ফিরোজ মাহবুব কামাল 19 September 2022
বাঙালি মুসলিমের মন থেকে একথাও ভূলিয়ে দেয়া হয়েছে, পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠায় উপমহাদেশের অন্য প্রদেশের মুসলিমদের তুলনায় বাঙালি মুসলিমদের অবদানটি ছিল সর্বাধিক। মুসলিম লীগ নামে যে সংগঠনটি পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা দেয় -সে প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয় ঢাকায়। মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দেন ঢাকার নওয়াব সলিমুল্লাহ। তিনি সর্বভারতীয় মুসলিম নেতাদের ঢাকায় আমন্ত্রিত করেন ও মুসলিম লীগের পতাকা তলে সংগঠিত করেন। সে আমলে এটি ছিল বিশাল কাজ। সেদিন থেকেই ভারতের মুসলিম ইতিহাসে তাদের বিজয়ের শুরু। কিন্তু বাঙালি ফ্যাসিস্টদের রচিত ইতিহাসের বইয়ে নওয়াব সলিমুল্লাহর কোন স্থান নাই। প্রায় পুরোপুরি ভূলিয়ে দেয়া হয়েছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার শুরু ১৯৭১ থেকে নয়, বরং স্বাধীনতা দিবস রূপে প্রতি বছর ১৪ই আগষ্ট এ দেশের নগর-ব্ন্দর ও গ্রাম-গঞ্জে ২৩ বছর যাবত মহা ধুমধামে পালিত হয়েছে। ভূলিয়ে দেয়া হয়েছে, ভারতীয় বর্ণহিন্দু নেতাদের বিরুদ্ধে কীরূপ রক্তাত্ব লড়াই করে ১৯৪৭’য়ে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা দিতে হয়েছিল। মুসলিম বিরোধী ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসক শক্তি ও হিন্দুদের সংগঠন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রসে –এ উভয় পক্ষই পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা মেনে নিতে রাজী ছিল না। উভয় পক্ষের সাথে কায়েদে আজম মুহম্মদ আলী জিন্নাহর আলাপ-আলোচনার সকল প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়ে যায়। আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার পর তিনি ডাক দেন ডাইরেক্ট এ্যাকশনের তথা প্রত্যক্ষ লড়াইয়ের। তখন রাজপথে মুসলিমদের মুখে স্লোগান শুরু হয়: “লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান।” অর্থাৎ লড়াই করেই আদায় করবো পাকিস্তান।
মুহম্মদ আলী জিন্নাহর প্রত্যক্ষ লড়াইয়ের ডাকে সবেচেয়ে বেশী সাড়া দেয় বাঙালি মুসলিমগণ। তখন বাংলায় মুসলিম লীগের সরকার এবং প্রধানমন্ত্রী জনাব হোসেন শহীদন সোহরাওয়ার্দী। ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট কলকতার গড়ের মাঠে অনুষ্ঠিত হয় মুসলিম লীগের বিশাল জনসভা। তখন কলকতা শহরের জনসংখ্যার শতকরা ৮০ ভাগ হলো হিন্দু, প্রায় ২০ ভাগ মুসলিম। জনসভা শেষে ফেরার পথে নিরস্ত্র মুসলিমদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে কংগ্রস ও হিন্দু মহাসভার সশস্ত্র গুন্ডাগণ। হামলাটি ছিল পরিকল্পিত। মুসলিম মহল্লাগুলোতে তিন দিন ধরে চলে হামলা। পাঁচ হাজারেরও বেশী মুসলিম সে হামলায় নিহত হয় এবং আহত হয় এক লাখের বেশী। নিহত ও আহতদের বেশীর ভাগ ছিল নোয়াখালী জেলার দরিদ্র মুসলিম –যারা কলকাতা বন্দরে শ্রমিকের কাজ করতো। এর প্রতিক্রিয়ায় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে নোয়াখালী জেলায় এবং বিহারে। সমগ্র ভারত তখন দ্রুত অশান্ত হয়ে পড়ে। পরিস্থিতি দ্রুত ব্রিটিশ সরকারে নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাচ্ছিল।
