- সাইফুল ইসলাম তানভীর
- ০৩ মার্চ ২০২২, ২০:৫৭
বাংলাদেশে জালিয়াতির, দুর্নীতি সাঙ্ঘাতিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। রাষ্ট্রীয় প্রায় সব প্রতিষ্ঠান দুর্নীতিতে বিপুলভাবে নিমজ্জিত। এখানেই থেমে থাকছে না; জালিয়াতি করে আবার তারা দম্ভও প্রকাশ করে। কারণ তারা জানে, এদেশে এসব করলে কিছুই হয় না! প্রশাসনকে নিজেদের মতো ম্যানেজ করে নেয়া যায়। ভাড়াটে ক্যাডারবাহিনীও পাওয়া যায়।
বেসরকারি অফিসগুলোতেও যে দুর্নীতি চলতে পারে সেটা অনেকে বুঝতে পারেন না। তবে বেসরকারি অফিসের দুর্নীতি জালিয়াতি ভিন্ন ধরনের। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে স্বয়ং মালিকরাই দুর্নীতি জালিয়াতি করে। ভ্যাট ট্যাক্স ফাঁকি দেয়া, ব্যাংকের অর্থ আত্মসাৎ করা, বিদ্যুৎবিল, গ্যাস বিল ফাঁকি দেয়া। সবচেয়ে বেশি জালিয়াতি করে কর্মচারীদের সাথে। তাদের অনেকেই চরমভাবে কর্মচারী ঠকায়। শ্রম আইনকে তারা সবসময় বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চলে। অনেকে শ্রম আইন সম্পর্কে কিছুই জানেন না। বড় বড় কোম্পানির জালিয়াতি দেখে ছোট কোম্পানির মালিকরা জালিয়াতির চর্চা করে বেশ উৎসাহ নিয়ে। দেশে হাজার হাজার মিনি কোম্পানি আছে যারা কাগজপত্র তৈরি করে নিজেদের লিমিটেড কোম্পানি দাবি করে। এসব কোম্পানি নামেমাত্র। এরা রাষ্ট্রীয় বেশির ভাগ আইন-কানুন মানেন না। ধর্ম সেটাও মানেন না। যদিও এদের বড় একটি অংশ বারবার হজ-ওমরাহ করতে সৌদি আরব যান। কেউ কেউ মদিনায় মসজিদে নববীতে এতেকাফেও বসেন।
ঢাকার বারিধারায় এক কোম্পানি তাদের কর্মচারীদের লোভ দেখিয়েছে তোমরা মাসে মাসে বেতন থেকে কিছু টাকা আমাদের কাছে জমা রাখো। তিন বছর পর তোমাদের ডাবল দেয়া হবে। এবি ব্যাংকের মাধ্যমে তোমাদের লেনদেন মেইনটেন করা হবে। তোমরা নমিনির জন্য ছবি দাও। কর্মচারীরা কেউ তাদের মায়ের ছবি দিলেন। কেউ তাদের স্ত্রীর ছবি দিলেন। সব কর্মচারীকে বাধ্য করলেন মাসে মাসে টাকা দিতে। তারা এটাও বলেছিলেন, তিন বছর পূর্ণ হলে চাকরিতে থাকা অবস্থাতেই ডাবল দেয়া হবে এবং আবার চালু করবে। কর্মচারীদের তিন বছর পূর্ণ হওয়ার পর যখন কর্মচারীরা বললেন, আমাদের সেই ডাবল টাকা দিন। তখন সেই কোম্পানির অতি চতুর মালিকরা সেটি অস্বীকার করলেন।
শুধু এটাই অস্বীকার নয়, এই সিস্টেম চালু করার সময় যত ভালো ভালো কথা বলেছেন তা সব অস্বীকার করেছেন। যেমন কেউ ভেঙে দিতে চাইলে সাথে সাথে ভেঙে টাকা নিয়ে যেতে পারবেন। চাকরি থেকে চলে গেলেও সাথে সাথে জমা করা টাকা উঠিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন। বাস্তবে দেখা গেল তারা সাত বছর পার হওয়ার পরও কাউকে টাকা দেয়নি। সেই টাকা দিয়ে তারা ব্যবসায় করে। দু’-একজন জমা করা টাকা যারা চাকরি থেকে চলে যাওয়ার দু’-এক বছর পর নিতে সক্ষম হয়েছে তারা অনেক ঝামেলা করে নিয়েছে। হুমকি দিয়ে, মাস্তান দিয়ে ইত্যাদি প্রক্রিয়ায়।
