- ১০ নভেম্বর ২০২১
দেশে একটি সরকার আছে। সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে জনগণের কল্যাণ সাধন। তাদের ভালো-মন্দ দেখভাল করা। তা না করে যদি সরকার উল্টো জনগণের সর্বনাশ সাধনে লিপ্ত হয়, তাহলে তাকে কি জনমুখী সরকার বলা যায়? বিস্ময়কর শোনালেও সত্য যে, আজকে যে সরকার বাংলাদেশ শাসন করছে তারা জনগণের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তারা কাজ করছে একটি বিশেষ দল, গোষ্ঠী ও সিন্ডিকেটের স্বার্থে। তাদের সমস্ত কার্যক্রম-আইন প্রণয়ন, নির্বাহী ব্যবস্থা ও ব্যবসায় নিয়ন্ত্রণ সবকিছু বিস্ময়করভাবে সিন্ডিকেটের পক্ষে। বলতে গেলে সিন্ডিকেটের তাঁবেদারে পরিণত হয়েছে সরকার। মানুষের চোখের সামনেই আদেশের দ্বারা, সমঝোতার দ্বারা এবং নগ্ন হস্তক্ষেপের দ্বারা তারা সিন্ডিকেটের স্বার্থকে সংরক্ষণ করছে। দেশের বর্তমান অবস্থা এই কথাগুলোকে সত্য প্রমাণ করছে। অতিসামম্প্রতিক সময়ে দু’টি কার্যক্রমের মাধ্যমে এরকম প্রমাণ মিলছে। প্রথমটি হলো- দ্রব্যমূল্যের আকাশছোঁয়া বৃদ্ধি, দ্বিতীয়টি হলো- পরিবহন খাতে অস্বাভাবিক ভাড়া বৃদ্ধি।
এমনিতেই করোনা মাহামারীর কারণে সাধারণ জনগণের অর্থনৈতিক অবস্থার মারাত্মক অবনতি হয়েছে। বহু মানুষ চাকরি খুইয়েছে। অনেকের ব্যবসায় লালবাতি জ্বলেছে। এর ফলে আয় কমে গেছে বড় একটি অংশের। সম্প্রতি পরিচালিত দু’টি প্রতিষ্ঠান বিআইজিডি এবং পিপিআরসি যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে করোনাকালে নতুন দরিদ্র তিন কোটি ২৪ লাখ। ক্রমবর্ধমান দ্রব্যমূল্য এবং পরিবহন খাতের ভাড়া বৃদ্ধি এসব মানুষের যাপিত জীবনকে দিশেহারা করে তুলেছে। জনগণের কাঁধে বাড়তি ভাড়ার বোঝা চাপিয়ে বাস ও লঞ্চের ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হয়েছে। দূরপাল্লার রোডের বাসে ২৭ শতাংশ এবং ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহনগরীতে চলাচলরত ২৬ শতাংশ বাসভাড়া বাড়ানো হয়েছে। ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে মিনিবাসের ভাড়া পাঁচ টাকা থেকে বাড়িয়ে আট টাকা ও বাসের ভাড়া সাত টাকার স্থলে ১০ টাকা করা হয়েছে। অন্য দিকে লঞ্চের ভাড়া বৃদ্ধি ঘটেছে ৩৫ শতাংশ। নতুন ভাড়া নির্ধারণে তেলের দাম ছাড়াও এ খাতে বিনিয়োগ কমা, ঋণের সুদ, রক্ষণাবেক্ষণ, যন্ত্রাংশ, বিভিন্ন ধরনের চার্জ ও শ্রমিক বেতনসহ অন্যান্য ব্যয়ভারও হিসাবে এসেছে।
বিস্ময়ের ব্যাপার যে, মালিকদের ধর্মঘটে যেমন তর সয়নি, তেমনি বর্ধিত ভাড়া আদায়েও তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে এই ব্যয় বৃদ্ধির ফলে জনগণের যাতায়াতে, খাদ্যদ্রব্য ও অন্যান্য দ্রব্যাদি পরিবহনে কী প্রভাব পড়বে তা আদৌ বিবেচিত হয়নি। অনেকসময় এ ধরনের অবস্থায় সরকার জনমত যাচাইয়ের জন্য এবং অংশীজনের মতামতের অপেক্ষা রাখে। এবারে তার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। এবার তেলে দাম বাড়ার অজুহাতে সব বাসের ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। দেশের বেশির ভাগ বাস বা যানবাহন এখন তেলে নয়, গ্যাসে চলে। অথচ এই ডিজেলের দাম বাড়ানোর অজুহাতকে ব্যবহার করে অস্বাভাবিক ভাড়া বৃদ্ধি করা হলো। আর এ দেশের কালচার এরকম যে, একবার ভাড়া বাড়লে তা আর কমে না। মালিক সমিতি বলেছে, ২০১৩ সাল থেকে তারা ভাড়া বৃদ্ধির আবেদন জানিয়ে আসছে। এবারে তাদের সাধ পূরণ হলো। এভাবে জনগণের কাঁধে বাড়তি ভাড়ার বোঝা চাপিয়ে বহু অংশে লাভ বাড়িয়ে নিলেন বাস ও লঞ্চ মালিকরা। যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলেছে, সরকারকে বেকায়দায় ফেলে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। সমিতির