- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ১৯ মার্চ ২০২২, ২২:৫৯
বাংলাদেশ এপর্যন্ত ৯ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীর তালিকা মিয়ানমারকে দিয়েছে বলে জানিয়েছেন শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার শাহ রেজওয়ান হায়াত৷ এ থেকে এখন পর্যন্ত ২৯ হাজার রোহিঙ্গাকে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ তাদের নাগরিক বলে নিশ্চিত করেছে৷
পরারাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম গত সপ্তাহে সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘মিয়ানমার প্রথম দফায় ৭০০ রোহিঙ্গাকে ফেরত নিতে চায়৷ কিন্তু আমরা চাই এক হাজার ১০০ রোহিঙ্গাকে প্রথম দফায় ফেরত নেয়া হোক৷ এটা হলে একই পরিবারের সবাই যেতে পারবেন৷ তা না হলে পরিবারের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হবে৷’
শাহ রেজওয়ান হায়াত জানান, ‘এ সংক্রান্ত কোনো অফিসিয়াল ডকুমেন্ট আমরা পাইনি৷ আমরা পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য শুনেছি৷ ফলে আমাদের দিক থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু হয়নি৷’
মিয়ানমারে সামরিক জান্তা ক্ষমতায় আসার পর প্রথম চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারি দুই দেশের টেকনিক্যাল কমিটির মধ্যে ভার্চুয়াল বৈঠক হয়৷ এর আগে আরো দুইবার রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হলেও শেষ পর্যন্ত তা ভেস্তে যায়৷ ২০১৭ সাল থেকে এপর্যন্ত রাখাইনে নির্যাতনের শিকার হয়ে কমপক্ষে ১২ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আসেন৷
শাহ রেজওয়ান হায়াত বলেন, ‘আমরা এখন পর্যন্ত ৯ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গার তালিকা পাঠিয়েছি৷ ওরা তাদের পরিচিতি পরীক্ষা করছে, যদি সত্যি বলে থাকে৷ তারা ২৯ হাজারের পরিচিতি এখনপর্যন্ত নিশ্চিতের কথা বললেও আমাদের কাছে কোনো তালিকা পাঠায়নি৷’
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘আমরা এক হাজার ১০০ জনকে ফেরত পাঠাতে চাই এটা মন্ত্রী বলেছেন৷ কিন্তু কিসের ভিত্তিতে বললেন তা আমার জানা নেই৷ আর মিয়ানমার যে ৭০০ জনকে ফেরত নিতে চায় তাও অফিসিয়ালি আমরা জানি না৷’
তবে মিয়ানমার যদি এখন ৭০০ জনকে ফেরত নিতে চায় সে ব্যাপারে বাংলাদেশকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্লেষকরা৷ তারা মনে করেন এটা মিয়ানমারের একটি ফাঁদ বা নতুন কোনো চাল হতে পারে৷
সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং মিয়ানমারে বাংলাদেশ দূতাবাসের সাবেক সামরিক অ্যাটাশে মেজর জেনারেল (অব.) শহীদুল হক মনে করেন, ‘একটি রোড ম্যাপ ছাড়া ৭০০ জন রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানো ঠিক হবে না৷ আগে মিয়ানমার নিশ্চিত করবে যে সর্বমোট কত জনকে তারা কতদিনে ফেরত নেবে৷ নয়তো তারা এই ৭০০ জনকে ফেরত নিয়ে বলবে আমরা তো ফেরত নিয়েছি৷ আর নেবে না৷’
তিনি বলেন, ১৯৯৩ সালে তারা একই কাজ করেছিল৷ কিছু রোহিঙ্গাকে ফেরত নিয়ে আর নেয়নি৷ ২০১১ সালে রোহিঙ্গাদের একটি তালিকা হস্তান্তর করা হয় মিয়ানমারকে৷ তখন তারা মাত্র ছয় হাজারকে রোহিঙ্গা বলে মেনে নেয়৷ তারা আসলে টোকেন হিসেবে কিছু রোহিঙ্গাকে নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বকে দেখাতে চায় আর কিছু নয়৷
