- গোলাম মাওলা রনি
- ১৮ আগস্ট ২০২২
আজকের নিবন্ধটি কী দিয়ে যে শুরু করব ভেবে পাচ্ছি না। পুরো মাথা কেমন যেন আউলা-ঝাউলা হয়ে গেছে। চলমান সময়ের দেশ-বিদেশের হাজারো সমস্যা মাথার মধ্যে গিজ গিজ করছে এবং কিছু সমস্যা শরীর-মনে রীতিমতো রি রি করছে। বাংলাদেশের ক্ষমতাধর মানুষদের বেহেশত-দোজখ নিয়ে মাতামাতি, ক্ষমতাধরদের কোমল ও কচি শরীরে পুলিশের বেদম এবং বেধড়ক পিটুনি, ডিম এবং যাবতীয় নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি, বৃষ্টি বাদলহীন ভাদ্র মাসে প্রকৃতির বিরূপ আচরণের সাথে রাজধানীর উত্তরা এলাকায় গার্ডার দুর্ঘটনায় অনেক প্রাণের ভবলীলা সাঙ্গ হওয়ার ঘটনা একসাথে জড়ো হয়ে মন-মস্তিষ্কে ভয়ানক স্থবিরতা সৃষ্টি করেছে। ফলে অনেক সমস্যা একসাথে আর্তচিৎকার করে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে সবাইকে জানানোর উদগ্র তেজে মাথাটি আউলা-ঝাউলা হয়ে গেছে।
বাংলাদেশের ইদানীংকালের প্রায় সব সমস্যাই মূলত আওয়ামী লীগ সরকারের তথাকথিত উন্নয়নের বদহজম এবং অতিভোজনসংক্রান্ত। উন্নয়নের প্রসবজনিত জটিলতার কারণেও হাজারো সমস্যা পুরো দেশবাসীকে অক্টোপাসের মতো আঁকড়ে ধরেছে। উন্নয়নজনিত সমস্যা একটি দেশ-জাতি ও কালকে কতটা সর্বনাশের পথে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে পারে তার বাস্তব রূপ কবি শঙ্খ ঘোষ অল্প কয়েকটি শব্দের মাধ্যমে যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তা আপনার আমার মতো আমজনতা হাজার পৃষ্ঠার গদ্য-পদ্য রচনা করেও প্রকাশ করতে পারতাম না। কবি শঙ্খ ঘোষ বলেন-
‘দেখ খুলে তোর
তিন নয়ন
রাস্তাজুড়ে খড়গ
হাতে
দাঁড়িয়ে আছে
উন্নয়ন।’
শঙ্খ ঘোষের ‘মুক্ত গণতন্ত্র’ কবিতার উল্লিখিত কথামালার ভাব সম্প্রসারণের সাধ্য আমার নেই। তবে মনে বড় সাধ জাগে যদি প্রাণভরে তিন নয়ন এবং উন্নয়নের খড়গ নিয়ে কিছু লিখতে পারতাম। কিন্তু আমার সেই সাধ পূরণের কোনো চেষ্টাই আজকের নিবন্ধে করব না। কারণ, এই বিষয়ে বিস্তারিত লেখার আগে হঠাৎ করেই তাবৎ দুনিয়ার অন্যতম, সর্বকালের সেরা পণ্ডিত গ্যাটের একটি অমূল্য বাণীর কথা মনে এলো। তিনি বলেন- ‘একটি জাতি অধঃপতনের কোন স্তরে পৌঁছে গেছে তা বোঝার জন্য সেই জাতির শিল্প-সাহিত্যের অধঃপতনের নমুনা দেখলেই অনুমান করা সম্ভব।’