পক্ষ থেকে বলা হয়, বাস ও লঞ্চযাত্রী তথা সাধারণ মানুষের ওপর জুলুম করা হয়েছে। দেশে প্রচলিত রেওয়াজ অনুযায়ী যদি কোনো পক্ষ ধর্মঘটে যায় বা বন্ধ করে তাহলে একটি নির্দিষ্ট সময়ের আগে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে তা অবহিত করতে হবে। মালিকপক্ষ কোনোরকম নিয়ম-কানুন না মেনে সরকারকে জিম্মি করে ভাড়া বাড়িয়ে দেয় এমন হওয়ার কথা নয়। হিসাব করে দেখা গেছে, ডিজেল ও কেরোসিন তেলের দাম বেড়েছে ২৩ শতাংশ আর পরিবহন ভাড়া বেড়েছে ২৭ শতাংশ। এর ফলে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনেরও লাভ বাণিজ্য ঘটবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার ও মালিকদের এই সমঝোতা ও সম্মিলিত উদ্যোগ শাসনব্যবস্থার ইতিহাসে একটি নজির হয়ে থাকবে। তিন দিন ধরে যেভাবে ঘটনাবলি এগিয়েছে তাকে অর্থনীতিবিদ শওকত হোসেন বলেছেন, ‘পাতানো খেলা’। নইলে এক লাফে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বাড়ানো হলো কিভাবে? এ দেশের ইতিহাসে দাম বাড়ানোর এই লম্ফঝম্প আর কখনো ঘটেনি। গত সাত বছরে সরকার জ্বালানি তেল আমদানি করে ৪৩ হাজার ১৩৭ কোটি টাকা লাভ করেছে। এই সাত বছরে বেশির ভাগ সময়ে প্রতি ব্যারেল জ্বালানি তেলের দাম ছিল ৫০ ডলারের নিচে। এর মধ্যে আবার এক বছর আগে তা একেবারে নিচে নেমে এসেছিল। ফলে বিপিসির লাভ লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। এ সময়ে সরকার জ্বালানি তেলের দাম কমায়নি। কেবল চক্ষুলজ্জার জন্য ২০১৬ সালে সামান্য কমানো হয়েছিল। এ কথা সত্য যে, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বেড়েছে। তেল রফতানিকারক দেশগুলো আগে লোকসান কাটাতে তেল উত্তোলন কমিয়েছে।
এ নিয়ে বিশ্বব্যাপী আলোচনার মধ্যেই জ্বালানি মন্ত্রণালয় হুট করে এক লাফে ১৫ টাকা করে দর বাড়িয়ে দেয়। বিশ্লেষকরা বলছেন, এতে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বিপিসির লাভ ঠিকই থাকল। এক টাকাও লোকসান হবে না। ফলে এবার আর সহনীয় পর্যায়ে মূল্যবৃদ্ধির কোনো আলোচনা শোনা গেল না। এক লাফে মূল্যবৃদ্ধি পরিবহন ভাড়া বাড়ানোর জন্য পাতানো খেলা কি-না সে প্রশ্ন অবশ্যই করা যায়। কেননা, সরকারি ঘোষণার সাথে সাথে সব ধরনের পরিবহন বন্ধ হয়ে যায়। সর্বাত্মক ধর্মঘটের মতো এই ব্যবস্থাকে সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান বলেছেন, ‘ধর্মঘট নয় বন্ধ রাখা হয়েছে’। একই সাথে বাস-ট্রাক-কাভার্ডভ্যান বা লঞ্চমালিকরা এই সুযোগ নিতে এক বিন্দুও দেরি করেনি। এ যেন ক্রিকেটের পাতানো খেলার মতো। অন্য আরেকটি বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ছয় মাস দাম না বাড়িয়েও চলতে পারত বিপিসি। আগেই বলা হয়েছে, সাত বছর একটানা মুনাফা করেছে বিপিসি। তাদের তহবিলে বিপুল অর্থও জমা হয়েছিল। তবে সে অর্থ আইন করে সরকার নিয়ে নিয়েছে। বিপিসি মনে করে, সরকার টাকা না নিলে অন্তত ছয় মাস ডিজেল ও কেরোসিনের দাম না বাড়িয়েও চলা যেত।
বাসভাড়া বাড়ানোর পর সারাদেশে এই নিয়ে ঘটে নৈরাজ্য। সাধারণ মানুষ যে যেভাবে পারে প্রতিবাদ করেছে। ফলে ঝগড়া বেধেছে জনগণ আর শ্রমিক-মালিকে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, মালিকপক্ষের হামলার শিকার হয়েছে সাধারণ জনগণ। সরকারপক্ষ কোথাও কোথাও ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে বাহবা নিতে চেয়েছে। এ যেন এক কঠিন মশকারা। যাত্রীরা বলছেন, বেশি নৈরাজ্য চলছে দূরপাল্লার বাসে। এমনিতেই এসব পরিবহনে আগে থেকেই অতিরিক্তি ভাড়া আদায় হয়ে আসছে। এখন জোর করে মানুষের কাছ থেকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেড় গুণেরও