লাভের টাকা তো দূরের কথা বেতন থেকে রেখে দেয়া আসল টাকাটা নিতে পারেননি এখানকার বেশির ভাগ কর্মচারী। এই কোম্পানির মালিকরা তাদের চাটুকারি না করায় অনেক কর্মচারীকে সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে, অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুত করেছে।
কাকতালীয়ভাবে আজ পর্যন্ত তারা লেবার কোর্টের কোনো মামলায় পড়েননি। এ জন্য তারা সবসময় ফুরফুরে মেজাজে থাকেন। নিজেদের চতুরতা নিয়ে নিজেরা গর্ভ করেন। চার পার্টনারশিপের এই কোম্পানির এমডি পদের যিনি আছেন তিনি মূলত এসব জালিয়াতির মূল হোতা। অন্য দু’জন পার্টনারকে দিয়ে উত্তেজিত অনেক কর্মচারীকে ম্যানেজ করেন। তাদের দু’জন বেশ ভদ্র এবং ভালো ইঞ্জিনিয়ার। তারা বিভিন্ন রসের কথা বলে কর্মচারীদের ম্যানেজ করতে সক্ষম হন। এখানকার চেয়ারম্যান সাহেব বেশ ভদ্র শিক্ষিত ব্যক্তি। তার কাছে অভিযোগ দিলে তিনি কৌশলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তিনি বেশির ভাগ সময় বলেন, অফিসে যোগাযোগ করেন। আর অফিস বলতেই একটা জালিয়াতির আখড়া।
এই প্রতিষ্ঠান থেকে অনেকেই চাকরি ছেড়ে সৌদি আরব, আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতার ইত্যাদি দেশে চাকরিতে গেছেন। তাদের পরিবারের লোকজন বারবার এই তথাকথিত ‘অফিসে’ যোগাযোগ করে তাদের পাওনা আদায় করতে পারেনি। তারা সবসময় বলে তাদের ব্যবসায় ভালো না, তারা মালিকরা কোনো সময় বেতন নিতে পারেন না- ইত্যাদি হাস্যকর ও প্রতারণামূলক কথা বলেন। অথচ ২০০৬ সালে এই প্রতিষ্ঠান মাত্র আট লাখ টাকা নিয়ে যাত্রা শুরু করে। এখন এখানে মালিকদের বিলাসী জীবনযাপন, গাড়ি বাড়ি সব আছে। তবে এখানকার চেয়ারম্যান সাহেব মালিকানায় এসেছেন ২০১৩ সালের জুন মাস থেকে। তিনি ব্যক্তিগতভাবে এই কোম্পানিতে অনেক টাকা ধার দিয়ে সেটা উঠিয়ে নিয়েছেন অনেক কষ্টে।
মজার ব্যাপার- এখানের কর্মচারীদের ঠকানোর ব্যাপারে সব মালিক এক। সরকারি ছুটির আইন তারা বরাবরই মানেন না। প্রতিষ্ঠানটি মোটামুটি ভালোই চলছিল। তারা এমন একজন চাটুকারকে সেখানে নিয়োগ দিয়েছেন যিনি মালিকদের সাথে থেকে তাদেরকে নানান কুপরামর্শ দেন। এতে সেখানে শ্রমিক অসন্তোষ দেখা গেছে। মোটা অঙ্ক দিয়ে যে চাটুকার কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছে তার বিভিন্ন অপকর্মের কারণে ওই প্রতিষ্ঠানে জটিলতা বেড়েই চলছে। আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্নীতিমুক্ত থাকলে এ ধরনের বেসরকারি ক্ষুদ্র পর্যায়ের কোম্পানির মালিকরা এভাবে কর্মচারীদের টাকা জালিয়াতি করে ভোগ করতে পারতেন না এবং হয়রানিও করতে সাহস পেতেন না। বহু কর্মচারী আছেন যারা এক বছর দু’বছর আগে চাকরি ছেড়েছেন, চাকরিচ্যুত হয়েছেন কিন্তু আজো তারা টাকা উঠিয়ে নিতে পারেননি। রাষ্ট্রে সুশাসন ছাড়া বেসরকারি এসব প্রতিষ্ঠানকেও দুর্নীতিমুক্ত করা সম্ভব নয়।