দেশে দেশে গুমের বিরুদ্ধে নারীর প্রতিরোধ

২০২২-০৮-২৯

দীপান্বিতা কিংশুক ঋতি

রাষ্ট্রগুলো কেন এই বীভৎস অপরাধ করে চলেছে? এর সম্ভাব্য উত্তর হলো, এর মধ্য দিয়ে সর্বোচ্চ মাত্রায় ক্ষমতার চর্চা করা সম্ভব এবং জনমানসের একেবারে গভীরে রাষ্ট্রের প্রতি চূড়ান্ত ভীতি সঞ্চার করা সহজ, যাতে জনতা অনুগত থাকে, প্রশ্ন না করে, বিরোধী না হয়। যাঁদেরকে গুম করা হয়, তাঁদের কাউকে কাউকে গ্রেপ্তার দেখানো হলেও সিংহভাগই আর ফিরে আসেন না, এবং তাঁদের ভাগ্যে শেষ পর্যন্ত কী ঘটেছিল তা-ও জানা যায় না। এ বিষয়টি মোটামুটি সর্বজনবিদিত হলেও যা প্রায়শই আমাদের নজর এড়িয়ে যায় তা হলো, গুম হওয়া ব্যক্তিরা যাঁদের পেছনে ফেলে যান, পরিবারের সেই বাকি সদস্যদের নিয়তি তাঁদেরকে কোথায় নিয়ে যায়?

১৯৮২ সালে মাদারস অফ প্লাজা দে মায়োর আন্দোলনকারীরা। ছবি- উইকিপিডিয়া

ফিরে তাকানো যাক ১৯৭৭ সালের আর্জেন্টিনার দিকে। সে বছরই যাত্রা শুরু হয় আর্জেন্টিনার মায়েদের প্রতিবাদের। এই মায়েরা গুম হয়ে যাওয়া সন্তানদের মা। ১৯৭৭ এর ৩০ এপ্রিল প্রথম তাঁদের একটি দল রাজধানী বুয়েনোস আইরেসে রাষ্ট্রপতি ভবনের সামনে প্লাজা দে মায়োতে জড়ো হয়। তাঁদের প্রত্যয় ছিলো এই যে, যতক্ষণ তাঁদের অদৃশ্য হয়ে যাওয়া প্রিয়জনদের বিষয়ে তাঁরা কোনো উত্তর না পাচ্ছেন, ততোক্ষণ তাঁরা প্রশ্ন করেই যাবেন। তাঁদের প্রশ্ন ছিলো, তাঁদের পুত্র-কন্যারা কোথায়, তারা জীবিত আছে, নাকি ইতোমধ্যেই মৃত। তাঁরা সত্যটা জানতে চাচ্ছিলেন- তাঁদের পুত্র-কন্যাদেরকে কে, কখন এবং কেন গুম করেছে। এর মূলে ছিলো আর্জেন্টিনার নোংরা যুদ্ধ বা ডার্টি ওয়ার, যেখানে দুটি পক্ষ ছিলো ডানপন্থী সরকার এবং সরকারবিরোধী বামপন্থীরা। সরকারবিরোধী এই ব্যক্তিদের নিয়মিত আটক করা হতো, এবং তারপর হত্যা বা গুম করে ফেলা হতো। এই ব্যক্তিরাই নিখোঁজ হিসেবে গণ্য হন। এই নিখোঁজ ব্যক্তিদের মায়েদের লাগাতার প্রতিবাদ মিলিটারিকে কোণঠাসা করে ফেলে, এবং ১৯৮৩ সালে এই সহিংস যুদ্ধের ইতি ঘটাতে ভূমিকা রাখে। মানবাধিকার রক্ষায় একটি আন্দোলনের নেপথ্যে থাকেন তাঁরা, যে আন্দোলন লাতিন আমেরিকায় একনায়কত্বের অধীনে থাকা দেশগুলোকে ছাড়িয়ে আরো বহুদূর ছড়িয়ে পড়ে।

ফিরে তাকানো যাক ১৯৭৭ সালের আর্জেন্টিনার দিকে। সে বছরই যাত্রা শুরু হয় আর্জেন্টিনার মায়েদের প্রতিবাদের। এই মায়েরা গুম হয়ে যাওয়া সন্তানদের মা। ১৯৭৭ এর ৩০ এপ্রিল প্রথম তাঁদের একটি দল রাজধানী বুয়েনোস আইরেসে রাষ্ট্রপতি ভবনের সামনে প্লাজা দে মায়োতে জড়ো হয়। তাঁদের প্রত্যয় ছিলো এই যে, যতক্ষণ তাঁদের অদৃশ্য হয়ে যাওয়া প্রিয়জনদের বিষয়ে তাঁরা কোনো উত্তর না পাচ্ছেন, ততোক্ষণ তাঁরা প্রশ্ন করেই যাবেন। তাঁদের প্রশ্ন ছিলো, তাঁদের পুত্র-কন্যারা কোথায়, তারা জীবিত আছে, নাকি ইতোমধ্যেই মৃত। তাঁরা সত্যটা জানতে চাচ্ছিলেন- তাঁদের পুত্র-কন্যাদেরকে কে, কখন এবং কেন গুম করেছে। এর মূলে ছিলো আর্জেন্টিনার নোংরা যুদ্ধ বা ডার্টি ওয়ার, যেখানে দুটি পক্ষ ছিলো ডানপন্থী সরকার এবং সরকারবিরোধী বামপন্থীরা। সরকারবিরোধী এই ব্যক্তিদের নিয়মিত আটক করা হতো, এবং তারপর হত্যা বা গুম করে ফেলা হতো। এই ব্যক্তিরাই নিখোঁজ হিসেবে গণ্য হন। এই নিখোঁজ ব্যক্তিদের মায়েদের লাগাতার প্রতিবাদ মিলিটারিকে কোণঠাসা করে ফেলে, এবং ১৯৮৩ সালে এই সহিংস যুদ্ধের ইতি ঘটাতে ভূমিকা রাখে। মানবাধিকার রক্ষায় একটি আন্দোলনের নেপথ্যে থাকেন তাঁরা, যে আন্দোলন লাতিন আমেরিকায় একনায়কত্বের অধীনে থাকা দেশগুলোকে ছাড়িয়ে আরো বহুদূর ছড়িয়ে পড়ে।

