রিজার্ভ বাড়বে, সরকার স্বস্তি পাবে না

রিজার্ভ বাড়বে, সরকার স্বস্তি পাবে না। – ছবি : নয়া দিগন্ত


আওয়ামী লীগ সরকারের অতীত উল্লম্ফন এবং আত্মতৃপ্তি হাল আমলে এসে কতটা বুমেরাং হয়েছে তা তারা না বুঝলেও জনগণ কিন্তু হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। জাতীয় উন্নয়নের নামে বড় বড় মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের রাশ টেনে ধরার ব্যর্থতার কারণে অর্থনীতি যে সঙ্কটের মধ্যে পড়বে তা কিন্তু দেশী-বিদেশী অর্থনীতিবিদরা সেই ২০১২ সাল থেকে ক্রমাগত বলে আসছিলেন। উন্নয়নের সাথে দুর্নীতি, টাকা পাচার ও ঋণের সমন্বয় করতে না পারলে জাতীয় অর্থনীতি কতটা বিপদ ও বিপত্তির মধ্যে পড়ে তা নিয়েও বিশেষজ্ঞরা বহুবার আওয়ামী সরকারকে সতর্ক করেছেন। কিন্তু অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস ও অহমিকাবোধে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা প্রায় সব ক্ষেত্রেই সতর্ককারীদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছেন এবং অনেক অপমান পর্যন্ত করে ছেড়েছেন।

এ অবস্থায় ২০২২ সালের আগস্ট মাসে এসে বাংলাদেশের সার্বিক অবস্থা এতটা সঙ্গীন হয়ে পড়েছে যে, পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য কোনো একক উপায় খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সঙ্কটের কারণ হিসেবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্যবৃদ্ধি ইত্যাদি প্রদর্শন করা হলেও নির্মম বাস্তবতা হলো- যুদ্ধের কোনো নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া আমাদের দেশে এখনো পড়েনি। কারণ সরকারি হিসাবেই বলা হচ্ছে যে, রেমিট্যান্স বেড়েছে। রফতানি বেড়েছে, স্থানীয় রাজস্ব যথা- আয়কর, ভ্যাট, অবগারি শুল্ক থেকে শুরু করে বিয়েশাদীর কাবিননামা থেকে আহরিত রাজস্ব অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে উন্নতির চূড়ান্ত সোপানে পৌঁছে গেছে। তাহলে কেন সরকার ভয় পাচ্ছে?

সরকারি হিসাবে জনগণের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। আদমশুমারি অনুযায়ী, জনসংখ্যার হিসাব খুবই সন্তোষজনক। অন্য দিকে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হিসেবে যে পরিমাণ অর্থের কথা বলা হচ্ছে তা দিয়ে হিসাব করে চললে অন্তত ছয় মাস চলার কথা। আর রিজার্ভের অর্থ দিয়ে অর্থাৎ ৪০ বিলিয়ন ডলার দিয়ে যদি চাল-ডাল-ভোজ্যতেল ও হ্যারিকেন জ্বালানোর কেরোসিন কেনা হয় তবে কয়েক বছর নাকে তেল দিয়ে ঘুমানো যাবে। কিন্তু তার পরও কেন আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, জাইকা প্রভৃতি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের কাছে নজিরবিহীন মোটা অঙ্কের বিদেশী ঋণের জন্য ধরনা দেয়া হচ্ছে তার নেপথ্য কারণ বলতে গেলে অনেকের চাকরি থাকবে না।

