- সালাহউদ্দিন বাবর
- ০২ মে ২০২১
প্রতিষ্ঠিত সমাজ, রাষ্ট্র এমনকি ব্যক্তিজীবনকে সুন্দর সুশৃঙ্খল করে তুলতে চাইলে যদি কোনো লক্ষ্য প্রেরণা শুভাকাঙ্ক্ষা না থাকে তার উদাহরণ হবে উত্তাল সমুদ্রতরঙ্গে হালভাঙা এক তরীর মতো। বিশ্বে বিজ্ঞজন বা মনীষী জাতি বা দেশকে সঠিক দিক দিয়ে গেছেন, সেই দিশা ধরেই সভ্যতা আজ অবাধ এগিয়েছে। দেশ সমাজের ক্ষেত্রেও এগিয়ে যাওয়ার জন্য তাদের চিন্তাচেতনা আর অঙ্গুলি হেলনই ছিল মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর মূল প্রেরণা। সৌভাগ্য তাদেরই তথা সেই জনপদের মানুষেরই যারা এমন ক্ষণজন্মা নেতাদের পেয়েছিলেন। আর তার বোধ বিবেচনা ও চিন্তার দ্বারা স্নাত হয়েছিলেন।
যদি তরীর হাল ভেঙে ফেলি আর মনীষীর দেয়া পথ চলার সঠিক নকশাটা হারিয়ে যায়, এক সময় উত্তাল সমুদ্রের অতলে তলিয়ে যেতে হবে। আর যদি সমুদ্রে না হয়ে কোনো ভূভাগে হয়, সে ক্ষেত্রে পথ হারিয়ে কোনো গহিন অরণ্যে হিংস্র প্রাণীর উদরে গিয়ে হজম হয়ে যেতে হবে। নেতা আর মহাপুরুষরা ক্ষণে ক্ষণে জন্মগ্রহণ করেন না। তাই তাদের রেখে যাওয়া আদর্শ পথনির্দেশিকা ধরে গন্তব্য পৌঁছাতে মেধা বুদ্ধিমত্তা আর বিবেচনাকে কাজে লাগাতে হবে। চিন্তার স্থবিরতা সমাজ মানুষকে জ্বরাগ্রস্ত আর অকর্মন্য করে ফেলে।
স্রষ্টা মানুষের যে অপরিসীম মেধা, সামর্থ্য এবং উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে রেখেছেন, তাকে যারা যত বেশি ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছে- জ্ঞানী গুণীজনদের অভিমত, সে জনপদের মানুষ তত বেশি এগিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে তথা লাভবান হতে পেরেছে। তারা বিশ্বে শিল্প অর্থনীতি আর প্রযুক্তি দিয়ে শুধু নিজেদের সমৃদ্ধ করে তোলেনি। আরো বহু ক্ষেত্রে তারা পৃথিবীর পরিচালনার আসনে উপবিষ্ট হয়েছে; সেসব দেশের মানুষের জীবনকে সমৃদ্ধ আর স্বাচ্ছন্দ্যে ভরিয়ে দিয়েছে, সে জনপদের মানুষকে, এমন বৈষয়িক উন্নতির পাশাপাশি মানবিক মূল্যবোধের দিক দিয়েও সংবেদনশীল হিসেবে অতুলনীয় করে তুলেছে। আগেই বলেছি, এ বিষয়গুলোকে যে জাতি সর্বাগ্রে যতটুকু বিবেচনায় নিতে পেরেছে আর সে আলোকে নিজেদের মেধা বুদ্ধি শ্রম আর প্রজ্ঞা খাটাতে পেরেছে সে অনুসারেই তারা এগিয়েছে।
সবাই এক কাতারে যাত্রা করলেও লক্ষ্যে পৌঁছতে উল্লিখিত কারণেই তারতম্য ঘটেছে। এ ক্ষেত্রে নেতৃত্বদানের বিষয়টাও বিবেচনায় নিতে হবে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের যেমন গুরুত্ব আছে সেই সাথে তার ব্যবহারের সঠিক কৌশল প্রয়োগের কথাটাও ভাবতে হবে। যাই হোক, আগের কথাগুলোর পুনরাবৃত্তি করে বলছি : যাত্রা একত্রে শুরু করলেও কচ্ছপ আর খরগোশের মতো যদি চলা শুরু করা হয় তবে যা হওয়ার তাই তো হবে। এই গল্পটা যদিও বহু প্রাচীন, তারপরও সবাই তা থেকে শিক্ষা নিতে পারেনি। আর এ জন্যই বিশ্বের দেশগুলো নানা শ্রেণীতে বিভক্ত। কেউ নিজেদের সমৃদ্ধির উচ্চ স্তরে নিতে পেরেছে। সেই বিবেচনায় তারা প্রথম বিশ্বের সদস্যভুক্ত দেশ, কেউবা মধ্যমানের তথা মধ্যম আয়ের দেশ। আর যারা নিজেদের তেমন এগিয়ে নিতে পারেনি তারা