১৯৭৭ সালে ১৪জন নারীর শুরু করা এই সাপ্তাহিক অহিংস প্রতিবাদ সরকারের কাছে খুব সাদামাটা একটা জিনিস চেয়েছিল, আর তা হলো তাঁদের সন্তানদের বিষয়ে তথ্য। তাঁরা জপ করার মতো করে বলতেন: “আমরা আমাদের সন্তানদের চাই, আমরা চাই তারা আমাদের বলুক ওরা কোথায় আছে।” মায়েরা প্রায়শই তাঁদের সন্তানদের ছবি নিয়ে আসতেন এবং শান্তির প্রতিক হিসেবে মাথায় সাদা স্কার্ফ বাঁধতেন। এই কর্মসূচি ছিলো নিঃসন্দেহে বৈপ্লবিক, কারণ সরকার বিরোধীদের সম্বন্ধে কথা বলা নিষিদ্ধ করেছিলো, এবং কোনো ধরনের ভিন্নমত সহ্য করা হতো না। এই মায়েদের মতে, “আমরা বুঝি, মানবাধিকার রক্ষার দাবি করা একটা বৈপ্লবিক কাজ, আমাদের সন্তানদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সরকারকে প্রশ্ন করাও একটা বৈপ্লবিক কাজ। আমরা মুক্তির জন্য লড়াই করছি, স্বাধীনভাবে বাঁচতে লড়াই করছি, আর সেটা একটা বৈপ্লবিক কাজ… প্রথাকে বদলে দেওয়া সবসময়েই বৈপ্লবিক।”

নারীদের এই প্রতিবাদী সমাবেশ আর্জেন্টিনার অভ্যন্তরীণ বিরোধের দিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের মনোযোগ আকর্ষণ করে। আন্দোলন বড় হতে থাকার সাথেসাথে সরকার একে দমন করার লক্ষ্যে আন্দোলনের কয়েকজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্যকে গুম করে ফেলে। কিন্তু এতে তথ্য ও বিচারের দাবিতে মায়েদের কণ্ঠস্বর থেমে যায় না। ১৯৭৮ এর ফুটবল বিশ্বকাপ আর্জেন্টিনায় অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। মায়েরা এই সুযোগকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের মনোযোগ আকর্ষণ করতে কাজে লাগিয়েছেন।

১৯৮০ সালের ডিসেম্বরের শুরুতে মায়েরা তাঁদের প্রথম প্রতিবাদী পদযাত্রা বা মার্চ অফ রেজিস্ট্যান্স সংগঠিত করেন। পাবলিক স্কয়ার ঘিরে ২৪ ঘণ্টা মার্চ করেন তাঁরা। দ্বিতীয় মার্চ অফ রেজিস্ট্যান্স হয় ১৯৮২ সালের ৯ এবং ১০ ডিসেম্বর। “৩০,০০০ নিখোঁজ ব্যক্তিকে জীবিত ফেরত চাই” লেখা সংবলিত পতাকা বহন করেন তাঁরা। ১৯৮৩ সালে আর্জেন্টিনায় সামরিক শাসন শেষ হয় এবং আর্জেন্টিনা ডার্টি ওয়ার থেকে বেরিয়ে আসার প্রচেষ্টা শুরু করে।

১৯৮০ সালের ডিসেম্বরের শুরুতে মায়েরা তাঁদের প্রথম প্রতিবাদী পদযাত্রা বা মার্চ অফ রেজিস্ট্যান্স সংগঠিত করেন। পাবলিক স্কয়ার ঘিরে ২৪ ঘণ্টা মার্চ করেন তাঁরা। দ্বিতীয় মার্চ অফ রেজিস্ট্যান্স হয় ১৯৮২ সালের ৯ এবং ১০ ডিসেম্বর। “৩০,০০০ নিখোঁজ ব্যক্তিকে জীবিত ফেরত চাই” লেখা সংবলিত পতাকা বহন করেন তাঁরা। 

যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে মায়েরা তাঁদের সন্তানদের সঙ্গে এবং যারা তাঁদের সন্তানদের পরিণতির জন্য দায়ী তাদের সঙ্গে কী ঘটেছে তা জানার জন্য লড়াই চালিয়ে যান। চিহ্নহীন গণকবরে মৃতদেহ শনাক্ত করতে তাঁরা ডিএনএ প্রমাণের সাহায্য নেন। গুমের জন্য দায়ী কিছু সামরিক অফিসারের বিচার হয় এবং তাদেরকে জেলে পাঠানো হয়। গ্র্যান্ডমাদার্স অফ প্লাজা দে মায়ো হলো সেই নারীদের দল, যাঁদের মেয়েরা কারাগারে সন্তান প্রসব করেছেন, এবং সেই সন্তানদের উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের দিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই মাতামহীরা ২০০রও বেশি নাতি-নাতনীকে খুঁজে বের করতে সক্ষম হন এবং তাঁদের সাথে পুনর্মিলিত হন। মাদার্স অফ প্লাজা দে মায়ো সহিংস সরকারের বিরুদ্ধে অহিংস আন্দোলনের একটি জলজ্যান্ত উদাহরণ হয়ে থাকবে।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গুম হওয়া ব্যক্তিদের নিরুদ্দেশ হওয়ার ফল সর্বোচ্চ মাত্রায় ভোগ করেন নারীরা। নিরুদ্দিষ্ট ব্যক্তিরা মা, বোন, স্ত্রী এবং কন্যাদের ওপর গুমের ঘটনা মানসিক প্রভাব তো ফেলেই, বাস্তবতার খড়্গও তাঁদেরকে জোরেশোরেই আঘাত করে। বিভিন্ন সংস্থার পরিচালিত নানান জরিপে দেখা গিয়েছে, গুম হওয়া ব্যক্তিদের ৭০-৯৪ শতাংশই পুরুষ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই ব্যক্তিরা পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন, এবং তাঁর হারিয়ে যাওয়া এ কারণে অনিশ্চয়তার মানসিক যন্ত্রণার পাশাপাশি পরিবারগুলোকে চরম অর্থনৈতিক সমস্যার মধ্যে ফেলে। শিশুদের দায়িত্বও এসব ক্ষেত্রে একা হয়ে যাওয়া মায়ের ওপর বর্তায়, কোন কোন ক্ষেত্রেশারীরিকভাবেঅক্ষম বৃদ্ধ পিতা-মাতার ওপর।

পিতৃতান্ত্রিক সমাজে এই বাস্তবতা আরো রূঢ়। সিরিয়ার দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, গুম হওয়া ব্যক্তির পরিবারের নারী সদস্যদের অবস্থার বহুমাত্রিক জটিলতা রয়েছে। সিরিয়ার প্রথাগত নারী-পুরুষ ভূমিকার কারণে নিরুদ্দিষ্ট ব্যক্তির নারী স্বজনদের পক্ষে দারিদ্র্য, বিষণ্ণতা এবং বিচ্ছিন্নতার মুখোমুখি হওয়া ছাড়া সাধারণত কোনো উপায় থাকে না। সিরিয়ায় নারীর প্রতি অসমতা এবং নারীর প্রতি প্রথাগত অবিচার দেশটির সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক কাঠামোর একটি প্রশ্নাতীত অংশ। এর প্রতিফলন দেখা যায় দেশটির বৈষম্যমূলক বিভিন্ন আইনে, বিশেষত যেসব আইন বিয়ে, সম্পত্তির অধিকার এবং যৌন নিপীড়নের সঙ্গে সম্পর্কিত। এ ধরনের আইন অসমতাকে বৈধতা দেয়, যার ফলে প্রাতিষ্ঠানিক অসমতার শেকড় ছড়ায় আরো গভীরে। আইনের এই একপাক্ষিকতা কেবল সিরিয়ায় নয়, বহু পিতৃতান্ত্রিক সমাজেই দেখা যায় এবং সেসব সমাজের নারীরাও একইভাবে এর ফল ভোগ করেন।

বেশিরভাগ প্রেক্ষাপটেই নারীদের ওপর গুমের প্রভাব মূলত তিন ধরনের। প্রথমত, পরিবারের প্রধান উপার্জনক্ষম ব্যক্তি অদৃশ্য হয়ে গেলে সংসার চালানোর দায়িত্ব নারীর ওপরে বর্তায়। দ্বিতীয়ত, অনির্দিষ্টকালের চলমান শোক, ভয়, বিপন্নতা এবং অনিশ্চয়তার মধ্যেও নারীকে সন্তানের অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করে যেতে হয়। তৃতীয়ত, কোনো কোনো দেশে (যেমন, সিরিয়া) নারীর পুনর্বিবাহ, উত্তরাধিকার, এমনকি ভ্রমণের জন্যও স্বামীর মৃত্যুর প্রমাণ দরকার হয়, এসব ক্ষেত্রে যা থাকাটা দুষ্কর। এছাড়া দেশজ ও সামাজিক প্রথা ও সংস্কারের কারণে নারীকে অনেকটাই কোণঠাসা হয়ে থাকতে হয়। জনজীবনে নারীর অংশগ্রহণ কঠিন হয়ে পড়ে, এবং সব পেশা গ্রহণের সুযোগ না থাকায় জীবিকা নির্বাহও কষ্টকর হয়ে ওঠে।

জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সাবেক হাইকমিশনার কিউং-হোয়া কাং এর মতে, “যেসব সমাজে নীতি এবং আইনে জেন্ডার বৈষম্য পাবলিক ও রাজনৈতিক জীবনে নারীর স্বায়ত্তশাসন এবং অধিকারকে সীমিত করে দেয়, সেখানে গুমের সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব আরো জোরালোভাবে টের পাওয়া যায়। এর ফলে নারী ও শিশুরা শোষণ এবং সামাজিক প্রান্তিকীকরণের সহজ শিকারে পরিণত হন।”

বহু নারীই এ অবস্থায় নিরুদ্দিষ্ট স্বামীকে মৃত ঘোষণা করতে বাধ্য হন, যেমনটা দেখা যায় নেপালে। নেপালের নিরুদ্দিষ্ট ব্যক্তিদের স্ত্রীদের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ তাঁদেরকে মৃত ঘোষণা করেন। এক্ষেত্রে অন্যান্য বিষয় ভূমিকা রাখলেও মূল ভূমিকা পালন করে দারিদ্র্যের চাপ। নেপালের ইন্টারিম রিলিফ প্রোগ্রাম মৃত ব্যক্তির স্বজনের জন্য বরাদ্দ করেছে এক লক্ষ নেপালি রুপি, আর নিখোঁজ ব্যক্তির স্বজনের জন্য মাত্র পঁচিশ হাজার। দুটি সংখ্যার মধ্যে বিরাট ব্যবধানের কারণে অনেক নারীই স্বামী/ বাবা/ ছেলে/ ভাইকে মৃত ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নেন।

বহু নারীই এ অবস্থায় নিরুদ্দিষ্ট স্বামীকে মৃত ঘোষণা করতে বাধ্য হন, যেমনটা দেখা যায় নেপালে। নেপালের নিরুদ্দিষ্ট ব্যক্তিদের স্ত্রীদের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ তাঁদেরকে মৃত ঘোষণা করেন। এক্ষেত্রে অন্যান্য বিষয় ভূমিকা রাখলেও মূল ভূমিকা পালন করে দারিদ্র্যের চাপ। নেপালের ইন্টারিম রিলিফ প্রোগ্রাম মৃত ব্যক্তির স্বজনের জন্য বরাদ্দ করেছে এক লক্ষ নেপালি রুপি, আর নিখোঁজ ব্যক্তির স্বজনের জন্য মাত্র পঁচিশ হাজার। দুটি সংখ্যার মধ্যে বিরাট ব্যবধানের কারণে অনেক নারীই স্বামী/ বাবা/ ছেলে/ ভাইকে মৃত ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নেন।

করাচিতে গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের প্রতিবাদ সমাবেশ। ছবি- গান্ধারা

অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, নারীরা কেবল কম পারিশ্রমিকের অনিরাপদ কাজের সুযোগ পাচ্ছেন, যা আবার তাদের পরিবার থেকে দূরে। এর ফলে তাঁদের নিপীড়নের শিকার হওয়ার ঝুঁকি যেমন বাড়ে, তেমনি তাঁদের সন্তানদের দেখাশোনা আর লেখাপড়াতেও ব্যাঘাত ঘটে। স্বামীর নামে খোলা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট স্ত্রীরা ব্যবহার করতে পারেন না, যে কারণে তাঁদের অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়তে হয়। যেহেতু স্বামীর মৃত্যুর প্রমাণ তাঁদের কাছে নেই, সে কারণে তাঁরা বিধবা ভাতার মতো সুবিধাগুলোও নিতে পারেন না। অনেক সময়ে স্বামীকে মৃত ঘোষণা করলেও নিখোঁজ হওয়ার একটা নির্দিষ্ট সময়ের আগে মৃত্যুর সনদ পাওয়া যায় না। এরপরেও বহু নারীই আশা ছাড়েন না। একইসঙ্গে আশা এবং অপরাধবোধ তাঁদেরকে এই পদক্ষেপ নিতে বাধা দেয়। এ থেকে স্পষ্টত ধারণা করা যায়, গুম হওয়া ব্যক্তির স্বজনদের ওপর কী ধরনের মানসিক চাপের বোঝা প্রতি মুহূর্তে চেপে থাকে। মৃতের জন্য শোক প্রকাশ এবং আশা না ছাড়ার মাঝামাঝি জায়গায় দুলতে থাকেন তাঁরা। এই অবর্ণনীয় পরিস্থিতির ক্ষণিক উপশম ঘটে যখন বিভিন্ন নিখোঁজ ব্যক্তির পরিবারের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপিত হয়। কারণ, তাঁরা সবাই একই ধরনের অপরাধের ভুক্তভোগী।

গুম হওয়া পরিবারের সদস্যদের ছবি নিয়ে সিরিয়ার নারীরা। ছবি: ফ্যামিলিজ ফর ফ্রিডম ওয়েবসাইট