ব্রিটিশ সরকার বুঝতে পারে পরিস্থিতি এভাবে অশান্ত হতে থাকলে ভারতে কর্মরত ব্রিটিশ নাগরিকদের পক্ষে নিরাপদে দেশে ফেরাও অসম্ভব হবে। দাঙ্গায় তাদেরও প্রাণ যাবে। কংগ্রস নেতা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধিও বুঝতে পারেন, অভিজ্ঞ ব্রিটিশ সরকারই যেখানে দাঙ্গা সামাল দিতে পুরোপুরি ব্যর্থ হচ্ছে, কংগ্রেসের প্রশাসন সেটিকে কি করে নিয়ন্ত্রণে রাখবে? বিপদ বুঝে গান্ধিও দ্রুত পাকিস্তান দাবী মেনে নেন। সাথে সাথে মেনে নেয় ব্রিটিশ শাসকগণ। ফলে এক বছরের মধ্যেই ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা পায়। সুলতান মুহম্মদ ঘুরীর হাতে দিল্লির বিজয়ের পর এটিই ছিল ভারতীয় মুসলিমদের সবচেয়ে বড় বিজয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বাঙালি মুসলিমগণ তাদের সমগ্র ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সবচেয়ে গৌরবজনক ভূমিকাটি পেশ করে। তাদের রক্তের উপর প্রতিষ্ঠা পায় সমগ্র বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান –যার সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক ছিল বাঙালি মুসলিম। তবে এরূপ ভূমিকার জন্যই বাঙালি মুসলিমগণ পরিণত হয় ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীদের সবচেয়ে ঘৃণ্য দুশমনে। তারা সেটির বদলা নিচ্ছে বাঙালি মুসলিমের স্বাধীনতা শৃঙ্খলিত করে এবং বাংলাদেশে গণতন্ত্র কবরে পাঠিয়ে। এবং বদলার নেয়ার সে কাজটি তাদের আজ্ঞাবহ নওকর আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের ক্ষমতায় বসিয়ে।
প্রশ্ন হলো, ১৯৪৭’য়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা না পেলে ১৯৭১’য়ে কি বাংলাদেশ আদৌ প্রতিষ্ঠা পেত? শুধু নিজের ইতিহাস জানলে চলে, বাপের ইতিহাসও জানতে হয়। নইলে নিজের আসল পরিচয়টি অজানা থেকে যায়। সমাজে এরূপ পিতৃপরিচয়হীন ব্যক্তিগণই জারজ রূপে চিত্রিত হয়। এজন্যই প্রতিটি বাংলাদেশীদের জন্য জরুরি হলো পাকিস্তানের জন্মের ইতিহাসটি জানা। সেটি না জানলে বাংলাদেশের নিজের ইতিহাসটি অজানা থেকে যায়। অথচ ইতিহাসের সে পাঠ দানে বাঙালি সেক্যুরারিস্টদের কোন রুচি নাই। তবে সেটির কারণও রয়েছে। কারণটি হলো, ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী শাসকদের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা। কারণ, ভারতের সামরিক ও রাজনৈতিক সাহায্য নিয়েই আজ আওয়ামী ফ্যাসিস্টগণ ক্ষমতায়। ফলে তাদের রয়েছে হিন্দুত্বাবাদী ভারতের