‘বাঘে ছুঁলে এক ঘা, পুলিশে ছুঁলে ১৮ ঘা’


দীর্ঘদিন হলো দেশে কোনো ভালো সংবাদ নেই। করোনায় মৃত্যুর পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে অব্যবস্থাপনায় রোগীর মৃত্যু, স্বাস্থ্যমন্ত্রীর অসংলগ্ন কথাবার্তা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দলীয়করণ, কারারক্ষী কর্তৃক কারাগারে ইয়াবা সরবরাহ, প্রচুর অর্থের বিনিময়ে কারাগারে অন্তরীণ থেকে জুম মিটিং, নিয়ন্ত্রণহীন সড়ক দুর্ঘটনা, পরকীয়ায় খুন, পারিবারিক কলহে খুন, সন্তান কর্তৃক পিতামাতা খুন, স্বামী কর্তৃক স্ত্রী খুন, স্ত্রী কর্তৃক স্বামী খুন, এসপি কর্তৃক স্ত্রী খুন, প্রতিদ্বন্দ্বিতাবিহীন নির্বাচনী সংস্কৃতি, বগুড়ার হাসপাতালে অক্সিজেনের অভাবে সাত রোগীর মৃত্যু, মহিলা পরিষদের প্রতিবেদন মোতাবেক গত জুন মাসে ৩২৯ জন নারী কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ অন্যান্য আইনের অপব্যবহার, গত ৬ মাসে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ৩৬ মামলায় ৮০ জন আসামি, মাদকাসক্ত পুত্রের ইটের আঘাতে কলেজ শিক্ষকের অকাল মৃত্যু, রাষ্ট্রীয় বেতনভুক্ত কর্মচারীদের (আমলা) পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণ, সাংবিধানিকভাবে নিরপেক্ষ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর দলীয়করণনীতি অবলম্বন, নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী দিয়ে আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতাধীন ঘরগুলো ভেঙে পড়ার খবর, প্রায়ই গ্যাস লিকেজ হয়ে নির্দোষ মানুষের পুড়ে মৃত্যু, পুলিশি রিমান্ডে নির্যাতনে আসামির মৃত্যু, বরিশালের উজিরপুর থানায় রিমান্ডে নারীকে যৌন নির্যাতনের অভিযোগে পুলিশ কর্মকর্তা প্রত্যাহার প্রভৃতি দুঃসংবাদের পাশাপাশি ইউটিউবে প্রচারিত একটি সংবাদ আশার সঞ্চার করেছে, যার সার-সংক্ষেপ এই যে, চট্টগ্রাম রেঞ্জের একজন এএসপি (আনোয়ার হোসেন শামীম) তার আওতাধীন থানাগুলোতে চাকরিরত পুলিশ সদস্যদের জনগণের সাথে ভালো ব্যবহারসহ শিষ্টাচারের প্রশিক্ষণ প্রদান করছেন। ‘ইউটিউব’ আরো বলেছে যে, এএসপি মহোদয় প্রতি থানায় পাঠাগার স্থাপন করেছেন যা থেকে পুলিশ সদস্যরা পেশাগত দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি বই পড়ে নিজ দায়িত্ব ও শিষ্টাচার সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে পারে। ‘ইউটিউব’ অনেক সময় অতিরঞ্জিত সংবাদ পরিবেশন করে, তবে আমি এ সংবাদটি বিশ্বাস করে একটি আশার আলো দেখতে চাই।

ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, জনগণের আস্থাভাজন একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে পুলিশ ডিপার্টমেন্টের সৃষ্টি। পৃথিবীর সৃষ্টিকাল থেকেই অপরাধীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা ছিল, যা ভিন্ন ভিন্ন সমাজে/রাষ্ট্রে ছিল ভিন্নতর। খ্রিষ্টপূর্ব ২৩০০ সালে সুমারিয়ান শাসন আমলে অপরাধের সংজ্ঞা বা বর্ণনা Codified করা হয়, যা সময়ে সময়ে অনেক পরিবর্তন, পরিবর্ধন, পরিমার্জন বা বিলুপ্ত করা হয়েছে। লন্ডনে কিং আলফ্রাড ডি গ্রেটের শাসনামলে জনগণের মধ্যে স্থানীয়ভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য ১০টি পরিবারকে সঙ্ঘবদ্ধ করে দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। উক্ত প্রথাটি Tithing system নামে পরিচিত ছিল। ১০৬৬ খ্রিষ্টাব্দে উইলিয়াম (নরমান বংশোভূত) ইংল্যান্ড জয় করার পর ওই প্রথা বাতিল করে পুলিশি ব্যবস্থা জোরদার করার জন্য ইংল্যান্ডকে ৫৫টি সামরিক জেলায় বিভক্ত করে। একজন Norman অফিসারকে প্রধান করে প্রতিটি জেলায় Shire Reeve নামে টিম গঠন করেন। রাজা উইলিয়াম এ প্রথাকে Frankpledge সিস্টেম নামকরণ করে সংশ্লিষ্ট এলাকায় প্রতিটি প্রাপ্ত বয়স্ককে এ প্রথার সাথে সম্পৃক্ত করে এ মর্মে শপথ নেন যে, তারা রাজার আদেশ নির্দেশ পালনে অনুগত থাকাসহ সংশ্লিষ্ট এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সচেষ্ট থাকবে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য ১৭ শতাব্দীতে পুলিশ ও পাবলিক সমন্বয়ে ইংল্যান্ডে Day Watch and Night Watch System চালু হয়। xgd প্রথা মোতাবেক কনস্টেবলরা দিনে ও জনগণ রাতে এলাকা পাহারা দিত, সে প্রথা পরবর্তীতে বিলুপ্ত হয়। শিল্প বিপ্লবের পর লন্ডন শহরের আইনশৃঙ্খলার ব্যাপক অবনতি ঘটলে পরিস্থিতি উন্নয়নের পন্থা উদ্ভাবনের জন্য ১৭৮০ থেকে ১৮২০ সালের মধ্যে পার্লামেন্ট পাঁচটি ইনকোয়ারি কমিশন গঠন করেন।