তার মতে, ‘ইউক্রেনে রাশিয়ারা হামলার পর ইউরোপে এখন শরণার্থী সংকট তৈরি হয়েছে৷ ইউরোপের নজর এখন ওদিকে৷ এই সুযোগকে মিয়ানমার কাজে লাগাতে চায়৷’
তার কথা রোহিঙ্গা নিয়ে মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের একটি চুক্তি হওয়া প্রয়োজন যেখানে তৃতীয় পক্ষ থাকবে৷
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ মনে করেন, ‘মিয়ানমার যে চীনের কথায় ওঠবস করে তা ঠিক নয়৷ তারা তো ইউক্রেন ইস্যুতে চীনের বিপক্ষে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে গিয়ে ভোট দিয়েছে৷ তারা এখন প্রমাণ করতে চায় যে মিয়ানমারে গণহত্যা হয়নি৷ আন্তর্জাতিক আদালতকেও এটা বোঝাতে চায়৷ তাই তারা কিছু রোহিঙ্গাকে এখন মিয়ানমারে ফেরত নিতে চায়৷ কিন্তু সব রোহিঙ্গাকে কবে ফেরত নেবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই৷’
তার মতে, ‘বাংলাদেশকে খুব সতর্কতার সাথে বিষয়টি দেখতে হবে৷ আগে মিয়ানমারের কাছ থেকে নিশ্চয়তা পেতে হবে তারা কত রোহিঙ্গাকে ফেরত নেবে৷ তারপর এটার রোড ম্যাপ করতে হবে৷ তারাতো ঠিক করে বলছেই না যে কত রোহিঙ্গাকে ফেরত নেবে৷ যদি এটা নিশ্চি না হয় তাহলে দেখা যাবে হাজার খানেক নিয়ে আর নেবে না৷ তাদের যা উদ্দেশ্য তা কিন্তু তারা করে নেবে৷’
এদিকে তথ্য উপাত্ত বলছে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আগ্রহ দিন দিন কমে আসছে৷বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সার্বিক বিষয় দেখাশোনা করে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন৷ জাতিসঙ্ঘের ইউএনএইচসিআর এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে৷ ২০২১ সালে জয়েন্ট রেসপন্স প্লান-এর যে হিসাব তাতে দেখা যায় ১০ লাখ ৩৬ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীর জন্য মোট ডোনারদের সহায়তা প্রয়োজন ছিল ৯৪৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার৷ দিয়েছে ৬৭৪ মিলিয়ন ডলার যা প্রয়োজনের তুলনায় ২৮ ভাগ কম৷ ২৬৯ মিলিয়ন ডলার সহায়তা পাওয়া যায়নি৷
এর আগেও কোনো বছরই প্রত্যাশিত সহায়তা পাওয়া যায়নি৷ ২০১৭ সালে প্রয়োজন ছিল ৪৩৪ মিলিয়ন ডলার, পাওয়া গেছে ৩১৭ মিলিয়ন ডলার৷ ২০১৮ সালে ৯৫১ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে পাওয়া গেছে ৬৫৫ মিলিয়ন ডলার৷ ২০১৯ সালে ৯২০ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে পাওয়া গেছে ৬৯৯ মিলিয়ন ডলার৷ ২০২০ সালে ১০৫৮ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে পাওয়া গেছে ৬২৯ মিলিয়ন ডলার৷
এখানে স্পষ্ট যে ২০২০ সালের পর থেকে প্রতিশ্রুত সহায়তাও কমছে এবং প্রতিশ্রুত সহায়তার গড়ে ৭০ ভাগের বেশি পাওয়া যাচ্ছে না৷
ইউক্রেনে হামলার পর শনিবার পর্যন্ত ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ৩০ লাখের বেশি শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছে৷
এই দুই বিশ্লেষক মনে করেন, ‘ইউরোপে শরণার্থী বেড়ে যাওয়ায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রতি তাদের মনোযোগ কমে যাওয়াই স্বাভাবিক৷ আর এই সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করতে পারে মিয়ানমার৷ তাই বাংলাদেশকে কূটনৈতিক যোগাযোগ বাড়াতে হবে৷ রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিভিন্ন ফোরামে আরো শক্ত অবস্থানে গিয়ে কথা বলতে হবে৷’
সূত্র : ডয়চে ভেলে