- মো: আতিকুর রহমান
- ০২ আগস্ট ২০২২, ১৯:৪৯
উন্নয়ন প্রশাসনকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার পাশাপাশি দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে শক্তিশালীকরণ অধিক জরুরি। এ ধরনের প্রশাসনের দুর্বল দিকগুলো যথাযথ সংস্কার করে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও গ্রামীণ দারিদ্র্যপীড়িত জনগণের মৌলিক অধিকার নিশ্চিতকরণের পাশাপাশি তাদের জীবন ধারার মানোন্নয়নে এ ধরনের প্রশাসন ব্যবস্থা কার্যকরীকরণ বর্তমান দেশের জন্য একান্ত অপরিহার্য।
জনগণের ক্ষমতায়ন, আইনের শাসন, জবাবদিহিতা ও স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করা ব্যতীত বিক্ষিপ্ত এবং অপরিকল্পিতভাবে টাকা ব্যয় করে দারিদ্র্যবিমোচন করা সম্ভব নয়। সব পর্যায়ে গণতন্ত্রায়নের জন্য প্রয়োজন নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার। যে ব্যবস্থায় অসহায় গরিব মানুষ নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে ক্ষমতায় যেতে পারে। যেখানে পুঁজিবাদীদের কুদৃষ্টি এ কাজের প্রধান প্রতিবন্ধকতা ও দেশের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় প্রধান অন্তরায়। দেশের অর্ধেক মানুষকে দারিদ্র্যসীমার নিচে স্থিতাবস্থায় রেখে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নসহ সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। এ জন্য দরিদ্র জনগণের দিকে লক্ষ করে হলেও স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে কার্যকরী ও শক্তিশালীকরণ পাশাপাশি ক্ষুদ্র ঋণের প্রসার সাধনে সরকার, ব্যাংক এবং এনজিওদের সহযোগিতার হাত সম্প্রসারণ করা অধিক জরুরি।
এমনিতেই এ দেশের জনগণ চলমান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নানাবিধ বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে কোনোরকম দিন অতিবাহিত করছে। এর মধ্যে আবার দ্রব্যমূল্যের সীমাহীন ঊর্ধ্বগতি, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, বাড়িভাড়া ও জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির পাশাপাশি সেগুলোর দারুণ সঙ্কটের কারণে বর্তমানে এ দেশের জনগণ এক প্রকার দিশেহারা ও ওষ্ঠাগত হয়ে পরেছে।
বর্তমানে পুঁজিবাদীদের কথামতো মুক্তবাজার অর্থনীতি গ্রহণ করতে গিয়ে আমাদের মতো দেশগুলো তাদের শর্তের ফাঁদে পড়ে আত্মঘাতী ধ্বংসাত্মক দিকে আমরা ক্রমাগত অগ্রসর হচ্ছি, যা সত্যিই ভয়াবহ ভীতির কারণ। এ ক্ষেত্রে এ দেশে পুঁজিবাদীরা তাদের উৎপাদিত পণ্যের বাজার স¤প্রসারণ, প্রচার ও প্রসার করছে ঠিকই কিন্তু পক্ষান্তরে আমাদের দেশের উৎপাদিত পণ্যের বাজার ধনী রাষ্ট্রগুলোতে প্রবেশের ক্ষেত্রে তৈরি করছে হাজারো শর্তের দেয়াল। এ ক্ষেত্রে আমাদের বিকল্প পথ দেখতে হবে, এ ধরনের বিশাল বৈষম্য রোধে নতুন অর্থনৈতিক নীতি প্রবর্তন করতে হবে এবং নতুন অর্থনৈতিক দর্শনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। যেখানে সামাজিক বাজার অর্থনীতি, সমাজ ও রাষ্ট্র মূল প্রহরীর ভ‚মিকা পালন করবে।