Sir Robert Peel ইংল্যান্ডের স্বরাষ্ট্র সচিব থাকাবস্থায় ১৮২৯ লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশ প্রতিষ্ঠা করেন এবং অপরাধ দমন ও শৃঙ্খলা রোধে পুলিশ ও জনগণের সমন্বয়ের ওপর গুরুত্ব অর্পণ করে ছয়টি নীতিমালা প্রদান করেন যাকে আধুনিক পুলিশিংয়ের নীতিমালা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যা নিম্নে উল্লেখ করা হলো :

১. পুলিশের প্রধান কাজ অপরাধ ও বিশৃঙ্খলা প্রতিরোধ করা।
২. জনগণের অনুমোদন সাপেক্ষে পুলিশের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হবে।
৩. স্বউদ্যোগে জনগণের সহযোগিতা পেলেই বোঝা যাবে, পুলিশের প্রতি জনগণের আস্থা রয়েছে।
৪. আইন ও জনগণের প্রতি নিরপেক্ষ সার্ভিস প্রদান করে জনসমর্থন আদায় করতে হবে।
৫. জনগণের সাথে পুলিশের এমন সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে যাতে জনগণ মনে করে যে, পুলিশই জনগণ এবং জনগণই পুলিশ।
৬। পুলিশের ক্ষমতা বা প্রভাব নয়, বরং অপরাধ দমন ও শৃঙ্খলা রক্ষাই পুলিশের যোগ্যতার মাপকাঠি হিসেবে বিবেচিত হবে।

সভ্যতার সৃষ্টি থেকে পুলিশি ব্যবস্থার সৃষ্টি, যা পর্যায়ক্রমে পৃথিবীব্যাপী একটি শক্তিশালী ও মজবুত প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। আধুনিক পুলিশিংয়ের জনক Robert Peel পুলিশি কার্যক্রমের ওপর জনগণের আস্থা ও সর্বক্ষেত্রে পুলিশের ‘নিরপেক্ষতার’ ওপর যে গুরুত্ব প্রদান করেছেন। বর্তমানে বাংলাদেশের পুলিশ কি সে অবস্থায় পরিচালিত হচ্ছে?

পুলিশ জনগণের বন্ধু, কথাটি প্রতিষ্ঠা করার জন্য পুলিশের সর্বোচ্চ কর্মকর্তারা নানা বয়ানে আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। কিন্তু যেখানে দেশব্যাপী গায়েবি মামলার আসামি হয়ে হাজার হাজার বিরোধীদলীয় সমর্থক, নেতাকর্মীকে হাইকোর্টের বারান্দায় দিনকে দিন কাটাতে হয়েছে, সেখানে পুলিশের ভূমিকা কি নিরপেক্ষ বলা যাবে? ভোটের আগের রাতে ভোট হয়ে যাওয়ার অভিযোগের সমাধান কে দেবে? এজন্য জনগণের কাছে কে জবাবদিহি করবে? এসব প্রশ্নেরও মীমাংসা করার সময় কি এখনো হয়নি? এসব প্রশ্নের সাথে পুলিশের নগ্ন হস্তক্ষেপের জোরালো প্রমাণ কি দেশবাসীর কাছে নেই? সব ঘটনাই কি জনগণ ভুলে যায়? ভোটারবিহীন ভোটকেন্দ্রের কথা জনগণের ভোলার নয়।