টানা অনিশ্চিত অবস্থা চলতে থাকার এক পর্যায়ে নারীদেরকে তাঁদের নিখোঁজ স্বজন বিষয়ে উদ্যোগ নিতেই হয়। অনেক সময়েই এই উদ্যোগ নিতে হয় অনানুষ্ঠানিকভাবে, যেমন ঘুষ দিয়ে। বহু ক্ষেত্রে তাঁরা নিজেরাই নিরাপত্তা ব্যবস্থার সদস্যদের কাছ থেকে দুর্ব্যবহারের শিকার হন। হুমকির শিকারও হতে হয় তাঁদের। পাকিস্তানের দক্ষিণ-পশ্চিমের শহর কুয়েটা থেকে ২০০৯ সালের ৮ জুন দুজন বন্ধুর সামনে অপহৃত হন বালুচ ছাত্র ও অধিকারকর্মী জাকির মাজীদ। মাজীদের বোন অ্যামনেস্টিকে জানান যে, তিনি “চুপ না থাকলে একই পরিণতির” হুমকি পেয়েছিলেন।

পাকিস্তানে নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের বেশিরভাগই ইসলামিক মৌলবাদী বা বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে জড়িত থাকার বিষয়ে পাকিস্তানের নিরাপত্তা ব্যবস্থার সন্দেহভাজনের তালিকাভুক্ত। পাকিস্তান সরকার বারবার এই সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিলেও কার্যত কোনো লাভ হয়নি। একটি সরকারি কমিশন বারোজন নিখোঁজ ব্যক্তির খোঁজ করেছে এবং প্রকাশ্যে জানিয়েছে যে, পাকিস্তানি ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির এর সাথে সম্পৃক্ততা আছে। কিন্তু কমিশনটি কাউকেই দায়ী করেনি।

পাকিস্তানে নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের বেশিরভাগই ইসলামিক মৌলবাদী বা বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে জড়িত থাকার বিষয়ে পাকিস্তানের নিরাপত্তা ব্যবস্থার সন্দেহভাজনের তালিকাভুক্ত। পাকিস্তান সরকার বারবার এই সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিলেও কার্যত কোনো লাভ হয়নি। একটি সরকারি কমিশন বারোজন নিখোঁজ ব্যক্তির খোঁজ করেছে এবং প্রকাশ্যে জানিয়েছে যে, পাকিস্তানি ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির এর সাথে সম্পৃক্ততা আছে। কিন্তু কমিশনটি কাউকেই দায়ী করেনি।

২০০৫ সালে পাকিস্তানের পেশোয়ারে গুম হওয়া স্বামী মাসুদ জানজুয়ার ছবি নিয়ে স্ত্রী আমিনা জানজুয়া। তিনি এক হাজারেরও বেশি গুম হওয়া ব্যক্তির পরিবারের সদস্যদের একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছেন। ছবি: দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট

যেহেতু গুমের ঘটনা নারীদেরকেই সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত করে, সেহেতু তাঁদের একজোট হওয়া বা উদ্যোগ নেওয়া কোনো অভাবনীয় ঘটনা নয়। ২০১৭ সালে সিরিয়ায় মানবাধিকার বিষয়ক আইনজীবী নোরা গাজী ফ্যামিলিজ ফর ফ্রিডম নামে দেশটির প্রথম নারী নেতৃত্বাধীন আন্দোলন গড়ে তোলেন। যুদ্ধ শুরুর পর থেকে সিরিয়ায় ৯০,০০০ এরও বেশি মানুষ নিখোঁজ হয়েছেন। নোরার স্বামী মানবাধিকারকর্মী বাসেল খারতাবিল ২০১২ সালে গ্রেপ্তার হন। ২০১৫তে তাঁর সঙ্গে নোরার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয় এবং ২০১৭ সালে নোরা জানতে পারেন, তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। নোরার মতো বহু নারীর স্বামী, ভাই, বাবা এভাবে হারিয়ে গেছেন, এবং স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের জন্য রুখে দাঁড়ানোর দায়িতে বর্তেছে নারীদের ওপরেই।

নোরা বলেন, “আমার স্বামী নিহত হওয়ার পর থেকে ফ্যামিলিজ ফর ফ্রিডমই আমাকে বেঁচে থাকার প্রেরণা যুগিয়েছে। প্রত্যেক আটক ব্যক্তির ঘটনাকেই আমার নিজের ব্যাপার বলে মনে হয়, আর তাঁদের জন্য লড়াই করে যাওয়াটা আমার কর্তব্য। আমার মনে হয় নারীরাই এই ব্যাপারটা নিয়ে কাজ করার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত। তার কারণ কেবল এই নয় যে, এই অধিকার লঙ্ঘনের ফলে তাঁরাই সবচেয়ে বেশি দুর্দশা ভোগ করেন, বরং যে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা তাঁরা সিরিয়ার ভবিষ্যেত ক্ষেত্রে পালন করেন, সেজন্যও।”