এ ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকারকেন্দ্রিক উন্নয়ন ভাবনা সংবিধান নির্দেশিত পথে যথাযথ পরিচালিত করতে হবে- এ ব্যাপারে নীতি নির্ধারকদের কোনো প্রকার টালবাহানা চলবে না, এর জন্য স্থানীয় সরকারের অনুক‚লে প্রয়োজনীয় অর্থায়ন ও ক্ষমতায়ন যথাযথ প্রদানের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। সম্ভব হলে ৪০ শতাংশ রাজস্ব বাজেট সরাসরি স্থানীয় সরকারকে দিতে হবে। সব সিডিউল ব্যাংকের কমপক্ষে ৫-৬ শতাংশ দারিদ্র্যবিমোচনের জন্য দিতে হবে। স্থানীয় সরকারকে গ্রামীণ জনগণের জন্য উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে তৈরি করতে হবে। স্থানীয় সরকারের সাথে গ্রামীণ অর্থনীতি ও গ্রামীণ অর্থনীতির সাথে জাতীয় অর্থনীতির সংযোগ স্থাপন করতে হবে। এগুলো করতে পারলে দারিদ্র্যবিমোচনের পথ সুগম হবে ও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হবে বলে আমরা আশা রাখি।
দারিদ্র্যবিমোচনের ক্ষেত্রে ভূমি সংস্কারের দিকেও সরকারকে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পের জন্য অধিক বরাদ্দ এবং বিনিয়োগ বোর্ডকে কার্যকরী করতে হবে। কৃষিপণ্য উৎপাদন ও রফতানির জন্য সরকারকে বিশেষ সহযোগিতা দানের ব্যবস্থা করতে হবে। গ্রামীণ অবহেলিত জনগণের জন্য দুর্যোগ তহবিল ট্রাস্ট গঠন করতে হবে। এক পদ্ধতির শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে হবে। জিডিপিতে শিক্ষা খাতে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ রাখতে হবে। শর্তহীন বাজার অর্থনীতি বাতিল করতে হবে। উৎপাদিত পণ্য ও কৃষিক্ষেত্রের ওপর অধিক ভর্তুকি দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে লাভ-ক্ষতির বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। আমাদের দেশের সামাজিক পরিবর্তনের ধারক যেমন- ক্ষুদ্র চাষি, প্রবাসী শ্রমিক, ক্ষুদ্রশিল্প মালিক, গামের্ন্ট ও টেক্সটাইল শ্রমিক, কামার, কুমার, জেলে, তাঁতী ও পেশাজীবী গোষ্ঠী এদের যথাযথ ক্ষমতায়ন করতে হবে। এদের বাদ দিয়ে দেশে দারিদ্র্যবিমোচন সম্ভব নয়। তাই রাষ্ট্রের উচিত দারিদ্র্যবিমোচনের জন্য এদের হাতকে আগে অধিক শক্তিশালী করা।
বর্তমানে আমাদের দেশের নীতিনির্ধারক, রাজনীতিবিদ, আমলা, উচ্চবিত্ত- এদেরকে কথায় নয়, সত্যিকার অর্থে দেশপ্রেমিক হতে হবে এবং ধনী ও গরিব, গ্রাম ও শহরের মধ্যে বৈষম্য রোধে একদৃষ্টি মনোভাব ও কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। মূলত এ বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে ভ‚মি ব্যবস্থার অসম মালিকানা ও বণ্টনের মাধ্যমে, ট্যাক্সের টাকা প্রতিরক্ষাসহ নীতিনির্ধারকদের ব্যক্তিগত অন্যান্য খাতে অধিক ব্যয়ের মাধ্যমে। যদিও আমরা সবাইকে ভালোভাবে জানি, এ দেশে পুঁজিবাদীদের স্বার্থরক্ষা করে এই রাষ্ট্রের একার পক্ষে দারিদ্র্য হ্রাস করা করা সম্ভব নয়। তারপরও আশা রাখি, যদি এ দেশের নীতিনির্ধারকরা দারিদ্র্যবিমোচনকে গুরুত্বপূর্ণ অ্যাজেন্ডায় রেখে কৃষিপ্রধান আমাদের এই দেশে প্রয়োজনীয় কৃষি ব্যবস্থার সংস্কার, সর্বজনীন আধুনিক শিক্ষা, কৃষি ও কারিগরি শিক্ষা সবার জন্য নিশ্চিতকরণের পাশাপাশি স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে স্থানীয় পর্যায়ে উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ ও স্থানীয় উন্নয়নে স্থানীয় প্রশাসনের বাজেট প্রণয়ন জরুরি এবং তা যথাযথ বাস্তবায়ন করার পথ তৈরী করা যায় তবে দারিদ্র্যবিমোচনের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি পাওয়া যাবে। এ ক্ষেত্রে মুক্তবাজার অর্থনীতির নামে পুঁজিবাদের থাবা থেকে দেশ ও জাতিকে মুক্ত করতে হবে। যতদিন পর্যন্ত না এই থাবা থেকে আমরা মুক্তি পাচ্ছি ততদিন পর্যন্ত দারিদ্র্য হ্রাস করা সম্ভব হবে না।