সমালোচকদের মতে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমস্যার হাত ধরেই অর্থনৈতিক সমস্যার জগতে প্রবেশ করেছে। অনৈতিক ক্ষমতা, নিষ্ঠুর অর্থলিপ্সা, দেশপ্রেম বর্জিত লুটেরা শ্রেণীর অবাধ বিচরণ এবং আধিপত্যের কারণে ন্যায়বিচার ও সুশাসন রসাতলে গেছে। ব্যবসা-বাণিজ্য ও জীবন-জীবিকার সব ক্ষেত্রে সুষম প্রতিযোগিতার পরিবর্তে সিন্ডিকেটের আধিপত্য এতটাই প্রকট হয়ে পড়েছে যে, একজন দুর্নীতিবাজ প্রভাবশালী বাধ্য হচ্ছেন অন্য দুর্নীতিবাজদের ঘুষ দিতে। চাকরি-বাকরি, ব্যবসায়-বাণিজ্য, নিয়োগ-বদলি, আমদানি-রফতানি থেকে শুরু করে ভিক্ষাবৃত্তি, চোরাচালানি অথবা আন্ডার ওয়ার্ল্ডের মাস্তানি চাঁদাবাজিতেও কোনো চেইন অব কমান্ড নেই। ফলে যে যার অবস্থানে রীতিমতো দানবীয় ভ‚মিকায় অবতীর্ণ হয়ে এক দানব অপর দানবকে শেষ করার যে মরণ খেলা চালু করেছে তার ফলে সর্বত্র অস্থিরতা, ভয়, আতঙ্ক এবং অনিশ্চয়তার ঘোর অমানিশা শুরু হয়েছে।

অমানিশার রাতে যদি আপনার হাতে হ্যারিকেন-টর্চলাইট অথবা নিদেনপক্ষে আবহমান বাংলার খড়কুটোর তৈরি মশাল না থাকে তবে পথ চলা যে কতটা কঠিন তা যারা ভুলতে বসেছিলেন তারা ২০২২ সালের আগস্ট মাসের বাজার দর, ডলারের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি, সীমাহীন লোডশেডিং, বেকারত্ব ইত্যাদির চাপে পড়ে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন জীবনের বোঝা কতটা ভারী হতে পারে। চলমান সঙ্কটে দরিদ্রের কান্না-মধ্যবিত্তের হাপিত্যেস এবং সচ্ছল ও সৎ ব্যবসায়ীদের হাহাকার দূর করার জন্য যে বিশ্বাসযোগ্য প্রশাসনিক কাঠামো দরকার তা আছে কিনা তা বুঝার জন্য বড় বড় কর্তাদের পিয়ন-ড্রাইভার-দারোয়ান অথবা বাসার কাজের বুয়ার কাছ থেকে চারিত্রিক সার্টিফিকেট আনা হলে এমন সব গোমর ফাঁস হয়ে যাবে যা আপনার আমার মন-মস্তিষ্ক হয়তো কল্পনাও করতে পারছে না।

উল্লিখিত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এই মুহূর্তের হাজার হাজার জাতীয় সমস্যার মধ্যে কোন ১০টি সমস্যা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিষ্পত্তি করা দরকার তা নির্ধারণের পরিবর্তে শিশু ভোলানো গল্পের আবাদ এবং সব কিছু ধামাচাপা দিয়ে গোবরে পদ্মফুলের আবাদ করা অথবা উলুবনে মুক্তা ছড়ানোর মতো কাণ্ডকারখানা করা হচ্ছে কিনা তা অচিরেই টের পাওয়া যাবে। চলমান সঙ্কটগুলোর মধ্যে সরকার সম্ভবত মনে করছে যে, এই মুহূর্তে ডলার সঙ্কটই হলো প্রধানতম জাতীয় সমস্যা। দ্বিতীয়ত, তারা এ কথা মনে করছে যে, যদি রিজার্ভ বাড়ানো যায় এবং ডলার সঙ্কট দূর করার জন্য যেভাবে বিএনপি-জামায়াতের লোকদের ধরার জন্য সাঁড়াশি অভিযান চালানো হয় একইভাবে ডলার ব্যবসায়ী, মজুদকারী, হুন্ডিকারীসহ দালাল ফড়িয়াদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন চালানো হয় তবে সুবে বাংলার রাজনীতির ময়দানের মতো সব কিছু ফকফকা হয়ে যাবে। আর তখন লোডশেডিং প্রবল হলেও মানুষ হাওয়া-বাতাস-পানি ও চাঁদের আলোতেই সন্তুষ্ট থাকতে পারবে।

