অনলাইন ডেস্ক | ২০ জুন, ২০২২
বিএনপির সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা বলেছেন, অর্থমন্ত্রী বাজেটের শিরোনাম করেছেন ‘কোভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় প্রত্যাবর্তন’। আর আমি মনে করছি, এ বাজেট শ্রীলঙ্কা হওয়ার পথে কয়েক ধাপ এগিয়ে দেওয়ার বাজেট।
রবিবার সন্ধ্যায় একাদশ জাতীয় সংসদের অষ্টাদশ অধিবেশনে প্রস্তাবিত ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি এসব কথা বলেন।রুমিন ফারহানা বলেন, শ্রীলঙ্কার সে সময়ের পরিস্থিতি এখন বাংলাদেশে। শ্রীলঙ্কার পর্যালোচনায় যখন বাংলাদেশ প্রসঙ্গ এসেছে, তখন বেশ কয়েকজন অর্থনীতিবিদ তাদের স্বার্থের চিন্তায় কিংবা স্রেফ ভয়ে বলছেন বাংলাদেশের শ্রীলঙ্কার মতো সমস্যায় পড়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই। তবে এ আকালেও হাতে গোনা কিছু অর্থনীতিবিদ জানিয়েছেন বাংলাদেশের অবশ্যই সেই ঝুঁকি আছে এবং বাংলাদেশ এখনই যদি খুব সতর্ক না হয় তাহলে দ্রুতই বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতিতে পড়তে পারে।
তিনি বলেন, শ্রীলঙ্কার দেউলিয়া রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার প্রেক্ষাপটে এবারের বাজেটে বাংলাদেশ যেন সেই পথে না যায়, সে বিষয়ে দিক-নির্দেশনা, সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের কথা বলা উচিত ছিল। কিন্তু শ্রীলঙ্কা হওয়া ঠেকানোর চেষ্টা তো দূরে থাক, চরম মূল্যস্ফীতি, আমদানি-রপ্তানিতে ভারসাম্যহীনতা, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আশঙ্কাজনকভাবে কমতে থাকা, বিনিয়োগ স্থবির, কর্মসংস্থানের চরম সংকট এসব কোনোটির ক্ষেত্রেই কার্যকরী দিকনির্দেশনা নেই।বিএনপির এ সংসদ সদস্য বলেন, গরীব মানুষের নাভিশ্বাস তৈরি করা বাজেটে অকল্পনীয় পরিমাণ টাকা তুলে দিচ্ছেন সরকারের কিছু অলিগার্কের হাতে। এবারের বাজেটে ভর্তুকি খাতে রাখা হয়েছে ৮৩ হাজার কোটি টাকা, যার প্রধান অংশ যাবে বিদ্যুৎ খাতে। গত ১০ বছরে ১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেও কেন্দ্রগুলো ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ তুলে নিয়েছে ৬২ হাজার কোটি টাকা।
তিনি বলেন, ভারতে আদানি গ্রুপের তৈরি গোড্ডা কোল পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে ২৫ বছরের চুক্তিতে এক লাখ কোটি টাকার বেশি শুধু ক্যাপাসিটি চার্জই দেবে। এমনকি আগস্টে বিদ্যুৎকেন্দ্র সম্পন্ন হবার পর সঞ্চালন লাইনের অভাবে দেশে বিদ্যুৎ না আসলেও ডিসেম্বর পর্যন্ত চার মাসে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে ১ হাজার ২১৯ কোটি টাকা। কুইকরেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দিলেও দেশের বিদ্যুতের চাহিদা মেটানোর মতো বিদ্যুৎকেন্দ্র সরকারের আছে। তারপরও আদানি গ্রুপের সঙ্গে ২৫ বছর মেয়াদি বিদ্যুৎ ক্রয়ের চুক্তিটি কেন করা হয়েছে? পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার সুযোগ রাখার সমালোচনা করে রুমিন বলেন, যারা লুটপাটের টাকা পাচার করেছেন, তারা সেসব ফিরিয়ে আনার জন্য করেননি। টাকা ফেরত আনার জন্য নয়, পাচারকারীদের নিশ্চিন্ত করতেই এ পদক্ষেপ।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের ঋণ বিপৎসীমা পার হয়ে গেছে। এবারের বাজেটে জনগণের করের টাকার এক পঞ্চমাংশই যাবে ঋণের সুদ পরিশোধের পেছনে। বর্তমান বাংলাদেশে একটি শিশু জন্ম নেয় মাথার ওপরে ৯৬ হাজার টাকা ঋণের বোঝা নিয়ে। সরকারের বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্পকে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে এবং আরও কিছু প্রয়োজনীয় প্রকল্পগুলোতে লুটপাট আর বাস্তবায়নের দীর্ঘসূত্রিতার কারণে ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে অনেক বেশি। ফলে সেগুলো প্রত্যাশিত অর্থনৈতিক উপযোগিতা দেয়া দূরেই থাকুক, পরিণত হবে শ্বেতহস্তীতে।
বিএনপি দলীয় এ সংসদ সদস্য বলেন, অনেকগুলো বড় ঋণের গ্রেস পিরিয়ড চলছে এখন, যা শেষ হলে ঋণ পরিশোধের চাপ আরও বাড়বে। নতুন যুক্ত হতে থাকা নতুন সব ঋণের গ্রেস পিরিয়ড শেষে অনেক বেশি বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে হবে। রুমিন বলেন, বিদেশের শ্রমবাজারের অবস্থা ক্রমাগত খারাপের দিকে যাচ্ছে। সিপিডি স্পষ্টভাবে বলেছে, বিদেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজারের স্বর্ণযুগ শেষ। এ দিকে বর্তমান ডলারের সংকটের সময় রেমিট্যান্স আসা অনেক কমে গেছে। এর সঙ্গে ব্যাংকিং চ্যানেলেই সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় বিরাট অঙ্কের টাকা পাচার হচ্ছে, যা রিজার্ভ কমিয়ে দিচ্ছে অতি দ্রুত।
আওয়ামী লীগের সমালোচনা করে তিনি বলেন, তারা অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছিলেন, কিন্তু গুম, অন্যায়ভাবে মিথ্যা মামলার মাধ্যমে বিরোধীদের দমন, সংবাদমাধ্যম ও ব্যক্তিগত মত প্রকাশের ওপর তীব্র চাপসহ নানা দমন-পীড়নের মাধ্যমে তারা হয়ে উঠেছেন একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী একেকজন স্বৈরাচার, যারা একটির পর একটি স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। আর দেশের স্বার্থ, জনগণের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে পরিবারের সদস্য আর কিছু কাছের মানুষের স্বার্থ রক্ষা করছেন।
রুমিন বলেন, দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে শ্রীলঙ্কা হওয়ার মতো সবকটি ঝুঁকিপূর্ণ ফ্যাক্টর এ দেশে বিরাজমান এবং প্রস্তাবিত বাজেট সেগুলোকে আরও ত্বরান্বিত করবে। সব কিছুর সঙ্গে বিদ্যমান আছে আসল বিষয়টিও। জনগণের ভোটে নির্বাচিত না হয়েও একের পর এক টার্ম ক্ষমতায় থাকার ফলে বাংলাদেশে একটি চরম কর্তৃত্ববাদী অলিগার্কি বা গোষ্ঠীতন্ত্র কায়েম হয়েছে। নিজেদের আখের গুছিয়ে নিজেদের অনাগত বহু প্রজন্মের জন্য নিশ্চিন্ত রাজকীয় জীবনযাপনের পথ নিশ্চিত করার পর দেশ শ্রীলঙ্কা হলে তাতে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর কী আসে যায়?