এ কাজটি বাস্তবায়নে সরকারকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক- সব পর্যায়ের ব্যক্তির মতামত ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে নতুন অর্থনৈতিক দর্শনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে এবং দারিদ্র্যবিমোচনে উদ্যোগী হতে হবে। এ ক্ষেত্রে নিজেদের সমস্যা নিজেদেরই সমাধানের পথ আবিষ্কার করতে হবে।
অতি স্বল্পসময়ের মধ্যে আমাদের এই ছোট দেশের ঈষর্ণীয় অগ্রগতি ও বড় বড় সাফল্য যা অন্য দেশকে ভাবিয়ে তুলছে। আবার অনেকের কাছে আমাদের এই অগ্রগতি তাদের চোখের শূলে পরিণত করছে। ফলে দেশের অভ্যন্তরে ও বহির্বিশ্বে দেশকে নিয়ে না ষড়ষন্ত্র চলছে, যা কাম্য নয়। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের বড় সাফল্য। আমাদের দেশের কৃষকরা পারে বাম্পার ফসল ফলাতে, আমাদের আছে বিশাল মানবসম্পদ- এদেরকে যদি একটু সহযোগিতা করা যায় এবং স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মের জন্য উপযোগী করে গড়ে তোলা যায়, তবে এ দেশের ঘুরে দাঁড়াতে তেমন বেশি সময় লাগবে না। যে দেশের মাটি সোনার চেয়েও খাঁটি এবং যে দেশের মাটি থেকে সোনা ফলে, সে দেশ কেন পিছিয়ে থাকবে, ঋণের জন্য পুঁজিবাদীদের ঋণের বিশাল ফাঁদে পা দেবে?
আমাদের সামাজিক পুঁজিকে কাজে লাগাতে উদ্যোগী হতে হবে। উন্নয়নশীল দেশগুলো যেভাবে নিজেদের ভাগ্য নিজেরা রচনা করেছে- এই দর্শনে আমাদের কর্মপরিধি ঠিক করতে হবে। দেশে বিরাজমান টলমলে রাষ্ট্রীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েমের চেয়ে সামাজিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দিকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। সামাজিক গণতন্ত্র যেসব দেশে বিরাজমান সেসব দেশের জনগণ তাদের সর্বনিম্ন চাহিদা মিটিয়ে বেঁচে থাকতে পারে। যার কোনো কর্মসংস্থান নেই সে-ও দারিদ্র্যের অভিশাপে অভিশপ্ত হন না। এ ক্ষেত্রে সমাজই এগিয়ে আসে ওইসব দুস্থ ও দারিদ্র্যদের সাহায্যে এবং তাদের প্রয়োজন মেটাতে।
আমাদের দুর্ভাগ্য, আমাদের দেশের নীতিনির্ধারকরা এ ধরনের সৃষ্টিশীল উদ্যোগ গ্রহণের দিকে নজর দেয়ার সময়ই পায়নি। আমাদের দেশের নীতিনির্ধারকদের প্রতি আমাদের অনুরোধ- ক্ষমতার উৎস এসব জনগণের ভাগ্য নির্মাণে স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে শক্তিশালী করুন এবং এ দেশের অর্থনীতিকে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করান। শুধু আপনাদের রাজনৈতিক ক্ষমতাকে ব্যক্তিগত ও দলীয় পর্যায়ের প্রভাব-বৈভব হিসেবে না দেখে দেশের গণতন্ত্র এবং অর্থনীতিকে মজবুত ও স্থিতিশীল করুন, পুঁজিবাদী ও প্রভুরাষ্ট্রের শক্তির মনতুষ্টির চেষ্টা থেকে বিরত থাকুন এবং এ দেশের সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের ওপর আস্থা ও ভরসা রাখুন।
গ্রামীণ অবহেলিত জনমানুষের ভাগ্য নির্মাণে গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন ও স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা ব্যতীত দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নসহ জাতীয় উন্নয়ন অর্জন করা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে দেশের রাজনৈতিক নেতাদের কাছে অনুরোধ- আপনাদের রাজনৈতিক শক্তিকে ব্যবহার করে প্রভুরাষ্ট্রের গোলামি ভুলে দেশের সার্বিক উন্নয়নে দেশকে ভালোবাসুন, পাশাপাশি ক্ষমতার উৎস জনগণের সার্বিক মঙ্গলে সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করুন, দারিদ্র্যবিমোচনই হোক আপনাদের দেশ ও জাতির অর্থনীতির মুক্তির জন্য প্রধান অ্যাজেন্ডা।
লেখক : কলামিস্ট ও সাবেক জনসংযোগ কর্মকর্তা, বিইউএফটি
[email protected]