পৃথিবীতে ‘তৃতীয় বিশ্বের দেশ’ হিসেবে পরিচিত। এমন মানদণ্ডে বিভক্ত দেশগুলোর মানুষের জীবনমান উচ্চতার দিক থেকে ক্রমান্বয়ে ওপর থেকে নিচের দিকে নেমে এসেছে। দেশগুলোর এভাবে উপরে-নিচে নামার ক্ষেত্রে অবশ্যই প্রকৃতিপ্রদত্ত সম্পদেরও অবদান অনেকটাই; কিন্তু ষোলো আনা নয়। উপরে যে কথাগুলো উল্লেখ করে এসেছি, তারই পুনরাবৃত্তি করে বলতে চাই- স্রষ্টা মানুষকে যে অপরিসীম মেধা বুদ্ধি বিবেচনা দিয়েছেন সেটাকে সফলভাবে কাজে লাগানোর মধ্যেই বস্তুত সাফল্যের জাদুটা সুপ্ত হয়ে আছে। সুপ্ত থাকা সেই জাদুর কাঠিটা অবশ্যই পড়তে হবে যোগ্য মানুষের হাতে। মনে রাখতে হবে, পৃথিবীটা আজ আর খুব সহজ সরল কোনো স্থান নয়। এখন পৃথিবী অনেক জটিল হয়ে পড়েছে, অতীতের সেই সহজ সরল অবস্থায় আর নেই। এখন রাজনীতি অর্থনীতি কূটনীতি এসব কিছুর বিশ্লেষণেই পৃথিবীর দেশগুলোর আয় উন্নতি আর প্রগতির পথ নির্ধারিত হয়। আজ রাজা-মহারাজারা নেই যে, তাদের হাত ধরে তার দেশ চলবে। এখন এর বিকল্প হচ্ছে প্রতিটি জনপদের মানুষ তাদের দেশ চালানোর ব্যক্তিটিকে বেছে নেবে। যাকে আজ আমরা গণতান্ত্রিক পথ প্রক্রিয়া বলছি, এটাও খুব সহজ ব্যাপার নয়। দীর্ঘ দিনের পথপরিক্রমার মধ্য দিয়েই এই পদ্ধতি আজ একটা মানে এসে দাঁড়িয়েছে। তবে তা স্বচ্ছ হতেও বহু সময় লেগেছে। এ কথা সত্য যে, স্বচ্ছ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া আজ অবধি সব জনপদে সমভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। যারা তা করতে পেরেছে, সংক্ষেপে বলব তারা প্রথম বিশ্বেরই মানুষ। যোগ্য নেতা বেছে নেয়ায় মানুষের মতপ্রকাশের বাধা বিপত্তিহীন স্বচ্ছতা সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেই সাথে এটা বলা আবশ্যক যে, সেখানে যারা নেতৃত্ব পাননি তারাও যে মেধাশূন্য অপাঙ্ক্তেয় সেটাও নয়। তাদেরও দেশের মঙ্গল আর স্বার্থে ন্যায্য কথাটা বলার বহু ফোরাম সেখানে রয়েছে।
বাধাহীনভাবে তারা নিজেদের মতপ্রকাশ করতে পারেন। এর মাধ্যমেই নানা মতের সম্মিলনের এক অনুপম সুযোগ সৃষ্টি হয়। এভাবেই দেশ গড়ার ক্ষেত্রে সবাই সেখানে অংশ নিতে পারায় তৃপ্তি বোধ করেন। ফলে ক্ষোভ-বিক্ষোভ আর বিদ্বেষ সৃষ্টির অবকাশ সেখানে কম। এতে যে স্থিতি আসে তাতে দেশ গড়ার কাজটা সহজ আর গতিশীল হয়। অবশ্য এই অবস্থায় পৌঁছতে দেশগুলোকে অনেক ধৈর্য আর সহিষ্ণুতার পরিচয় দিতে হয়েছে। তার জন্য সময়ও ব্যয় করতে হয়েছে অনেক। আর সময়টা মিছেমিছি ব্যয় হয়নি যে, ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তার কারণ এই পথ পদ্ধতি উদ্ভাবন অনুশীলন এবং আত্মস্থ করতেই সময়টা লেগেছে। আর এই পথ পদ্ধতিটা তৈরি করা ছিল না। আর সব স্তরের মানুষকে তা বোঝার জন্য অবকাশ দিতে হয়েছে। সমাজে প্রচলিত রয়েছে- ‘নানা মুনির নানা মত’। এই নানা মতকে কাছাকাছি আনার ব্যবস্থা করাটা খুব কঠিন ও বড় মাপের কাজ ছিল। আজো কাজটা যে খুব সহজ নয়, তার বাস্তব অভিজ্ঞতা বহুজনের আছে। একেবারে সাধারণ গ্রাম্যসালিস করাও যে কত জটিল তা তারাই বোঝেন যাদের এসব কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে। সে যাই