- ড. আবদুল লতিফ মাসুম
- ২৫ আগস্ট ২০২১
কর্তৃত্ববাদে আমলাতন্ত্রই ক্ষমতার ভিত। দলতন্ত্র সেখানে লাঠিয়ালের ভ‚মিকা পালন করে। আমরা এরকম কথা এই কলামে এই সে দিনও লিখেছি, যখন সংসদে আমলাতন্ত্রকে একতরফা গাল দেয়া হয়েছিল। আমাদের আত্মতুষ্টি এখানে যে, আওয়ামী ঘরানার বুদ্ধিজীবীরাও প্রকারান্তরে একই কথা বলছেন। প্রবীণ কলামিস্ট আবদুল গাফফার চৌধুরী মন্তব্য করেন ‘গণতান্ত্রিক কর্তৃত্ববাদ নয়, নব্যধনী ও আমলাতন্ত্রের মিতালী একধরনের অসহিষ্ণু সমাজ ও দাম্ভিকতাপূর্ণ আমলারাজ সৃষ্টির দিকে দেশটিকে ঠেলে দিচ্ছে মনে হয়’। (যুগান্তর, ২৩ আগস্ট, ২০২১)। ‘দেশ কোন পথে’ শিরোনামে তার আরো উপলব্ধি ‘একটি গণতান্ত্রিক দেশে রাষ্ট্রশক্তি যত প্রবল হোক, নাগরিক ও মানবিক অধিকার এত শক্ত থাকে যে, রাষ্ট্রশক্তির প্রতাপ থেকে সেই অধিকার একজন নাগরিককে রক্ষা করে। যে দেশে এ নাগরিক অধিকার দুর্বল অথবা একেবারেই নেই, সে দেশটি মোটেই গণতান্ত্রিক দেশ নয়; বরং সেটি ফ্যাসিস্ট স্টেটে পরিণত হওয়ার আগের পুলিশ স্টেট।’ পরীমণির পরিণতির প্রসঙ্গে তার এ মন্তব্য হলেও এটাই অপ্রিয় সত্য। নিকট অতীতে ‘পুলিশ স্টেট’ সম্পর্কেও এই কলামে সুনির্দিষ্টভাবে আলোকপাত করা হয়েছে।
উল্লেখ্য যে, সেরনিয়াবাত পরিবার বরিশালে অত্যন্ত ক্ষমতাবান। এখন আবুল হাসান সেরনিয়াবাত বরিশালের প্রধান নেতা। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আপন ভাগ্নে। তার বাবা ছিলেন আবদুর রব সেরনিয়াবাত। বাকশাল দলীয় ব্যবস্থায় তিনি জাতীয় কৃষক দলের প্রধান ছিলেন। মেয়র সাদিক সেরনিয়াবাত সে হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রক্ত সম্পর্কের আপনজন। সে যাই হোক, বরিশাল সদরে নির্বাহী কর্মকর্তা মুনিবুর রহমান এতটাই সাহসী হয়েছেন যে, তিনি এই পরিবারের একজনের বিরুদ্ধে অর্থাৎ মেয়রের বিরুদ্ধে খুনের মামলা করেছেন। লোকেরা বলে, তারও খুঁটির জোর আছে। এসব ক্ষেত্রে আওয়ামী নেতৃত্ব ওই ব্যক্তিকে সহজেই জামায়াত-শিবিরের লোক বলে চিহ্নিত করে থাকে। এবারে এটা বলা কঠিন হলো এ জন্য যে, ওই নির্বাহী কর্মকর্তার ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের সম্পৃক্ততার প্রামাণ্য রেকর্ড আছে। তা ছাড়া বরিশালের রাজনীতিতে স্থানীয় এমপি এবং পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্নেল (অব:) জাহিদ ফারুক এবং সেরনিয়াবাত পরিবারের ঠাণ্ডা যুদ্ধের কথা লোকজনের কানাঘুষায় শোনা যায়। ঘটনার শুরুতেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। সাধারণত দেখা যায়, আওয়ামী লীগের কোনো পোস্টার বা ব্যানার মাসের পর মাস শোভা পায়। এমনকি তারিখ চলে গেলেও তা সরাতে দেয় না আওয়ামী লীগ। এখানে ঘটেছে তার উল্টোটি।
লক্ষণীয় বিষয়, ঘটনাটি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মধ্যে সীমিত থাকেনি। এর সাথে একাত্ম হয়েছে পুলিশ প্রশাসন। সরকারি তরফের মামলার একজন হচ্ছেন কোতোয়ালি থানার ওসি। এর সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অনুমোদন থেকেছে জেলা ও বিভাগীয় প্রশাসনের। তারা বিজিবি মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তাহলে বোঝা যায়, দীর্ঘ দিন ধরে মেয়র পরিবারের বিরুদ্ধে যে লালিত ক্ষোভ ও ক্রোধের কথা শোনা যায় তা অমূলক নয়। এর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে প্রশাসনের সব স্তর। জনাব গাফফার চৌধুরী মেয়রের পক্ষে জনমতের ঘাটতির কথা উল্লেখ করেছেন। এ প্রসঙ্গে কিভাবে তিনি মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন সে গল্পটি এসে যায়। ২০০৯ সাল থেকে গায়ের জোরে নির্বাচিত হওয়ার যে সংস্কৃতি শুরু হয়েছে মেয়রের হিসাবটিও তার থেকে ভিন্ন কিছু নয়। নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বিব্রত হয়েছিলেন। সাহসী হতে পারেননি। শক্তিমদমত্ততার কাছে অসহায়ত্বের কাছে সে এক করুণ উদাহরণ।
সাবেক এই দলতন্ত্রের মোকাবেলায় আমলাতন্ত্রের যে বিবৃতি তা-ও ব্যাপকভাবে আলোচিত ও সমালোচিত হয়েছে। আমলাদের সমিতি অত্যন্ত শক্তভাবে নির্বাহী কর্মকর্তার পক্ষ নিয়েছে। বিবৃতির ভাষা হুবহু এরকম- ‘বরিশালের মেয়র যার অত্যাচারে সমগ্র বরিশালবাসী অত্যন্ত অতিষ্ঠ সেই সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর হুকুমে ইউএনও বাসায় হামলার ঘটনা ঘটেছে। অতএব বাংলাদেশ এডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন অবিলম্বে তার গ্রেফতার দাবি করছে। তার বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য অঙ্গীকার ব্যক্ত করছে। এসব রাজনৈতিক দুর্বৃত্তকে আইনের মাধ্যমে মোকাবেলা করা হবে।’ এ ভাষায় দলতন্ত্রের সরকার বিব্রত হয়েছে। তাদের শীর্ষ নেতারা আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে ক্ষোভ, ক্রোধ ও অসন্তোষ প্রকাশে কোনো অসঙ্কোচ করেনি।
এডমিনিস্ট্রেটিভ অ্যাসোসিয়েশনের বিবৃতির ভাষাকে এসব নেতারা ‘ঔদ্ধত্যপূর্ণ’ বলে অভিহিত করেছেন। তাদের ভাষা রাজনীতিকদের মতো’ এ কথাও বলেছেন কেউ কেউ। দুর্বৃত্ত, গুণ্ডাপাণ্ডা ইত্যাদি যেসব শব্দমালা আওয়ামী লীগ এতদিন বিরোধী দলের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছে- হয়তো এই প্রথম তাদের তা শুনতে হয়েছে নিজেদের মানুষের মধ্যে থেকে। আসলে এসব তো তাদের শেখানো বুলি। আমলারা রাজনীতির ভাষা বেশি করে ব্যবহার করছে বিগত ১২ বছর ধরে। আমলারা সরকারের লোক প্রমাণ করার জন্য দলের ভাষায় বিরোধীদের আক্রমণ করে আসছে। কুষ্টিয়ার একজন এসপি রাজনৈতিক বিরোধীদের গালি দিয়েছিলেন- বিদ্বজ্জনদের তা মনে থাকার কথা। শুধু তাই নয়, পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ে কে কী বলেছিলেন তা-ও মনে থাকার কথা। আর বিবৃতিতে ১৭টি বানান ভুলের কথা? কী ধরনের বিদ্বানদের আওয়ামী প্রশাসন আমলাতন্ত্রের শীর্ষে স্থান দিয়েছে সেটি তারই নমুনা!
বিরোধী দলের কেউ কেউ এডমিনিস্ট্রেটিভ অ্যাসোসিয়েশনের বক্তব্যকে অপেশাদারি, অশালীন ও অস্বাভাবিক বলেছেন। আসলে এটি ছিল আমলাতন্ত্রের পক্ষ থেকে দলতন্ত্রের প্রতি তাদের দীর্ঘ দিন লালিত ক্ষোভের প্রকাশ। ভাষাটি অস্বাভাবিক মনে হতে পারে। অস্বাভাবিক আচরণের জবাব স্বাভাবিক হতে পারে না। স্বাভাবিকভাবে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায়- আমলাতন্ত্র সরকারের অনুগত থাকবে। রাজনৈতিক এলিটদের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করবে; কিন্তু রাজনীতিকরা যখন তাদের গণবিচ্ছিন্নতা, দুর্নীতি, অক্ষমতা, অযোগ্যতা ও অনভিজ্ঞতার কারণে আমলাতন্ত্রের অনুগ্রহের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে তখন রাজনীতিকদের অসহায়ত্ব প্রমাণিত ও প্রকাশিত হয়ে পড়ে। রাজনীতিকরাও আমলাদের বিরুদ্ধে দু-দু’টি মামলা