সরকার প্রতিনিয়তই কঠিন কঠিন আইন প্রণয়ন করছে যা প্রয়োগের দায়িত্ব পুলিশের ওপর বর্তানো হয়। ফলে জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে পুলিশের নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছ ভূমিকা অনস্বীকার্য। সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি বলেছেন যে, শতকরা ৮০% মামলায় সাজা হওয়ার পরও আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। তিনি আরো বলেছেন যে, সাজা দিয়ে পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব নয়। প্রধান বিচারপতির ওই মন্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি উন্নয়ন ও অপরাধ কমিয়ে আনার জন্য কোথায় ব্যত্যয় ও ত্রুটি রয়েছে তা খুঁজে বের করা দরকার। জেলখানায় বন্দী অবস্থায় দেখেছি, অনেক নির্দোষ মানুষ জেল খাটছে, অর্থ ও তদবিরের অভাবে বের হতে পারছে না। অন্য দিকে ‘কারাগারকে’ বর্তমান সময়ে সংশোধনাগার বললেও কারাভোগীদের সংশোধনের যে পরিবেশ, পরিস্থিতি ও প্রায়োগিক প্রশিক্ষণ দরকার সে অবস্থা কাগজে-কলমে থাকতে পারে, কিন্তু বাস্তবে নেই।

আদালত বিচার করে বটে, পুলিশ কিন্তু বিচারব্যবস্থার প্রথম স্তর। কারণ ইনকোয়ারি, ইনভেসটিগেশন, চার্জশিট, ফাইন্যাল রিপোর্ট সব কিছুই পুলিশের হাতে। বাদির মামলা সম্পূর্ণ সত্য তাও বলা যায় না বা সম্পূর্ণ মিথ্যা তাও বলা যায় না। আমাদের সমাজব্যবস্থার পেক্ষাপটে এক ভাই খুন করলে বাদি তিন ভাইকেই আসামি করে মামলা দেয়, পুলিশের অনুরূপ চার্জশিটের কারণে তিন ভাইয়েরই সাজা হয়েছে এমন দৃষ্টান্ত প্রচুর।

বাংলাদেশ পুলিশের কোনো কোনো ক্ষেত্রে চৌকস ভূমিকা থাকলেও Robert Peel এর সংজ্ঞানুযায়ী পেশাদারিত্বের প্রশ্নে বর্তমানে তারা প্রশ্নের সম্মুখীন। তাই জনগণের আস্থা অর্জন করতে ব্যর্থ হচ্ছে। জনগণ মনে করে, জনস্বার্থ নয় বরং সরকারের স্বার্থ রক্ষা করাই যেন পুলিশের প্রধান দায়িত্ব। সরকারি দলের প্রভাব ও লুটপাট এখন গ্রামগঞ্জে পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছে। জায়গা, জমি, দোকানপাট, ব্যবসা-বাণিজ্য এখন সরকারি দলের হস্তগত এবং নিজেদের জমি, সম্পত্তি, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রভৃতি রক্ষা করতে বিরোধী দলের লোকেরা শত নির্যাতিত হলেও সংশ্লিষ্ট থানার কোনো সাহায্য পাচ্ছে না। পুলিশ যদি রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত একটি পেশাদার বাহিনী হিসেবে গড়ে উঠত তবে এ দেশের মানুষকে সরকারি দলের আগ্রাসনের জন্য ভয়ভীতির মধ্যে থাকতে হতো না।

ইংরেজিতে একটি প্রবাদ রয়েছে যে, Prevention is better than cure। পুলিশ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই মতবাদটি কমিউনিটি পুলিশিংয়ের ক্ষেত্রে শত ভাগ প্রযোজ্য। কিন্তু আমাদের দেশের কোনো কোনো পুলিশ কর্মকর্তা পেশাদারিত্বের পরিবর্তে ক্ষমতাসীনদের তাঁবেদারে পরিণত হয়েছেন। উল্লেখ্য, সরকারবিরোধী কোনো বিক্ষোভ দেখলেই পুলিশ অকাতরে লাঠি চার্জ করে জনগণকে আহত করে, পক্ষান্তরে জনগণ আত্মরক্ষা করলে হয়ে যায় Police Assult মামলা, যার জামিন পেতে হলে হাইকোর্টে আসতে হয়।

অথচ শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ করা স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। বোম্বে সিনেমার পুলিশের একটি ডায়লগ ‘তুমি মারলে হবে মার্ডার কেইস এবং আমি (পুলিশ) মারলে হবে এনকাউন্টার’। এ অবস্থা জনগণ দেখতে চায় না। কতিপয় উচ্চাভিলাষী ব্যক্তির কারণে রাষ্ট্রীয় বেতনভুক্ত একটি বাহিনী প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে না। গ্রামবাংলায় একটি প্রবাদ রয়েছে, ‘বাঘে ছুঁলে এক ঘা, আর পুলিশে ছুঁলে ১৮ ঘা’। জনগণের অর্থে লালিত এ বাহিনীকে জনগণের আস্থায় আনার জন্য উপরিউক্ত প্রবাদটি তাদের কর্মপ্রচেষ্টায় অবশ্যই ঘুচাতে হবে, তবেই বাহিনীটি হবে একটি আদর্শ পেশাদার বাহিনী যার ওপর আস্থাশীল হয়ে দলমত নির্বিশেষে নিরপরাধ সব নাগরিকের জীবন, সম্পদ ও সম্মান রক্ষা পাবে।