 “আমার স্বামী নিহত হওয়ার পর থেকে ফ্যামিলিজ ফর ফ্রিডমই আমাকে বেঁচে থাকার প্রেরণা যুগিয়েছে। প্রত্যেক আটক ব্যক্তির ঘটনাকেই আমার নিজের ব্যাপার বলে মনে হয়, আর তাঁদের জন্য লড়াই করে যাওয়াটা আমার কর্তব্য। আমার মনে হয় নারীরাই এই ব্যাপারটা নিয়ে কাজ করার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত। তার কারণ কেবল এই নয় যে, এই অধিকার লঙ্ঘনের ফলে তাঁরাই সবচেয়ে বেশি দুর্দশা ভোগ করেন, বরং যে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা তাঁরা সিরিয়ার ভবিষ্যেত ক্ষেত্রে পালন করেন, সেজন্যও।”

২৭ জানুয়ারি, ২০১৮ তারিখে প্যারিসে ফ্যামিলিজ ফর ফ্রিডম আয়োজিত সিরিয়ার গুম ব্যক্তিদের মুক্তির দাবিতে কর্মসূচি। ছবি- দ্য তাহরির ইন্সটিটিউট অফ মিডল ইস্ট পলিসিজ

নোরার প্রতিষ্ঠিত ফ্যামিলিজ অফ ফ্রিডম সমগ্র সিরিয়া থেকে নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবারকে আন্দোলনে যুক্ত করে, এবং তাঁদের প্রত্যাবর্তনের দাবি জানায়। এতে তাঁদের হারানো স্বজনদের ওপর, পরিবারের ওপর এবং নিজেদের ওপরও ক্ষমতাধরদের ক্রোধ নেমে আসবার আশঙ্কা তীব্র মাত্রাতেই ছিল। তবু  তাঁরা এই আন্দোলনকে ছড়িয়ে দেন এবং চেষ্টা করেন ধর্ম, জাতি বা রাজনৈতিক বিশ্বাস নির্বিশেষে প্রত্যেক গুম হওয়া ব্যক্তির পরিবারকে একত্র করতে। আন্দোলনটা নোরার হাত ধরে শুরু হলেও পরবর্তী সময়ে এ আন্দোলনকে তৃণমূল পর্যায়ে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। স্থানীয় উদ্যোগ আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, কেননা তৃণমূল পর্যায়ের মানুষেরা তাঁদের ভুক্তভোগিতার কারণে সহজেই আন্দোলনের দাবির সঙ্গে নিজেদের একাত্মতা খুঁজে পান, এবং নিজেদের আখ্যান জানানোর পাশাপাশি পরিকল্পনার ক্ষেত্রেও তাঁরা মতামত দেন।

এই বিষয়টি আর্জেন্টিনার মাদারস অফ প্লাজা দে মায়ো আন্দোলনের ক্ষেত্রেও লক্ষ্য করা যায়। সেখানেও নারীরা একাত্ম; আন্দোলনের গোড়াতেই রয়েছে তাঁদের প্রশ্ন: আমাদের ছেলে-মেয়েরা কোথায়? তারা কি বেঁচে আছে, না মৃত? কে, কখন, কেন তাদের গুম করেছে?

ফ্যামিলিজ ফর ফ্রিডমের সংগঠকেরা কিছু সম্মিলিত দাবি রাখেন। সিরিয়ার বিশেষ যুদ্ধকালীন বাস্তবতায় তাঁরা নিচের দাবিগুলো জাতিসংঘের জেনেভা দপ্তরে উপস্থাপন করেন:

বর্তমান অবস্থা ও অবস্থানসহ সকল নিখোঁজ ব্যক্তির একটি তালিকা প্রকাশ করা, এবং অত্যাচার ও দুর্ব্যবহার বন্ধ করা। মৃত্যুর ক্ষেত্রে নিখোঁজ ব্যক্তির পরিবারকে তাঁর মৃত্যু সনদ দেওয়া, মৃত্যুর কারণ সংক্রান্ত প্রতিবেদন দেওয়া এবং সমাধিস্থলের ঠিকানা জানানো।

  • আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে খাবার ও চিকিৎসা সেবার সুযোগ দেওয়ার জন্য এবং সংগঠনগুলোকে কারাগারে স্বাস্থ্যকর ও মানসম্মত জীবনব্যবস্থা আছে কিনা তা পর্যবেক্ষণের সুযোগ দিতে সিরিয়া সরকারকে চাপ দেওয়া।
  • জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে ন্যায্য বিচারের নিশ্চয়তা দেওয়া এবং বিশেষ আদালত, বিশেষত মাঠ পর্যায়ের, যুদ্ধ বিষয়ক এবং সন্ত্রাসবিরোধী আদালত নির্মূল করা।
  • স্বেচ্ছায় যে সকল ব্যক্তি ধরা দিয়েছেন তাদের এবং তাদের পরিবারের প্রতি সহিংসতার দায়ে যে-কোনো দিক থেকে দায়ী সকল ব্যক্তিকে, বিশেষত সিরিয়া সরকারকে বিচারের অংশ হিসেবে অভিযুক্ত করা।

