ঘরে ঘরে জাহাঙ্গীর


অবশেষে ক্ষমতার মসনদ থেকে বেশ দ্রুত ও নাটকীয়ভাবে বিদায় নিতে হয়েছে দেশের বৃহত্তম সিটি করপোরেশন – গাজীপুরের মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে। জাহাঙ্গীর আলম কখনোই সুরাজনীতিক ছিলেন না। গুণ্ডামি, মাস্তানি প্রভৃতি অপকর্মের মাধ্যমে তার উত্থান হয়েছিল। মানুষ তাকে ভয় পেত, সমীহ করত না। সেটি জাহাঙ্গীর জানতেন, জানত আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক মহলও। কিন্তু তা সত্ত্বেও সবাই চুপ করে থাকতেন। আওয়ামী লীগ ভালোবাসা দিয়ে কিছুই জয় করতে চায় না। বল প্রয়োগ ও ভীতি দেখানোর মাধ্যমে সবকিছু দখলে নিতে চায়। সেই প্রক্রিয়ায় জাহাঙ্গীর আলমকে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে দেশের বৃহত্তম সিটি করপোরেশনের মেয়র বানিয়ে দিয়েছে। মেয়র হতে যদি ভোট লাগত তাহলে নিশ্চিত করেই বলা যায়, তার জামানত বাজেয়াপ্ত হতো; কিন্তু এখন বাংলাদেশে আজব গণতন্ত্র চালু হয়েছে। এখানে এক ব্যক্তির ইচ্ছায় কেউ মুহূর্তে বাদশাহ, পর মুহূর্তে মিসকিন। ভোট হয় না। ২০১৪ সাল থেকে স্থানীয় সরকারই বলি, সংসদ বলি, সিটি করপোরেশন কিংবা ইউপি চেয়ারম্যানই বলি, এক ব্যক্তির ইচ্ছাই সেখানে প্রধান। তিনি যদি বলেন ‘হও’ অমনি এমপি, মেয়র, চেয়ারম্যান হয়ে যাওয়া যায়। তারই ‘হও’ কার্যকর করার জন্য প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলাবাহিনী একেক সময় একেক কৌশল গ্রহণ করে। কখনো আগের রাতে ভোট কেটে ব্যালট বাক্সে ভরে রাখে; কখনো প্রতিপক্ষকে ভোটকেন্দ্রে ঢুকতে দেয় না। হামলা, হাঙ্গামা, গোলাগুলি করে এমন এক আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করে যে, ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে আসার আগ্রহই হারিয়ে ফেলেন। এমনও তো হয়েছে, এক ব্যক্তির জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। অথচ তিনিই সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। এমন আজব ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে কমই ঘটেছে।

নির্বাচনকে নিজের কব্জায় নিয়ে পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান মৌলিক গণতন্ত্র চালু করেছিলেন। অর্থাৎ, প্রেসিডেন্ট জনগণের ভোটে নির্বাচিত হবেন না, নির্বাচিত হবেন ইউপি মেম্বার-চেয়ারম্যানদের ভোটে। তাতে অল্প চেয়ারম্যান-মেম্বারকে কিনে নেয়া সম্ভব হতো। এখন চালু হয়েছে আগের রাতে ভোট কিংবা ভোটকেন্দ্র দখলের ‘গণতন্ত্র’। এ কথা সবাই জানে, বিগত প্রায় প্রতিটি নির্বাচন এই পদ্ধতিতে হয়েছে। ১৯৭৩ সালে পার্লামেন্ট নির্বাচনে আরো একটি পদ্ধতি চালু করা হয়েছিল। সেটি হলো – যেখানে দেখা যাচ্ছিল বিরোধীরা ভোটে জিতে যাচ্ছে, সেখানে ভোট গণনা বন্ধ করে বাক্সগুলো হেলিকপ্টারে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল জেলা নির্বাচনী কার্যালয়ে। তারপর যাকে খুশি তাকে ‘নির্বাচিত’ ঘোষণা করে দেয়া হচ্ছিল। এবারের ইউপি নির্বাচনেও বহু ক্ষেত্রে একই ঘটনা ঘটেছে। যেখানে সরকারি প্রার্থী হেরে যাচ্ছিলেন, সেখান থেকে ব্যালট বাক্স নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল উপজেলা বা জেলা কেন্দ্রে। তারপর যাকে খুশি তাকে নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়েছে। এর ব্যতিক্রম খুব একটা নেই।