ঠুকেছে। তাহলে অন্তত মামলার ব্যাপারে ব্যালেন্স অব পাওয়ার নিশ্চিত হলো। এটাও প্রমাণিত হয়েছে যে, দলতন্ত্র তাদের প্রাথমিক অবস্থান থেকে এখন ব্যাক গিয়ারে আছে। এখন দলতন্ত্রের লাঠিয়ালের ভয়ে বড় বড় আমলা ভোলে পাল্টেছেন। সবার উপরে যে দলতন্ত্র সত্য তা আরেকবার প্রমাণিত হলো। অবশেষে ওই নির্বাহী কর্মকর্তার ট্রান্সফার এবং আমলা নেতাদের একটা কিছু হয়ে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, নিশীথ রাতে সমঝোতা হয়েছে আওয়ামী লীগ ও প্রশাসনের, সেই নিশীথ রাতের নির্বাচনের মতো। এখন আদালতের বাইরে সরকারি হস্তক্ষেপে দৃশ্যমান বৈরিতার অবসান হলো। আসলে আমলাতন্ত্র ও দলতন্ত্রের গহিন গভীরের অদৃশ্যমান বৈরিতার অবসান হবে কি? জনাব গাফফার চৌধুরীর ভাষায়, ‘এখন গোঁজামিল দিয়ে ঘটনাটি ধামাচাপা দেয়া হতে পারে। কিন্তু ভবিষ্যতে আরো ঘটনা ঘটবে। আমলাতন্ত্র প্রমাণ করবে, তারা নির্বাচিত সরকারের চাইতে অনেক বেশি শক্তিশালী’। মূলত আমলাতন্ত্র ও দলতন্ত্রের সঙ্ঘাত ঘটছে অনিবার্য আরেকটি তন্ত্রের অভাবে। আর সেটি হচ্ছে ‘গণতন্ত্র’। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অনিবার্য প্রতিষ্ঠান- শাসন বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগের সীমারেখা নির্ধারিত। নির্বাহী বিভাগের দু’টি অংশ- স্থায়ী নির্বাহী বিভাগ বা আমলাতন্ত্র। আর অস্থায়ী বা নির্বাচিত নির্বাহী বিভাগ বা মন্ত্রিপরিষদ বা রাজনৈতিক সরকার। এই রাজনৈতিক সরকার জনগণের সম্মতির ওপর নির্ভরশীল। এই সম্মতি বা নির্বাচন হচ্ছে রাজনৈতিক সরকারের নৈতিক ভিত্তি। সম্মতির বদলে শক্তি যখন সেই জায়গা দখল করে তখন শক্তির অন্তর্নিহিত অসারতার কারণে অবশেষে তা ভঙ্গুর তথা সামর্থ্যহীন হয়ে পড়ে। বিগত ১২ বছরে সম্মতির বদলে যে শক্তির শাসন, কেতাবি ভাষায় যাকে বলা হয় কর্তৃত্ববাদ তা কায়েম হয়েছে, ক্রমেই এখন তা বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রকে ব্যর্থতার প্রান্তসীমায় পৌঁছে দিয়েছে।
শুরু করেছিলাম জনাব আবদুল গাফফার চৌধুরীর কথা দিয়ে। এবার তার কথিত ‘সহি বড় সোলেমানিয়া’ পুঁথির গল্প দিয়েই শেষ করি। গল্পটি এরকম- ‘কিং সুলেমান একে একে তার সব প্রতিদ্ব›দ্বী রাজরাজড়াদের হত্যা করার পর একদিন একা সিংহাসনে বসে ভাবতে লাগলেন, এখন আর তার কোনো প্রতিদ্ব›দ্বী নেই। তিনি এখন যেমন খুশি তলোয়ার চালাতে ও ঘোরাতে পারেন। তিনি একাই এখন সারা পৃথিবীর রাজা। এ কথা ভাবার সাথে সাথে তিনি সিংহাসনে বসে বনবন করে তার তরবারি চালাতে লাগলেন। হঠাৎ তলোয়ারটি তার কাঁধ স্পর্শ করল। তার মাথা ধর থেকে আলাদা হয়ে গেল।’ শক্তি প্রয়োগের পরিণতি সম্পর্কে এর চেয়ে চমৎকার গল্প আর কী হতে পারে? জনাব চৌধুরী এই উদাহরণ টেনে দেশে শক্তিশালী বিরোধী দলের অনুপস্থিতিকে বিপজ্জনক বলেছেন। তার ভাষায় ‘জবাবদিহিতা ছাড়া যে সরকার শূন্যতার মধ্যে বাস করে শূন্যতাই তাদের গ্রাস করে’। তার মতে, এটি কর্তৃত্ববাদী শক্তির মধ্যে দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ। ক্ষমতাসীন সরকারের এই দম্ভ ও দ্বন্দ্ব দেখে মনীষী প্লেটোকে উদ্ধৃত করতে ইচ্ছা করছে- ‘তারা ঔদ্ধত্যকে অভিহিত করে আভিজাত্য বলে, অরাজগতাকে বলে স্বাধীনতা এবং অপব্যয়কে মহানুভবতা আর মূর্খতাকে বলে বিক্রম।’ (রিপাবলিক ৮ : ৫৬০)
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]