দ্বিতীয়ত, সরকার মনে করছে যে, বাঙালির পেটে ভাত থাকলে আর কিছু লাগে না। পেট পুরে যদি কাউকে খাওয়ানোর পর তার পিঠে চাবুকের ঘা মারা হয় তবুও বাঙালির সহ্যের সীমা অতিক্রান্ত হয় না বলেই বহু প্রবাদ ও প্রবচন রচিত হয়েছে। বাঙালির এই স্বভাবের কারণেই সরকার সব কিছু বাদ দিয়ে কেবল খাদ্যশস্য আমদানির কথা চিন্তা করছে এবং সরকারপ্রধান বেশ দৃঢ়তার সাথেই বলে দিয়েছেন, বর্তমান রিজার্ভ দিয়ে ছয় মাসের খাদ্য আমদানি সম্ভব। সরকারপ্রধানের কথার জবাব দেয়ার জন্য কেউ বলেনি যে, খাদ্য ছাড়াও আমাদের বস্ত্র, বাসস্থান, ওষুধ-চিকিৎসার পাশাপাশি জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ আরো অনেক নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী দরকার। যা হোক, সরকার তার আপন বুদ্ধিমত্তা ও প্রজ্ঞা দিয়ে যেটা আন্দাজ করতে পারেনি সেটা হলো তাদের আশপাশে ঘূর্ণায়মান সিন্ডিকেটই অন্যসব অপকর্ম বাদ দিয়ে এখন ডলার সঙ্কটকে পুঁজি করে খুব দ্রুত টাকা কামানোর ধান্ধায় নেমেছে।

সরকার আপাতত যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে তা যদি অব্যাহত রাখে তাহলে আগামী ছয় মাসে হয়তো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ পঞ্চাশ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। কিন্তু রিজার্ভ বৃদ্ধি করার জন্য যেসব কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে তার ফলে ডলারের সাথে টাকার বিনিময় হার পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কার মতো হয়ে যেতে পারে। আমদানি বাণিজ্য যদি অর্ধেকে নেমে আসে তবে পোর্ট, কাস্টমস, ব্যাংক-বীমাসহ দেশের পরিবহন খাত মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে। সরকার জ্বালানি তেল ও এলএনজি আমদানির ক্ষেত্রে চলমান নীতি অনুসরণ করলে এবং দেশে লোডশেডিং চালিয়ে গেলে আগামী ছয় মাসের মধ্যে পুরো রফতানি খাতে ভয়াবহ বিপর্যয় অনিবার্য। অনেক শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে- অনেকগুলো রুগ্ন হয়ে পড়বে এবং বাকিরা অসম প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়ে যাবে।

ডলারের মূল্যবৃদ্ধি বা মাঝে মধ্যে উত্থান-পতনের ফলে দেশের বাজারে কী ধরনের মহামারী বা মড়ক সৃষ্টি করেছে তা বোঝার জন্য সরকারের উচিত গত দুই মাসে ইলিশ মাছ এবং গুঁড়া চিংড়ির দাম কিভাবে কত শতাংশ হারে ক্রমাগত বেড়ে গেছে সেটা খতিয়ে দেখা। অন্য দিকে, তারা যদি ঢাকার বস্তিগুলোতে জরিপ চালায় এবং বস্তিবাসীর রাতের খাবারের মেন্যুতে গত দুই মাসে কী পরিবর্তন সাধিত হয়েছে তা যদি পর্যবেক্ষণ করে এবং সরকারের আশপাশের লোকজনের মেদভুঁড়ির হালনাগাদ আকার আকৃতি ও ব্যস পরিমাপ করে তবে খুব সহজেই চমৎকার একটি অনুসিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারবে। কিন্তু সরকার বাস্তব সমস্যা আড়াল করে যেসব সমস্যা সামনে নিয়ে আসছে তাতে দেশের ব্যাস্টিক অর্থনীতি মারাত্মক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে।