থাক, আজো গণতন্ত্রের ধারণা যে সবার কাছে সমানভাবে ধরা দিয়েছে তা হলফ করে বলা যাবে না। তা ছাড়া সব মানুষ গণতন্ত্রকে বুঝতে পেরেছে বা বুঝতে দেয়া হচ্ছে এমনও নয়। মহল বিশেষের গণতন্ত্রের পক্ষে এ জন্য নয় যে, ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার গোষ্ঠী বিশেষের যে প্রয়াস আর প্রচেষ্টা তাও বহু দিন থেকে চলছে। ফলে সেটা শক্ত মজবুত দেয়ালে রূপান্তরিত হয়েছে। যারা এসব প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে সমাজেও তারা একটা শক্ত ভিত গড়ে তুলেছে কিছু স্বার্থভোগীকে নিয়ে। তাই এই দেয়াল ভেঙে দেয়া সহজ হচ্ছে না। কেননা, সেই ক্ষমতা গোষ্ঠী বিশেষের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক স্বার্থ, কর্তৃত্বকে সংরক্ষণ করে যাচ্ছে। আর গণতন্ত্রের পদ্ধতি প্রক্রিয়া তো গোষ্ঠীতন্ত্রের স্বার্থকে ক্ষুণ্ন করবে জনগণের অভিমতের প্রতিষ্ঠা করে। বহু দেশে গোষ্ঠীতন্ত্রের শাসন যেমন চলছে, তেমনি সেখানে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ উষ্মাও রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। সাধারণের ক্ষোভ উষ্মা থেকে সৃষ্টি হচ্ছে বিক্ষোভ। এই বিক্ষোভ দমনের জন্য পীড়ন নির্যাতনও জারি রয়েছে।
তাই সেই সব দেশে অস্থিরতা বিরাজমান। গোষ্ঠীর স্বার্থ প্রাধান্য পাওয়া এসব দেশের সাধারণ মানুষ শুধু রাজনৈতিক নির্যাতনই ভোগ করছে না, চরম অর্থনৈতিক নিপীড়নের মধ্য দিয়ে তাদের জীবনযাপন করতে হয়। সেখানে সাধারণ মানুষ যেমন দৈন্যদশায় জীবনযাপন করে, তেমনি শিক্ষা স্বাস্থ্যের কোনো নিশ্চয়তা তাদের নেই। এসব দেশ বস্তুত বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্নভাবে অবস্থান করে। তবে গোষ্ঠীতন্ত্রের আন্তর্জাতিক রাজনীতির নানা কূটকৌশলও রয়েছে। ফলে সাধারণের অধিকার প্রতিষ্ঠার যুদ্ধটাও সেখানে অনেক কঠিন। গোষ্ঠীতন্ত্রের পুরোধাদের যে অর্থনৈতিক স্বার্থের কথা বলেছি কেবল তা নয়, গোষ্ঠীতন্ত্রের আন্তর্জাতিক মদদদাতাদেরও রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ সেখানে জড়িত।
গোষ্ঠীতন্ত্রের খেলা বহু জায়গাতেই চলছে। আমাদের পড়শি মিয়ানমার তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বিশ্ব চাইলে কি এর সমাধান করতে পারে না? আসলে বিশ্বের শক্তিধর কিছু দেশের সেখানে রাজনৈতিক অর্থনৈতিক এবং সামরিক কৌশলগত স্বার্থ রয়েছে। সেখানে গণতন্ত্রীদের সামরিক জান্তার গুলিতে বুক ঝাঁঝরা হয়ে যাচ্ছে। জাতিসঙ্ঘ নিন্দা করে লিপ সার্ভিস দিচ্ছে বটে। কিন্তু তার কোনো কার্যকারিতা নেই। বিশ্বের তিনটি বৃহৎ দেশ নেপথ্য থেকে মিয়ানমারের সামরিক সরকারকে মদদ দিচ্ছে।
ভূরাজনৈতিক স্বার্থ তথা এই অঞ্চলে নিজের সামরিক কর্তৃত্ব বজায় রাখার জন্য মিয়ানমারের সামরিক সরকারের মানবতাবিরোধী কার্যক্রমকে সমর্থন দিচ্ছে। এই তিনটি দেশও তাদের ভূখণ্ডে এমন নির্যাতন মানুষের বিরুদ্ধে চালায়। বাংলাদেশের মানুষ এবং মিডিয়া মিয়ানমার বাহিনীর নির্যাতন নিয়ে সোচ্চার। কেননা, এই বর্মিরা লাখ লাখ মানুষের, তথা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর চরম অত্যাচার চালিয়ে তাদের বাংলাদেশে ঠেলে দিয়েছে এবং দিচ্ছে।