জাহাঙ্গীর আলম নির্বাচিত হয়েছিলেন বহুমুখী কারসাজির মাধ্যমে। তিনি যে ভ‚মিদস্যু, ঝুটদস্যু, জিম্মিকারী তা এলাকার সবাই জানত। গাজীপুরে একটি দরিদ্র কৃষক পরিবারে ১৯৭৯ সালে জন্ম তার। এসএসসি পাসের পর ভর্তি হয়েছিলেন ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজে। অর্থনৈতিক টানাপড়েনের কারণে কলেজের লেখাপড়া শেষ করতে পারেননি। তার মামা ছিলেন ভাওয়ালের একটি বাড়ির কেয়ারটেকার। কিন্তু যুক্ত ছিলেন জমি কেনাবেচার দালালিতে। তখন জাহাঙ্গীর তার মামার এ কাজে যুক্ত হন। এলাকার একাধিক প্রবীণ ব্যক্তির ভাষ্য – ওই সময় এক কারখানার মালিকের জমি কেনার অনেক টাকা আত্মসাৎ করেন জাহাঙ্গীর। অনুপার্জিত প্রচুর টাকার জোরে আওয়ামী রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তারপর শুরু করেন ঝুট ব্যবসায়। এরপর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। কোনো পদ-পদবি ছিল না। চলতেন একাধিক দেহরক্ষী নিয়ে। ভিভিআইপির আদলে তার গাড়িবহরের পেছনে থাকত একটি অ্যাম্বুলেন্স। জাহাঙ্গীরের অর্থ আয়ের সবচেয়ে বড় একটি খাত হলো গাজীপুর ও ময়মনসিংহ এলাকায় বিভিন্ন গার্মেন্ট কারখানার ঝুট এবং সুতার কারবার। একসময় তিনি নিজেই দেখভাল করতেন। এখন বিশ্বস্ত লোকদের দিয়ে করান। গাজীপুর এলাকার বিভিন্ন কারখানার ট্রেড লাইসেন্স আটকে দিয়ে টাকা আদায়ের অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। জাহাঙ্গীরের হয়ে যারা গার্মেন্ট কারবার নিয়ন্ত্রণ করেন, সমকাল লিখেছে, তারা হলেন – মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বেনসন মুজিবর, মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক হাজী মনির ও ৩৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর জাহাঙ্গীর আলম। মেয়রের সান্নিধ্যে থেকে এলাকায় কয়েক কোটি টাকা খরচ করে বাড়ি করেন কাউন্সিলর জাহাঙ্গীর। এ ছাড়া মেয়রের দেহরক্ষী হিসেবে পরিচিত আশরাফুল আলম ওরফে রানা মোল্লা ইটাহাটা এলাকায় প্রাসাদোপম বাড়ি নির্মাণ করেছেন। কয়েক মাস গাজীপুরের টিআরজেট কারখানায় নিজে হাজির হয়ে ঝুট দেয়ার দাবি করেন মেয়র নিজেই। এলাকাবাসীর অভিযোগ ছাড়াও একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে তাদের চাঁদাবাজির তথ্য তুলে ধরা হয়। ঝুট ব্যবসার একক নিয়ন্ত্রণ বন্ধ ও উদ্ভূত পরিস্থিতি সঠিকভাবে মোকাবেলা করা না গেলে মেয়রপন্থী ও মেয়রবিরোধী পক্ষের মধ্যে সঙ্ঘাতের আশঙ্কা ছিল। তার এই অপকর্মের সাথে যারা যুক্ত তারা সবাই মেয়রের লোক ও আওয়ামী লীগ, যুবলীগের সদস্য। স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের কোটি কোটি টাকার কাজ, বাজার ও গরুর হাট ইজারা নিয়ে প্রায় একচ্ছত্র আধিপত্য মেয়রের। এ ছাড়া টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমার নানা কাজের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। অভিযোগ আছে, নিজের ও দলীয় বিলবোর্ড তিনি তৈরি করেন সিটি করপোরেশনের টাকায়। তিনি ‘জাহাঙ্গীর আলম ফাউন্ডেশন’ নামে একটি দাতব্য সংস্থা খুলে গড়ে তোলেন বড় লাঠিয়াল বাহিনী। মহানগরের ৫৭টি ওয়ার্ডে তাদের কার্যক্রম রয়েছে। এই ব্যানারে কাজ করে পাঁচ শতাধিক তরুণ-তরুণী। সিটি করপোরেশন থেকে তাদের বেতন দেয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে শেখ মুজিবুর রহমান ও শেখ হাসিনার নামও নেয়া হতো না। জাহাঙ্গীরের নিজের পরিচয় তুলে ধরতে ওই ফাউন্ডেশনকে ব্যবহার করা হতো। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের একাধিক কাউন্সিলরের অভিযোগ, প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন হত্যার ঘটনায় মেয়রের ভ‚মিকা সন্দেহজনক ও প্রশ্নবিদ্ধ। ওই ঘটনার পর সিটি করপোরেশন থেকে কোনো শোকপ্রস্তাব গ্রহণ করা হয়নি। অন্য কোনো কর্মসূচিও পালন করেনি কেউ। অভিযোগ আছে, একই প্রকল্প তিনবার দেখিয়ে ৩৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ করার চেষ্টা করেছিল একটি প্রভাবশালী চক্র। এতে বাধা হয়ে দাঁড়ালে নির্বাহী প্রকৌশলী দেলোয়ারকে প্রাণ দিতে হয়। ওই হত্যাকাণ্ডের পর মেয়রের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত সুন্দর মনির কিছু দিন গাঢাকা দিয়ে থাকেন। তা ছাড়া গাজীপুরের রাস্তা সম্প্রসারণের নামে তিনি শিল্পপতিদের কাছ থেকে এমন মুচলেকা নিতেন যে, তারা স্বেচ্ছায় জমি দেবেন এবং কোনো ক্ষতিপূরণ নেবেন না। এরকম মুচলেকা দিতে কেউ অস্বীকার করলে তার ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন করতে অস্বীকৃতি জানাতেন।