আমার ভয় হচ্ছে- উন্নয়নের প্রবক্তারা যদি নিবন্ধটি পড়েন এবং কবি শঙ্খ ঘোষ অথবা গ্যাটে সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করে বসেন! সে জন্য অতি সংক্ষেপে এই দুই মহামানব সম্পর্কে কিছু তথ্য পরিবেশন আবশ্যক। আমাদের দেশে মীর জাফর যখন ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির পোষা প্রাণীরূপে, সিংহাসনের পুতুলরূপে একের পর এক অপকর্ম করে যাচ্ছিল ঠিক তখন জার্মানি তথা পুরো ইউরোপের শিল্প-সাহিত্য, দর্শন, রাজনীতি, বিজ্ঞান, নাট্যকলা সঙ্গীতসহ মানবজীবনের সৃজনশীলতার প্রায় সব শাখায় এক অনবদ্য সৃষ্টিশীলতার ঝড় তুলেছিলেন জোহান ফন গ্যাটে, যার প্রভাব এখন পর্যন্ত সারা বিশ্বে বিদ্যমান। কাজেই গ্যাটের সূত্র অনুযায়ী আমরা যদি বাংলাদেশের গত এক যুগের শিল্প-সাহিত্য নাটক-সিনেমা একই গানবাজনার বাস্তব রূপ পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা করি তবে দেখতে পাবো যে, ইদানীংকালের উন্নয়নের বাংলাদেশের টিকটক ভিডিওর চেয়ে জনপ্রিয় অন্য কোনো নাটক-সিনেমা নেই। চলচিত্রের কিংবদন্তিরূপে আমাদের আকাশে নক্ষত্রের মতো আলোক বিতরণ করছেন সর্বজনাব অনন্ত জলিল ও হিরো আলম। সঙ্গীতের ভুবনে হিরো আলম ছাড়াও মমতাজ ও ড. মাহফুজ রীতিমতো বিস্ময়কর আলোচনা-সমালোচনা সৃষ্টি করে চলেছেন। দেশের মূল ধারার শীর্ষ পত্রপত্রিকা অথবা গণমাধ্যমের প্রধান খবর হয় অমুক নায়িকার গর্ভজাত সন্তান কবে ভ‚মিষ্ঠ হবে এতদসংক্রান্ত নায়িকার গর্ভাবস্থার ঢাউস আকৃতির ছবি। পাঠকরা সেসব ছবি দর্শনান্তে সাধু! সাধু! রবে পত্রিকার সম্পাদকদের মেধা-মননের প্রশংসায় আবেগতাড়িত হয়ে অশ্রæজল বিসর্জন করে। গত এক যুগের জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে, মাইয়্যারে তুই অপরাধী, পোলারে তুই অপরাধী এবং তাহেরীর জিকিরের টিকটক হু-হার রেকর্ড ব্রেক করা যায়নি। চলমান যুগের আগের যুগের গানগুলোর মধ্যে মেগা হিট গান ছিল মমতাজের ‘ফাইটা যায়’।
উল্লিখিত তথ্য-উপাত্ত এবং গ্যাটের সূত্র যদি পাশাপাশি রাখা হয় তবে খুব সহজে আমরা আমাদের জাতীয় উন্নয়নের রূপরেখার মানদণ্ড এবং উন্নয়নের জোয়ারে আমাদের শিল্প-সাহিত্যের অঙ্গনে কী পয়দা হয়েছে তা খুব সহজে অনুমান করতে পারব।
গ্যাটে প্রসঙ্গ ছেড়ে এবার শঙ্খ ঘোষ সম্পর্কে কিছু বলি। বাংলাদেশের চাঁদপুর জেলায় ১৯৩২ সালে জন্ম নেয়া বর্তমান শতাব্দীর বিশিষ্ট কবি শঙ্খ ঘোষ মারা যান ২০২১ সালে। তার প্রকৃত নাম চিত্তপ্রিয় ঘোষ এবং কর্মজীবনে তিনি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ব ভারতীতে বাংলার অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তার কবিতা এবং অন্যান্য সাহিত্য বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তি হয়ে আছে। তিনি যে ধাঁচে কবিতা রচনা করেছেন এবং যেভাবে সমসাময়িক বিষয়াদি ফুটিয়ে তুলেছেন তা বোদ্ধা মহলে আলোড়ন তুলেছে। তিনি যে সমাজ ও রাষ্ট্রে বসবাস করতেন, তা কবির কর্মগুণে বিশ্বদরবারে বিশেষ মর্যাদা লাভ করেছে। তার কবিতার তেজ বোঝার জন্য কবি রচিত ‘সবিনয় নিবেদন’ কবিতাটি উল্লেখ করার লোভ সংবরণ করতে পারছি না-