দীর্ঘ দিন ধরে বাংলাদেশ এসব দুস্থ মানুষকে আশ্রয় দিয়ে আসছে। বাংলাদেশের মানুষ মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর শাসনের বিরুদ্ধে ভিন্ন কারণেও ক্ষিপ্ত। বাংলাদেশেও কিছুকাল আগে সামরিক শাসন চালিয়ে দেশের মানুষের গণতন্ত্রসহ সব মানবিক অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছিল। এ দেশের বিভিন্ন দল ও সর্বশ্রেণীর মানুষ দীর্ঘ প্রায় এক দশক যুগপৎ আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়েছে গণতান্ত্রিক অধিকার অর্জনের জন্য। তাদের সেজন্য বহু ত্যাগ তিতিক্ষা স্বীকার করতে হয়েছে। একসময় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এই জনপদের মানুষ যে স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু করেছিল তার কারণগুলোর মধ্যে ছিল স্বাধিকার অর্জন, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক মুক্তি এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। সে সামরিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এ দেশের মানুষ যুদ্ধ করেছে। সামরিক শাসন জারি করা হলে দেশের মানুষ গর্জে উঠেছিল। যাই হোক, এ দিকে আজো দেশে মানুষের কাক্সিক্ষত গণতন্ত্র তথা স্বাধীনভাবে নিজের পছন্দের ব্যক্তি বা দলকে ভোট দেয়ার সুযোগ অবাধ নয়। আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশ গণতন্ত্রের সূচকে কেবলই পিছিয়ে পড়ছে। গণতান্ত্রিক বিবেচনায় এক নিষ্প্রাণ অবস্থায় পৌঁছেছে বাংলাদেশ।
বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে সরকার ও তার প্রতিপক্ষের মধ্যে নীতি আদর্শের মত-পথের দূরত্ব অনেক হওয়া সত্ত্বেও পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা সমীহ বজায় রেখে নিজ নিজ রাজনৈতিক আদর্শের প্রচার ও প্রসারের জন্য তারা সহনশীলতার সাথে কাজ করে থাকে। মতপার্থক্য নিয়েও জাতীয় যেকোনো সঙ্কটকালে তারা সরকার নয়, দেশের জন্য সবাই মিলে অটুট দেয়াল রচনা করে যা আমাদের এখানে কল্পনা করাও সম্ভব নয়। যেহেতু এখানে সংসদে প্রকৃতপক্ষে কোনো বিরোধী দল নেই; তাই প্রতিপক্ষের প্রতি সহিষ্ণুতা প্রদর্শন এবং পরামর্শ গ্রহণ নিয়ে কথা বলার অবকাশ নেই। সংসদের বাইরে যে, প্রকৃত বিরোধী দল, তাদের সাথে ক্ষমতাসীনদের সম্পর্ক প্রবাদবাক্যের সাপে-নেউলের মতো। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এমন বৈরী যে, এখানে সুস্থ গণতান্ত্রিক ধারার বিকাশ সম্ভব বলে মনে করা যায় না। ক্ষমতাসীনরা এতটা অহমিকায় ভোগেন যে, অন্য কাউকে তাদের বিকল্প ভাবা তো দূরের কথা, কোনো জাতীয় ইস্যু নিয়ে পরস্পর মতবিনিময় করার মানসিকতাই তাদের নেই। তাদের প্রতিপক্ষ যারা তারা তো তাদের মতোই এই দেশেরই নাগরিক। তাদেরও দেশের ভালো-মন্দ নিয়ে ভাবা এবং তা প্রকাশ করার সাংবিধানিক অধিকার রয়েছে। এমন ধারণার ধারে কাছে সরকার নেই। বিশ্বের অন্যান্য দেশে বিশেষ করে গণতান্ত্রিক দেশগুলোর এগিয়ে যাওয়ার নানা কারণের মধ্যে এটাও একটা যে, সৎ ও লাগসই পরামর্শ যেখান থেকেই আসুক তা তারা