বেশি আদায় করা হচ্ছে। যদিও দূরপাল্লার বাসে ভাড়া বেড়েছে ২৭ শতাংশ। দেশের বিভিন্ন সভা-সমিতি থেকে ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদ করা হয়েছে। জনগণের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক দলগুলো ভাড়া বৃদ্ধি প্রত্যাহার চেয়েছে। তবে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করে, বিরোধী দলগুলোর প্রতিবাদ কর্মসূচি যথেষ্ট ছিল না। জনগণ চেয়েছিল একটি সর্বাত্মক কর্মসূচি। তাতে বিরোধী দলের ব্যর্থতাই প্রমাণিত হয়েছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপির বিরুদ্ধে এই অভিযোগ জোরালো যে, তারা গণমুখী কর্মসূচি দিতে ব্যর্থ হয়েছে বারবার। এই ভাড়া বৃদ্ধির ফলে স্পষ্টতই দেশের ধনিক-বণিক শ্রেণী লাভবান হয়েছে। আর চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাধারণ জনগণ। একজন ছড়াকারের ভাষায় ‘বাড়ছে দাম, ঝরছে ঘাম/জনগণের ধার নাহি কেউ ধারে/ সব ঝামেলা পড়ে গিয়ে আমজনতার ঘাড়ে’।
বাংলাদেশের ইতিহাসে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি নিয়ে মহাকাব্য রচনা করা যায়। স্বাধীনতার পর দ্রব্যমূল্য মাটি থেকে আকাশে উঠে যায়। সদ্য স্বাধীন দেশের বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে কেন্দ্র করে একশ্রেণীর মানুষ আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ নয়, বটগাছ হয়ে যায়। বনেদি ব্যবসায়ীদের বদলে ‘ব্রিফকেস বিজনেসম্যান’দের আবির্ভাব ঘটে। এখনকার মতো তখনো তারাই ছিল সবকিছুর মালিক মোক্তার। ছ’আনার টুথপেস্ট ছয় টাকায় বিক্রি হয়। তিন টাকার লবণ ৩০ টাকায় কিনতে হয়। ১০ আনার কাগজ ১০ টাকায় কিনতে হয়। একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বিশ^স্ততার সাথে বলছি, ১৯৭২ সালে চকবাজার ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ সেক্রেটারি বঙ্গবন্ধুর কাছে কান্নাকাটি করে কোহিনূর কেমিক্যাল কোম্পানির সোল এজেন্সি নিয়ে নেন।
তিনি যাবতীয় উৎপাদিত সামগ্রী গুদামজাত করেন। তার ফলে দুই আনার সাবান দুই টাকা হয়। যখন বঙ্গবন্ধুর কাছে অভিযোগ করা হয়, তখনো তিনি ‘সব ঝুট হ্যায়’ বলে রেহাই পেয়ে যান। এভাবেই এই মহান নেতার সরলতা ও সহজতাকে এক্সপ্লয়েড করেছে একশ্রেণীর আওয়ামী নেতাকর্মী। এখন আওয়ামী লীগ ১২ বছর ধরে ক্ষমতায় আছে। সেই ১২ বছর আগে যে দ্রব্যমূল্য ছিল আর এখন কী অবস্থায় আছে তা রচনা লিখে বোঝানোর দরকার নেই। সরকারের বাণিজ্য বিভাগ, আইনশৃঙ্খলা বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগ এই আকাশচুম্বী ক্রমেই বেড়ে যাওয়া দ্রব্যমূল্যের লাগাম টেনে ধরতে পারেনি কখনো। সিন্ডিকেট শব্দটি খুবই বহুল পরিচিত। এরা প্রকারান্তরে তারাই যারা দেশ শাসন করছে। যখন অস্বাভাবিক কিছু ঘটে তখন কাউকে গ্রেফতার করে অথবা গুদামে অভিযান চালিয়ে আইওয়াশ করা হয়। প্রকৃত আসামি বা সিন্ডিকেটওয়ালারা দলের দোহাই দিয়ে পার পেয়ে যান। মাঝখানে কৃষক বা উৎপাদনকারীরা বঞ্চিত হন। মধ্যস্বত্বভোগীরা আবার তারাই। সুতরাং সরিষায় ভূত থাকলে ভূত তাড়াবেন কিভাবে?
এই দ্বিবিধ অত্যাচার, পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধি ও দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি : দু’টির উৎস ও নিয়ন্ত্রণ একই সূত্রে গাঁথা। একে অপরের পরিপূরক। জনগণ নিতান্তই অসহায়। এখন স্বাধীন নাগরিক সমাজ ও শক্তিশালী গণমাধ্যম প্রতিবাদের প্রাথমিক ভিত্তি রচনা করতে পারে। আর প্রকারান্তরে গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠাই হবে সর্বশেষ উত্তর।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]