আমি তো আমার শপথ রেখেছি
অক্ষরে অক্ষরে
যারা প্রতিবাদী তাদের জীবন
দিয়েছি নরক করে।
দাপিয়ে বেড়াবে আমাদের দল
অন্যে কবে না কথা
বজ্র কঠিন রাজ্য শাসনে
সেটাই স্বাভাবিকতা।
গুলির জন্য সমস্ত রাত
সমস্ত দিন খোলা
বজ্র কঠিন রাজ্যে এটাই
শান্তি শৃঙ্খলা।
যে মরে মরুক, অথবা জীবন
কেটে যাক শোক করে-
আমি আজ জয়ী, সবার জীবন
দিয়েছি নরক করে।
গ্যাটে, শঙ্খ ঘোষ ছাড়াও আরো একজন মহান ব্যক্তির উক্তি আমাকে নিদারুণভাবে তাড়িত করছে। ভদ্রলোকের নাম ভলতেয়ার। ফরাসি লেখক ও দার্শনিক। তার জীবনকাল ছিল ১৬৯৪ থেকে ১৭৭৮। সেই সময়ে তিনি লিখে গেছেন, কোনো মানুষের প্রশ্ন করার ধরন ও প্রকৃতি দ্বারা তাকে মূল্যায়ন করবে। কারো উত্তর দেয়ার ভঙ্গি বা বাকচাতুর্য দিয়ে তাকে মূল্যায়ন করা সম্ভব হয় না। এখন ভলাতেয়ার যে বললেন মানুষের প্রশ্ন করার সক্ষমতা সম্পর্কে- তা ২০২২ সালের বাংলাদেশে কতটুকু অবশিষ্ট আছে। আমরা কি সব ব্যাপারে প্রশ্ন করতে পারছি? উত্তর পাওয়া কিংবা উত্তর দেয়া তো অনেক পরের বিষয়। প্রথমে যদি আমরা চিন্তা করি প্রশ্ন করার যোগ্যতা সম্পর্কে তাহলে দেখতে পাবো, খুব অল্প লোকের মাথায় সাধারণত প্রশ্নের উদ্রেক হয়। বেশির ভাগ মানুষ প্রশ্ন করার পরিবর্তে বক্তব্য শুনতে পছন্দ করেন। দ্বিতীয় সারির একধরনের মানুষ রয়েছে যারা কালেভদ্রে প্রশ্ন করেন প্রধানত দু’টি কারণে। প্রথমত, প্রয়োজনে, দ্বিতীয়ত মনোরঞ্জনে।
প্রয়োজনের প্রশ্নগুলো এমন- গুলিস্তান কোন দিকে- আশপাশে টয়লেট আছে কি না অথবা আজ কী রান্না হয়েছে ইত্যাদি। মনোরঞ্জনের প্রশ্নগুলো কেমন হয় তার চাক্ষুষ প্রমাণ পাওয়া যাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিভিন্ন সংবাদ সম্মেলনে অভ্যাগতদের প্রশ্নের ধরন ও প্রকৃতির কলাকৌশল পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে। ভলতেয়ার যে প্রশ্নের কথা বলেছেন তার উদ্রেক হয় মষ্কিষ্ক থেকে ও প্রাণের তাগিদে এবং জগতের প্রয়োজনে যেসব প্রশ্ন মস্তিষ্ক থেকে কণ্ঠনালী হয়ে পৃথিবীর বাতাসে কম্পন সৃষ্টি করে তা বহু স্বৈরাচারের মসনদকে তছনছ করে দেয়। এ ব্যাপারে ভারিক্কি আলোচনায় না গিয়ে প্রশ্নসংক্রান্ত দুটো রসাত্মক ঐতিহাসিক উদাহরণ দিয়ে আজকের আলোচনার উপসংহারে চলে যাবো।