মন জুগিয়ে চলার বাধ্যবাধকতা। বাংলাদেশের স্কুল-কলেজে পাকিস্তান সৃষ্টিতে বাঙালি মুসলিমদের গৌরবজনক ইতিহাসটি পড়ানো হলে তখন প্রকাশ পেত ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীদের মুসলিম-বিরোধী ভূমিকাটিও। তখন সংকটে পড়তো বাংলাদেশের মাটিতে ভারতের এজেন্ডা-পূরণ। তখন কঠিন হতো বাঙালির মুখ দিয়ে ভারতের বন্দনা গাওয়ানো। সে সাথে অসম্ভব হতো মুজিবের ন্যায় ভারতসেবী ফ্যাসিস্টকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি রূপে প্রতিষ্ঠা দেয়ার কাজটি। এজন্যই বাংলাদেশের ইতিহাসের বইয়ে সত্যকে আড়াল করার এতো ষড়যন্ত্র। বাঙালি মুসলিমের ইতিহাসের সাথে ভারতসেবী বাঙালি সেক্যুলারিস্টদের এটিই হলো গাদ্দারী।
নিজেদের ইতিহাস যারা ভূলে যায় তারা কি কখনো রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি ও শিক্ষা-সংস্কৃতিতে সঠিক রাস্তা খুঁজে পায়? অতীতের ইতিহাস থেকেই মানুষ ভবিষ্যতের রাস্তা খুঁজে পায়। জানে অতীতের ভূল-ভ্রান্তিগুলি এবং সেগুলির কারণ। ইতিহাস পেশ করে শত্রু-মিত্রদের পরিচিতি। দেয় জ্ঞান ও প্রজ্ঞা। ফলে যারা ইতিহাস জানে না, তারাই বার বার পথ হারায়। একই গর্তে তাদের পা বার বার পড়ে। তাই নিজের পিতা-মাতা ও আপনজনদের স্মৃতিকে চেতনায় ধরে রাখাটি যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি হলো নিজ জাতি ও নিজ ধর্মের রাজনৈতিক ইতিহাসকে জানা। নইলে শত্রু-মিত্রের চেনার কাজটি হয় না। তখন অতি আপনজনও শত্রু মনে হয়। এবং পরম শত্রুও বন্ধু মনে হয়। বাংলাদেশে সেই ভূলটাই বেশী বেশী হচ্ছে। সে অজ্ঞতার কারণেই দেশের রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি ও শিক্ষা-সংস্কৃতিতে বাজার পাচ্ছে সেসব হিন্দুত্ববাদীরা –যাদের কারণে বাঙালি মুসলিমের জীবনে অতীতে বহু দুর্ভোগ এসেছে। তারা দিয়েছে নৃশংস জমিদারী লুণ্ঠন। তাদের কারণেই ১৯৪৭ সালে বাংলা ভাগ হয়েছে এবং এখন হারাতে হচ্ছে পদ্মা, তিস্তা ও মেঘনার পানি। মুজিবামলে ১৯৭৪ সালের তারা দিয়েছে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। তাতে ১৫ লাখ বাংলাদেশীর মৃত্যু হয়। সে দুর্ভিক্ষের কারণ সীমান্ত দিয়ে অবাধ ভারতীয় লুণ্ঠন এবং ভারতসেবী আওয়ামী শাসনের সীমাহীন দুর্নীতি। ১৯৭১’য়ের পর থেকেই দেশটির উপর চেপে বসেছে ভারতের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য। সে আধিপত্যের পরিণতিতে গণতন্ত্র আজ কবরস্থ এবং অসম্ভব হয়েছে সুষ্ঠ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। ভারতের সমর্থণ ও সাহায্য নিয়েই দেশজুড়ে ভোটডাকাতি হয়। সে সাথে প্লাবন এসেছে সরকারি বাহিনীর হাতে গুম, খুন, অপহরণ ও সন্ত্রাসের। তাদের হাতে শাপলা চত্বরের গণহত্যাও ঘটে। পদার্থ বিদ্যা, গণিত বিদ্যা, প্রকৌশল বিদ্যা ইত্যাদি বিষয়ে জ্ঞানী না হওয়াতে কোন জাতি ধ্বংস হয়না, কিন্তু ধ্বংস হয় যদি নিজের ইতিহাসই না জানে।