- ডা: মীরা মমতাজ সাবেকা
- ০৮ জানুয়ারি ২০২২, ২০:১৭
উৎসব জীবনের এক অপরিহার্য অনুষঙ্গ। দেশ জাতি ও সমাজভেদে উৎসবের ভিন্নতা রয়েছে। জাহিলিয়াতের যুগে মদিনার লোকেরা পারস্য জাতির অনুকরণে ‘নওরোজ’ নামক নববর্ষ উৎসব পালন করত। মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা: সেই উৎসব পরিবর্তন করে দুই ঈদের দিন মুসলমানদের জন্য আনন্দের দিন হিসেবে ধার্য করে দেন। ধর্মীয় উৎসবের সাথে ধর্মীয় আচার অনুভূতি সম্পৃক্ত থাকে। এ ছাড়া কিছু উৎসব থাকে স্থানীয় প্রথাসিদ্ধ, যা যুগ যুগ ধরে কোনো কোনো অঞ্চলে প্রচলিত থাকে। সেই সব উৎসবের সাথে সেই মাটি ও মানুষের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক থাকে। পয়লা বৈশাখ সেরকমের একটি উৎসব, যা মুঘল সম্রাট আকবর প্রচলন করেছিলেন। বাংলা নববর্ষের অনেক অনুষঙ্গ নতুনভাবে প্রচলিত, আর এতে মুসলিম মানসপটে নানা সন্দেহের উদ্রেক হয়, যেমন- মঙ্গল শোভাযাত্রা তৌহিদি ভাবধারার সাথে সাংঘর্ষিক। তবুও উদারপ্রাণ মুসলমান সমাজের এক বিরাট অংশ পয়লা বৈশাখ পালনে সঙ্কুচিত নয়। অন্যদিকে ধর্মপ্রাণ মুসলমান ধর্মীয় আচার-অনুসরণের নিমিত্তে আরবি বর্ষ মেনে চলেন, অনেকে আবার পয়লা মহররম ইসলামী নববর্ষ পালনের তাগিদ অনুভব করেন। রাষ্ট্রীয় কার্যাদি পরিচালনায় ইংরেজি বা ঈসায়ী বছর গুরুত্বপূর্ণ। বছরের শুরুতে সরকারি দফতরগুলোয় এই দিনপঞ্জী সরবরাহ করে অনুসরণ করা হয়। বাৎসরিক ছুটির হিসাব (ঐচ্ছিক-নৈমিত্তিক) ইংরেজি বছরের হিসাবেই চলে। তাই দাফতরিক কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা বছরের প্রথম দিন থেকে নবোদ্যমে কর্মানুরাগী হওয়ার প্রয়াস পান।
আজকাল নব উদ্যমে ইংরেজি নববর্ষ উৎযাপন আনন্দ অনুভূতি আনে না, শঙ্কা জাগায়। অপব্যয়ে অপচয়, আর অপচয়কারী শয়তানের ভাই। পরকালের কঠিন নিক্তিতে কেবল সম্পদ আহরণ নয়, সম্পদ ব্যয়ের হিসাব গৃহীত হবে। আর ইহকালের অপচয় মনে করিয়ে দেয়, ‘আশুগৃহে তার দেখিবে না আর নিশিথে প্রদীপ বাতি’। আতশবাজির অপসংস্কৃতির বয়স এক যুগের বেশি নয়। আনন্দ উৎসবের এই উপকরণ অনেক অপূরণীয় ক্ষতি বয়ে নিয়ে আসছে। আমাদের ধর্ম-জাতি -সংস্কৃতিতে এ এক ভয়ঙ্কর মাত্রা যোগ করেছে। আতশবাজির দৃষ্টিনন্দন রঙিন আলোর ঝলকানি ক্ষণিকের মুগ্ধতা আনে, যখন কারো মনে থাকে না, এই রঙিন আলোকচ্ছটা বাতাসে ভাসায় বিষাক্ত কণিকা, যা ফুসফুসের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। কার্বন-মনো-অক্সাইড, নাইট্রাস-অক্সাইড, সালফার হৃদরোগীদের জন্য অশুভ পরিণতি বয়ে আনতে পারে। ঝুঁকিপূর্ণদের তালিকায় আরো রয়েছে গর্ভবতী নারী ও শিশু। শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশে প্রতিবন্ধক এই আতশবাজির সমারোহ।
যুক্তরাজ্যের জনস্বাস্থ্য বিভাগের তথ্যানুযায়ী শব্দদূষণের অস্বাভাবিক মাত্রা উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, অনিদ্রা ও চিরস্থায়ী বধিরতার কারণ হতে পারে । এই বায়ু ও শব্দদূষণ ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকাবাসীর জন্য নববর্ষের কোনো শুভ বারতা বয়ে আনে না, এ কথা সহজেই অনুমেয়। প্রাণহানির সংবাদ আজ যেন কেবল কয়েকটি লাশের সংখ্যা। এই অমূল্য জীবন যেকোনো উৎসবের রাতে আপনার প্রিয়জনের হতে পারে, আতশবাজির আনন্দে সেই আশঙ্কা যেন চাপা না পড়ে। যে বছর আমরা পার করেছি তাতে আনন্দ ছিল না, ছিল রোগ, শোক আর স্বজন হারানোর বেদনা। বহু রোগী চিকিৎসার অভাবে, অক্সিজেনের অভাবে মারা গেছেন। আমাদের সরকারি হাসপাতালে ডাক্তারি পরামর্শ ছাড়া আর সব আনুষঙ্গিক চিকিৎসা ব্যয় রোগীকেই বহন করতে হয়। এ রকম একটি দেশে বৈশ্বিক মহামারী প্রতিরোধের ও প্রতিকারের কোনো ন্যায়সম্মত ন্যূনতম ব্যবস্থা নেই। যে দেশে মানুষের দুবেলা আহার জোটে না, সে দেশে চিকিৎসা তো বিলাসিতা!
আমরা বাঙালি, আমাদের নববর্ষ পয়লা বৈশাখ, নাকি পয়লা জানুয়ারি? এ দেশে কেউ চীনা নববর্ষ পালন শুরু করলে, সে দিনও বাঙালি আনন্দ করতে দ্বিধা করবে না, এ আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি। আতশবাজি আনন্দহীন হোক। সেই অর্থে মানুষের জন্য কিছু করতে পারলে, দুঃখী মানুষের মুখের হাসি আতশবাজির চেয়ে বেশি চমকিত করবে চারদিক। সেই নববর্ষের প্রতীক্ষায় রইলাম।
লেখক : কনসালট্যান্ট, নিউরোলজিস্ট, ইউ কে