প্রথম উদাহরণটি স্বাধীনতা-পূর্ব সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় জাতীয় দৈনিক ইত্তেফাকসংক্রান্ত। সম্পাদক মানিক মিয়া প্রাণান্ত চেষ্টা করে চলছেন যেন পত্রিকাটিতে কম বানান ভুল হয়। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো- তিনি ভুল কমানোর জন্য যত বেশি জোরাজুরি শুরু করলেন ততই ভুলের পরিমাণ বাড়তে থাকল। এ অবস্থায় তিনি একটি বৈঠকের আয়োজন করেন যেখানে ইত্তেফাকের সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক ও প্রুফ রিডাররা উপস্থিত ছিলেন। মানিক মিয়া বললেন- তোমাদের যখন সন্দেহ হবে যে বানানটি ভুল তখন সাথে সাথে ডিকশনারিতে খুঁজবে। কোনো শব্দের নির্ভুল বানান যদি ডিকশনারিতে না পাও, তবে আমার কাছে নিয়ে আসবে। কিন্তু তোমরা সেটা না করে কেন বারবার একই ভুল করছ? মানিক মিয়ার কথায় সবাই নিশ্চুপ। তিনি হুঙ্কার দিয়ে বললেন- জবাব দাও। কেন ভুল করো। কেন! কেন! কেন! পেছন থেকে মাথা নিচু করে জনৈক ব্যক্তি উত্তর করলেন- স্যার, বানানটি যে ভুল, এই রকম কোনো সন্দেহ আমাদের মনে আসে না। দ্বিতীয় উদাহরণটি সোভিয়েত ইউনিয়নের একসময়ের দুর্দান্ত রাষ্ট্রনায়ক নিকিতা ক্রুশ্চেভ জমানার। জোসেফ স্ট্যালিনের মৃত্যুর পর ক্রুশ্চেভ ক্ষমতায় বসেন। স্ট্যালিন জমানায় ক্রুশ্চেভ ছিলেন রাষ্ট্রের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এবং স্ট্যালিনের দক্ষিণহস্ত। তিনি স্ট্যালিনকে বাবা ডাকতেন এবং তার সব কর্মে তিনি প্রধান সহযোগীরূপে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে স্ট্যালিনের উত্তরাধিকারী মনোনীত হন। ক্ষমতালাভের পর তিনি লেনিন টুম্ব থেকে স্ট্যালিনের মরদেহ তুলে ভলগা নদীতে ফেলে দেন এবং রাশিয়ার পার্লামেন্টের দীর্ঘ বক্তব্যে তিনি স্ট্যালিনের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করেন। তিনি যখন সংসদে স্ট্যালিনবিরোধী বক্তব্য দিচ্ছিলেন তখন পেছন থেকে একজন বলে ওঠেন- আজ আপনি এত কিছু বলছেন! তো সেই সময় আপনি কোথায় ছিলেন? প্রশ্ন শুনে ক্রুশ্চেভ হুঙ্কার দিয়ে ওঠেন- কে! কে বলল! সাহস থাকে তো দাঁড়িয়ে বলো। পুরো সংসদে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। কবরের নিঃসীম নীরবতা চলে এলো। সবাই মাথা নিচু করে রইল। এবার ক্রুশ্চেভ বিজয়ের হাসি দিয়ে বললেন- এবার বুঝেছ! আমি তখন কোথায় ছিলাম। আজ তুমি যেখানে আছো- আমিও সে দিন সেখানেই ছিলাম।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য