সিরিয়া বা আর্জেন্টিনার মতো নারীরা তাঁদের নিরুদ্দিষ্ট স্বজনদের জন্য রুখে দাঁড়িয়েছেন শ্রীলঙ্কাতেও। বিশ্বের যেসব দেশে সবচেয়ে বেশি মানুষ গুমের শিকার হন, শ্রীলঙ্কা তার মধ্যে গোড়ার দিকে আছে। অন্তত ৬০,০০০ মানুষের ভাগ্যে কী ঘটেছে, তা জানা যায় না। শ্রীলঙ্কান নারীবাদী ও ক্যুইরকর্মী শুভা উইজেসিরিওয়ার্দেনা বলেন, “শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধের পুরো সময় জুড়ে নারীরাই সব নিখোঁজ মানুষের মুখপাত্র ছিলেন। নারীরা অন্তরালে চলে যেতে অস্বীকার করেছেন, এবং রুখে দাঁড়িয়েছেন তাঁদের গুম হয়ে যাওয়া স্বজনদের জন্য।”

“শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধের পুরো সময় জুড়ে নারীরাই সব নিখোঁজ মানুষের মুখপাত্র ছিলেন। নারীরা অন্তরালে চলে যেতে অস্বীকার করেছেন, এবং রুখে দাঁড়িয়েছেন তাঁদের গুম হয়ে যাওয়া স্বজনদের জন্য।”

শ্রীলঙ্কার উত্তর-পূর্বে গুম হওয়া তামিল ব্যক্তিদের পরিবার। ছবি: দ্য তামিল গার্ডিয়ান

২০১০এর জানুয়ারিতে সন্ধ্যা একনালিগোদার স্বামী সাংবাদিক এবং কার্টুনিস্ট প্রাগিথ একনালিগোদা গুম হন। সন্ধ্যা এখন শ্রীলঙ্কার একজন বিশিষ্ট মানবাধিকারকর্মী, এবং পিছু হটতে অস্বীকার করার কারণে তিনি একাধিকবার হত্যার হুমকি পেয়েছেন। সন্ধ্যা হাল ছাড়েননি, বিচারের দাবিতে তাঁর লাগাতার আন্দোলন সরকারকে তদন্ত করতে এবং দায় নিতে বাধ্য করেছে। তিনি বলেন, “প্রাগিথ আমাদের পরিবারের প্রধান উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলো। সে গুম হওয়ার পরে আমাদের পরিবার চালনার পুরো কাঠামো ভেঙে পড়ে। যাঁরা গুম হয়েছেন তাঁদের অনেকের পরিবারের বাস্তবতা একই। আমাদের ক্ষতির কিছু খেসারতের নিশ্চয়তা অন্তত থাকতে হবে।”

২০১০এর জানুয়ারিতে সন্ধ্যা একনালিগোদার স্বামী সাংবাদিক এবং কার্টুনিস্ট প্রাগিথ একনালিগোদা গুম হন। সন্ধ্যা এখন শ্রীলঙ্কার একজন বিশিষ্ট মানবাধিকারকর্মী, এবং পিছু হটতে অস্বীকার করার কারণে তিনি একাধিকবার হত্যার হুমকি পেয়েছেন। সন্ধ্যা হাল ছাড়েননি, বিচারের দাবিতে তাঁর লাগাতার আন্দোলন সরকারকে তদন্ত করতে এবং দায় নিতে বাধ্য করেছে।

অনেক সময়েই এই লড়াই দশকের পর দশক ধরে চলেছে, কিন্তু আন্দোলনকারীদের অধ্যবসায় প্রশংসনীয়।

তুরস্কে  প্রথমে ‘স্যাটারডে পিপল’ এবং পরে ‘স্যাটারডে মাদার্স’ নামে পরিচিত একটি গোষ্ঠী ১৯৯৫ সাল থেকে প্রতি সপ্তাহে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ পালনে ইস্তানবুলে জড়ো হয়েছে। ১৯৯৯ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত পুলিশি হয়রানির কারণে তাঁরা এই কর্মসূচি পালন করতে পারেননি। ১৯৩৬ থেকে এখন পর্যন্ত (বিশেষত ১৯৮০ ও ১৯৯০ এর দশকে) নিখোঁজ হওয়া শত শত মানুষ সম্বন্ধে সত্য জানতে চান তাঁরা। ২০১৮ সালের ২৫ আগস্ট তাঁদের ৭০০তম সমাবেশ পুলিশি হামলায় নৃশংসভাবে ছত্রখান হওয়ার পরে ইস্তানবুলে তাঁদের প্রথাগত সমাবেশস্থলে তাঁদেরকে নিষিদ্ধ করা হয়।

গুম হওয়া ব্যক্তিদের জন্য তুরস্কে স্যাটারডে মাদার্সের সমাবেশ। ছবি- অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল

