছে, গত এক দশকে রাশিয়া, চীন ও ভারতের কাছ থেকে সব মিলিয়ে ৩ হাজার ৬২৮ কোটি ডলার ঋণ নেয়ার চুক্তি হয়েছে। এর মধ্যে চীনের ১২ প্রকল্পে ১ হাজার ৭৫৪ কোটি ডলার, রাশিয়া রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ১ হাজার ১৩৮ কোটি ডলার এবং ভারত তিনটি লাইন অব ক্রেডিটে (এলওসি) ৭৩৬ কোটি ডলার দিচ্ছে। তবে ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট জটিলতায় রূপপুর প্রকল্পের ঋণের অর্থ পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে এ দুটি ঋণের আসল ও সুদ বাবদ ৩৩০ মিলিয়ন ডলার অপরিশোধিত রয়ে গেছে, জানিয়েছে ইআরডি। যদিও বিশ্বব্যাংক, এডিবি’র ঋণ পরিশোধের জন্য সময় পাওয়া যায় ৩২ থেকে ৩৫ বছর। কিন্তু গ্রেস পিরিয়ডের পর চীন ও ভারতের ঋণ পরিশোধ করতে হবে ১৫ থেকে ২০ বছরে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, সামনে একটা চাপ আছে। কারণ আগামী জুনের মধ্যে বর্তমান ঋণ পরিশোধ করতে হবে। অথবা ঋণগুলো নবায়ন করতে হবে। না হলে সবগুলো একসঙ্গে পরিশোধ করতে হবে। তখন বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে একটা চাপ তৈরি হবে।
কিছুদিন আগে ‘বাংলাদেশের বৃহৎ বিশটি মেগা প্রকল্প: প্রবণতা ও পরিস্থিতি’ শীর্ষক এক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে সিপিডি বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, চলমান অর্থনৈতিক সংকটের মাঝেই চলতি বছর থেকেই কিছু বড় প্রকল্পের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের ধাক্কা শুরু হচ্ছে। এটি দিন দিন বাড়তেই থাকবে। ২০২৭ সালে গিয়ে সেটি সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাবে। তাই সতর্ক না হলে অর্থনৈতিক বিপর্যয় আসার আশঙ্কা আছে।
উল্লেখ্য, দেশে চলমান ২০টি মেগা প্রকল্পের মোট ব্যয় ৭০ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ৪৩ বিলিয়ন ডলার বিদেশি ঋণ। প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নে যে হার, তাতে অনেকগুলো ২০৩০ সালেও সম্পন্ন হবে না। কিন্তু ২০২৪ সাল থেকেই এসব প্রকল্পের বিদেশি ঋণ পরিশোধ শুরু করতে হবে। প্রথম চাপটা আসবে চীন থেকে। এরপর রাশিয়া এবং তারপর জাপান। এখন থেকে প্রস্তুতি না নিলে অর্থনৈতিক বিপর্যয় আসার আশঙ্কা আছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের তথ্য বিশ্লেষণ মতে, বাংলাদেশের ২০২০-২১ সালের তুলনায় ২০২১-২২ অর্থবছরে মাথাপিছু বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ৪ হাজার ২৭১ টাকা থেকে বেড়ে ৫ হাজার ৬৮২ টাকা হয়েছে। অর্থাৎ এক বছরে মাথাপিছু ঋণ বেড়েছে ১ হাজার ৪১১ টাকা।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রতিবেদন মতে, বর্তমানে বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা সব মিলিয়ে বাংলাদেশের কাছে ৭ হাজার ২২৯ কোটি ডলার পায়। অর্থাৎ এই পরিমাণ অর্থ বিদেশিদের কাছে বাংলাদেশের ঋণ আছে। সংস্থাটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ’র মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছ থেকে বাংলাদেশের ঋণের পরিমাণ ৩ হাজার ৪৯০ কোটি ডলার। অন্যদিকে দ্বিপক্ষীয় বা বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ১৬৭ কোটি ডলার।