মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয়: করোনার দুই বছরে বেতন-ভাতা ছাড়াই ৯০ কোটি টাকা ব্যয়

 

 

ইত্তেফাক রিপোর্ট

২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

https://www.ittefaq.com.bd/632720

অনিয়ম-দুর্নীতি পিছু ছাড়ছে না রাজধানীর মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ থেকে। এই অনিয়ম ও দুর্নীতিতে প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষের পাশাপাশি জড়িত রয়েছে গভর্নিং বডিও। প্রতিষ্ঠানটিকে প্রতি বছরের শুরুতে জানুয়ারি মাসের টিউশন ফি, ভর্তি ও সেশনচার্জ বাবদ এককালীন ওঠে ৪০ কোটি টাকা। এর বাইরে প্রতি মাসে টিউশন ফি বাবদ ওঠে প্রায় ৭ কোটি টাকা। সেই হিসাবে প্রতি বছর প্রতিষ্ঠানটির আয় প্রায় ১১৭ কোটি টাকা। এত আয়ই প্রতিষ্ঠানটির জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। নজর পড়েছে স্থানীয়দের, গভর্নিং বডির

দৈনিক ইত্তেফাকের সর্বশেষ খবর পেতে Google News অনুসরণ করুন

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর, ঢাকা বোর্ড এবং পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের পৃথক তিনটি তদন্তে প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ ও গভর্নিং বডির দুর্নীতির চিত্র উঠে আসে। এসব তদন্তে অধ্যক্ষের নিয়োগও অবৈধ বলে প্রমাণিত হয়। কিন্তু ব্যবস্থা নিতে পারছে না মন্ত্রণালয়। যদিও বিষয়টি এখন আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে।

২০২০ সালে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) তদন্তে এই প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ পদে মো. ফরহাদ হোসেনের নিয়োগ অবৈধ প্রমাণিত হয়েছিল। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। গত বছরের শেষ দিকে ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের তদন্ত কমিটিও বলল, অধ্যক্ষ পদে ফরহাদ হোসেনের চাকরির মেয়াদ বৃদ্ধি বিধিসম্মত হয়নি। অর্থাৎ তার নিয়োগটি অবৈধ। অধ্যক্ষকে অপসরণের জন্য ঢাকা শিক্ষাবোর্ড চিঠি দিলে সে চিঠি নিয়েই উচ্চ আদালতে মামলা করেছেন ঐ অধ্যক্ষ। এরই মধ্যে শিক্ষামন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের এক তদন্তে প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ ও গভর্নিং বডির বিরুদ্ধে বেপরোয়া অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ মেলে।

প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও অভিভাবকরা বলছেন, একজন অধ্যক্ষ ও গভর্নিং বডির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আর কত প্রমাণ লাগবে।

পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের তদন্তে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটির গভর্নিং বডি একটি গত সাত বছরে নিয়েছে ১ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে ২০১৬  সালে ৭৫ লাখ ২২ হাজার, ২০১৭ সালে ৯ লাখ ৫৮ হাজার ২০১৮ সালে ৩৪ লাখ ২০ হাজার, ২০১৯ সালে ২০ লাখ ৯১ হাজার,  ২০২০ সালে ১১ লাখ ১৬ হাজার, ২০২১ সালে ২ লাখ ৬০ হাজার, ২০২২ সালে ৫০ হাজার টাকা নেয় গভর্নিং বডি। এত টাকা নেওয়া হলেও কর কর্তন করা হয়নি।

তদন্ত কমিটি বলছে, গভর্নিং বডির সম্মানি নেওয়ার বিষয়টি গভর্নিং বডির বিধিমালায় উল্লেখ নেই। তাই সম্মানির অর্থ প্রতিষ্ঠানের ফান্ডে ফেরত দেওয়ার পক্ষে মত দেয় কমিটি।