এমিনে ওকাকের বয়স আশির ওপরে। তাঁর ছেলে হাসান ১৯৯৫ সালে গুম হন। নিখোঁজ হওয়ার ৫৮ দিন পরে এমিনে ছেলের ছবি খুঁজে পান ফরেনসিক রেকর্ডে। তাঁর মুখে এমনভাবে উপর্যুপরি আঘাত করা হয়েছিলো যে তাঁকে চিনতে কষ্ট হচ্ছিলো। “আমি জানতাম হাসানকে পুলিশ নিয়ে গেছে। মায়ের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়ে আমি তা বুঝতে পেরেছি। ওকে খুঁজে পাওয়ার পর আমি অন্যান্য নিখোঁজদের স্বজনদের সঙ্গে গালাতাসারে স্কয়ারে বসার সিদ্ধান্ত নেই। আমি চাইনি আর কেউ পুলিশ হেফাজত থেকে অদৃশ্য হয়ে যাক,” এমিনে বলেন। “আমরা আওয়াজ তোলা শুরু করার পর থেকে পুলিশ হেফাজতে অদৃশ্য মানুষের সংখ্যা কমতে থাকে। আমি মনে করি আমাদের আন্দোলনের কারণে জীবননাশের সংখ্যা কমেছে। আমরা মানুষের বেঁচে থাকার অধিকারের রক্ষাকর্তায় পরিণত হয়েছিলাম।”

“আমরা আওয়াজ তোলা শুরু করার পর থেকে পুলিশ হেফাজতে অদৃশ্য মানুষের সংখ্যা কমতে থাকে। আমি মনে করি আমাদের আন্দোলনের কারণে জীবননাশের সংখ্যা কমেছে। আমরা মানুষের বেঁচে থাকার অধিকারের রক্ষাকর্তায় পরিণত হয়েছিলাম।”

আন্দোলনের ফলে এমিনের মতো নারীরা তুরস্ক সরকারের গলায় কাঁটার মতো বিঁধে ছিলেন। একই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বিশ্বের অন্যান্য দেশেও। একই ধরনের আন্দোলন গড়ে উঠেছে আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, ইরান, মিশর, চিলি, মেক্সিকো এবং লেবাননে। বিশ্বজুড়ে নারীরা নীরবতাকে চুরমার করে লড়ে যাচ্ছেন। প্রিয়জনকে হারানোর শোকের সঙ্গেসঙ্গে দুর্বহ সামাজিক এবং অর্থনৈতিক চাপ তাঁদের রুখে দাঁড়ানোর আর সক্রিয় থাকার রসদ যুগিয়েছে।

গুমের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে তাই বিশ্বজুড়ে নারীরাই অগ্রগণ্য যোদ্ধা হিসেবে এখন পর্যন্ত ভূমিকা রেখে আসছেন। বাংলাদেশেও গুমের বিরুদ্ধে কাজ করে যাওয়া সংগঠনটির নামেও এই লড়াইয়ে নারীদের অগ্রগণ্যতার ছাপটি স্পষ্ট: মায়ের ডাক। পুত্রহারা, স্বামীহারা, পিতা হারা, স্বজন হারা অজস্র নারীর প্রতিকী রূপে

মায়ের ডাকের কর্মসূচির একটা ভিডিও: https://youtu.be/dAtDH1iW21o

বিশ্বজুড়েই এখন গুমের ঘটনা বেড়ে চলেছে। মানবতার বিরুদ্ধে ঘটানো এই জঘন্য অপরাধটি ঘটেছে আর্জেন্টিনা, গুয়াতেমালা, সিরিয়া, লেবানন, ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশসহ আরো অনেক দেশে। বহু ক্ষেত্রেই এর পেছনে রয়েছে সরকার, জনপ্রিয় বিরোধী দল বা আন্দোলনকে দমন করার জন্য। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামেও আন্তর্জাতিক স্তরে গুমের একটি সংস্কৃতিকে ছড়িয়ে দেয়ার, এবং গুয়ানতানামো বের মত কয়েকটি কারাগারে তাদের আটক রাখার তোলার কাজটি করেছে মার্কিন নেতৃত্বাধীন চক্রটি। কোন কোন ক্ষেত্রে গুমের পেছনে রয়েছে প্রভাবশালী বিরোধী দলও। শ্রেণি-গোত্র-ধর্ম-রাজনৈতিক মতাদর্শ নির্বিশেষে গুমের শিকার হওয়া মানুষগুলোর পরিবারের নারীরাই দেশগুলোতে জীবন ও মর্যাদার অলঙ্ঘনীয় অধিকার  প্রতিষ্ঠার লড়াইটাকে এগিয়ে নিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করছেন।

তথ্যসূত্র: অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, আল-জাজিরা, দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট, তামিল গার্ডিয়ান, ফ্যামিলিজ ফর ফ্রিডম ওয়েবসাইট, ইউনাইটেড নেশনস ওয়েবসাইট, ইন্টারন্যাশনাল কাতালান ইন্সটিটিউট ফর পীস ওয়েবসাইট, ওপেন ডেমোক্রেসি ওয়েবসাইট।

আরো পড়ুন

আয়নাঘরের আয়নাবাজি ও নিশ্চুপ গণমাধ্যম: https://www.driknews.com/article/1660892450

কোথায় আছেন তাঁরা: গুম হওয়া মানুষদের নিয়ে সিজিএসের প্রতিবেদন: https://www.driknews.com/article/1661790537

রক্ষীবাহিনীর হাতে গুমের শিকার অরুণা সেনের বিবৃতি: https://www.driknews.com/article/1661793655

গুম বিষয়ে দুটি প্রশ্নের উত্তর: https://www.driknews.com/article/1661854101