সরকারের কর্তাব্যক্তিদের মধ্যে যারা মার্কেন্টাইল অর্থনীতি ভালো বোঝেন তারা যদি ষোড়শ শতাব্দীর ইউরোপের রাজনীতি এবং অস্ট্রিয়া, রাশিয়ার যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের যুদ্ধের পটভ‚মি পর্যালোচনা করেন তবে বর্তমান ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের পরিণতি কী হতে যাচ্ছে তা সহজেই অনুধাবন করতে পারবেন। তারা যদি চলমান যুদ্ধে বাংলাদেশের ঝুঁকি সম্পর্কে আরো সচেতন হন তবে ষোড়শ শতাব্দীর রাশিয়া-অস্ট্রিয়া যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে দক্ষিণ ভারতে সঙ্ঘটিত প্রথম-দ্বিতীয় ও তৃতীয় কর্নাটক যুদ্ধ কেন এবং কিভাবে ভারতকে শেষ করে দিয়েছিল তা অনুসন্ধান করে দেখতে পারেন। যারা ইতিহাসের ছাত্র নন তাদের বলছি, কর্নাটক যুদ্ধ হয়েছিল মূলত ইংরেজ ও ফরাসিদের মধ্যে কিন্তু এই যুদ্ধের পরিণতিতে প্রথমে পুরো দক্ষিণ ভারত পরে বাংলা এবং সর্বশেষ পাক-ভারত উপমহাদেশ ব্রিটিশ কর্তৃত্বে চলে গিয়েছিল।

আপনি যদি ইতিহাসের আলোকে বাংলাদেশের চলমান সঙ্কটের বিষয়ে আমার মতামত জিজ্ঞাসা করেন তবে আমি নির্দ্বিধায় বলব যে, বর্তমান সময়ে যেগুলোকে সঙ্কট বলা হচ্ছে তা মূলত স্বল্পকালীন সমস্যা, যা সময়ের সাথে তালমিলিয়ে সমাধান করতে হবে। অর্থনীতির চাকা যদি সচল থাকে তবে ডলারের বিনিময় মূল্য এক মার্কিন ডলারের বিপরীতে ২০০ টাকা হলেও কোনো অসুবিধা নেই। অথবা জ্বালানি তেলের মূল্য বর্তমান বাজার দরের চেয়ে দ্বিগুণ বা তিনগুণ হলেও সঙ্কট সৃষ্টি হবে না। বরং অর্থনীতির চাকা যদি বন্ধ হয়ে যায় অথবা উল্টো দিকে ঘুরতে থাকে তবে ১০০ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ, ডলারের বিনিময় হার বর্তমানের চেয়ে কম এবং জ্বালানি তেলের মূল্য হ্রাস করলেও কোনো কাজ হবে না। বরং প্রতিটি স্বল্পমেয়াদি সমস্যা দীর্ঘমেয়াদি সঙ্কটে পরিণত হবে।

আমার মতে, চলমান সব সমস্যা অথবা সঙ্কটের মূলে রয়েছে সরকার সম্পর্কে জনগণের ভয়ভীতি, অবিশ্বাস, অনাস্থা ও অশ্রদ্ধা। অন্য দিকে, সরকারের কর্তাব্যক্তিদের কর্তৃত্ববাদী মনোভাব, সরকারে যোগ্য-কর্মঠ ও দক্ষ লোকবলের অভাব এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বন্ধুহীন হয়ে পড়া। এসবের বাইরে দেশের গণতন্ত্রহীনতা, বিচারবহিভর্‚ত হত্যা, গুম, ক্ষমতার অপব্যবহার ও জবাবদিহিতার অভাবের বিষয়ে দুনিয়ার সভ্য ও উন্নত দেশ হিসেবে পরিচিত পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর কাছে ইমেজ সঙ্কটের কারণেও বর্তমান সমস্যাগুলো সঙ্কটে পরিণত হয়ে শ্রীলঙ্কা বা পাকিস্তানের পরিস্থিতি যে ঘটাবে না তা কিন্তু হলফ করে বলা যাচ্ছে না।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য