কমিটির তদন্তে দেখা গেছে, কয়েক বছরের বিজ্ঞাপন বাবদ প্রতিষ্ঠানটি ২০১৬ সালে ৬৫ লাখ, ২০১৭ সালে ৭৪ লাখ , ২০১৮ সালে ৭২ লাখ টাকা, ২০১৯ সালে ৮৪ লাখ ব্যয় করেছে। এত বিজ্ঞাপনের টাকা কোথায় ব্যয় করেছে—তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রতি বছরই নির্মাণ, আসবাবপত্র, পুরস্কার ক্রয়, বিজ্ঞাপন, আপ্যায়ন বাবদ কোটি কোটি টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে।  সফটওয়্যার রক্ষণাবেক্ষণে ২০১৬ সালে ২৯ লাখ ৬১ হাজার, ২০১৮ সালে ৪৪ লাখ ২৯ হাজার টাকা খরচ করেছে। এভাবে প্রায় প্রতি বছরই এ খাতে ব্যয় করেছে প্রতিষ্ঠানটি।

করোনা সংক্রমণের কারণে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। করোনা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলে দীর্ঘ ১৮ মাস পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হয়। যদিও শ্রেণি কার্যক্রম চলছিল স্বল্প পরিসরে। সব শ্রেণির ক্লাস সব দিন হচ্ছিল না। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে স্কুল পুরোপুরি খুলে দেওয়া হয়। প্রায় দুই বছর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও ঐ বছরগুলোতে শিক্ষকদের বেতন ভাতা বাবদ প্রায় ৯০ কোটি টাকা ব্যয় দেখিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

২০২০ সালে শিক্ষকদের বেতন ভাতা ছাড়াই বিভিন্ন খাতে ৪০ কোটি টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে, যা অবিশ্বাস্য। ওই বছরে জ্বালানি ব্যয় দেখানো হয়েছে ৭ লাখ ২১ হাজার টাকা। অনুষ্ঠানের খরচ দেখানো হয়েছে ৯৫ লাখ টাকা, বিজ্ঞাপন ৬৫ লাখ, মেরামত ৮৮ লাখ ৬৮ হাজার, প্রিন্টিং ও স্টেশনারি ৯৪ লাখ ৫৩ হাজার টাকা। সফটওয়্যার রক্ষণাবেক্ষণ ৪৭ লাখ টাকার বেশি, আসবাবপত্র ৪৭ লাখ ৫৫ হাজার, লিফটের ডিভাইন ক্রয় ৪০ লাখ টাকা, ক্লিনিং বিল ৯০ লাখ টাকা এবং ইলেকট্রিক সামগ্রি ক্রয় করা হয়েছে সোয়া দুই কোটি টাকার।  মেরামত বাবদ দেখানো হয় ৬৬ লাখ ৬৮ হাজার টাকা, হিসাব প্রস্তুতকারী কোম্পানির বিল ৭ লাখ ৪৫ হাজার এবং বিবিধ ব্যয় ১১ লাখ টাকা দেখানো হয়েছে। ২০২১ সালেও ব্যয় দেখানো হয়েছে  ৪৯ কোটি । এর বাইরে এই দুই বছরে গভর্নিং বডি নিয়েছে প্রায় ১৪ লাখ টাকা। এই সময় ক্লাস বন্ধ থাকলেও বিশেষ ক্লাসের নামে ৪৮ লাখ টাকা খরচ দেখানো হয়েছে।

শিক্ষকরা বলছেন, করোনার সময় শিক্ষকদের বেতন-ভাতা অনিয়মিত ছিল। কম বেতন দেওয়া হতো। অথচ এভাবে টাকা খরচের নামে আত্মসাৎ করা হয়েছে। এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের হস্তক্ষেপ কামনা করেন শিক্ষকরা।

প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, আট বছরে প্রতিষ্ঠানটি ৩৫ কোটি ৩ লাখ ৯২ হাজার ৯১৩ কোটি টাকার কর ও ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে। এছাড়া ৩১ কোটি ৬৮ লাখ ৮ হাজার ৯৫৩ টাকার কাজের প্রয়োজনীয়তা ও যথাযথ হিসাব দিতে পারেনি স্কুল কর্তৃপক্ষ।

এ বিষয়ে কলেজটির অভিযুক্ত অধ্যক্ষ ফরহাদ হোসেনের বক্তব্য নেওয়ার জন্য ফোন দেওয়া হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।

ইত্তেফাক/ইআ