ধৈর্যের সাথে শোনে এবং উপযুক্ত বিবেচিত হলে তা গ্রহণও করে। সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশও গণতান্ত্রিক দেশ; কিন্তু গণতন্ত্রের যেসব শর্ত অনুশীলন করা অপরিহার্য সেগুলোর কোনো চর্চা আমাদের এখানে নেই। আমাদের রাজনৈতিক দল পক্ষ আর প্রতিপক্ষে বিভক্ত। যে সাপে-নেউলের সম্পর্কের কথা বলেছি তা এতটা ভয়ঙ্কর যে, দলগুলোর মধ্যে সঙ্ঘাত সংঘর্ষ হানাহানির ঘটনা নিয়ত ঘটছে, অবাধে ব্যবহৃত হচ্ছে আগ্নেয়াস্ত্র। রাজনৈতিক অঙ্গনের এই যুদ্ধাবস্থা ভবিষ্যতে থামবে; তার কোনো সম্ভাবনা নেই। প্রতিটি দলের যে নানা অঙ্গসংগঠন রয়েছে বিশেষ করে যে ছাত্র অঙ্গসংগঠনগুলোর কথা বলছি, সেখানে আরো ভীতিকর অবস্থা বিরাজ করছে। সারা দেশে; বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে সেখানে পক্ষগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক এতটা হিংসাত্মক যে, কখনো কখনো খুনাখুনির পর্যায়ে গিয়ে তা পৌঁছে। এমন ঘটনা দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অহরহ ঘটছে। ভাবলে শিউরে উঠতে হয় যে, আজকের এসব ছাত্ররাই ভবিষ্যতে জাতীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করবে; দেশের নেতৃত্বের আসনে বসবে। তখন রাজনীতি কোনপর্যায়ে গিয়ে উপনীত হবে তা ভেবে কূলকিনারা পাওয়া যায় না। এমন নেতৃত্ব দেশকে কিভাবে শান্তি প্রগতি আর কল্যাণের দিকে নিয়ে যাবে?
দেশের রাজনীতিতে যদি স্থিতি শান্তিশৃঙ্খলা না আসে তার প্রভাব বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতিবাচক অবস্থার সৃষ্টি করবে। শিক্ষাঙ্গনের যে অবস্থার কথা উল্লেখ করেছি, আগামীতে দেশ কিভাবে নিরাপদ হবে দেশে শান্তি সংহতি না থাকলে? শিল্প বাণিজ্যের বিকাশ ঘটার সম্ভাবনা কিভাবে সৃষ্টি হবে। মানুষ যদি কর্মে নিয়োজিত হতে না পারে তাদের আয় রোজগার না থাকে তবে মানুষ এক উচ্ছৃঙ্খল জনতায় পরিণত হবে। আর তার পরিণতি যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে তা কল্পনা করা যায় না। দেশের বিপুল জনসংখ্যার বিষয়টা নিয়ে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে বলে মনে হয় না। গুরুত্ব দেয়া বলতে এটা বিবেচনায় আসে যে, জনগণের সেই অধিকারগুলো পূর্ণ করা অর্থাৎ অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের সুরক্ষা দেয়া। সম্প্রতি জনৈক মন্ত্রী একটা তথ্য প্রকাশ করেছেন। দেশের ২৮ ভাগ লোকের কুঁড়েঘর ছাড়া কোনো জমিজমা নেই। অথচ রাষ্ট্রের নির্দেশ হচ্ছে- দেশের মানুষের আয় বৈষম্যের অবসান। এর পথ হচ্ছে কর্তাদের কাজ করে জাতীয় সম্পদ সৃষ্টি করা। কেননা, সম্পদ যথেষ্ট না হলে আয় বৈষম্যের ব্যবধান ঘুচানো সম্ভব হবে না।
বাংলাদেশের রাজনীতি যেমন জটিল গোষ্ঠী বিশেষের কব্জায়। তেমনি আমাদের অর্থনীতির বিষয়বস্তু ততোধিক জটিল। অবশ্য এ জন্য রাজনৈতিক অব্যবস্থা অনেকটা দায়ী। আমরা এই আলোচনায় বিশ্বের দেশগুলোকে অর্থনৈতিক সামর্থ্যরে দিক থেকে যে বিভক্ত করেছি, এই বিভাজন আমরা করেছি বললে ভুল হবে। আসলে বিশ্ব ব্যবস্থার জন্য এই বিভাজন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কোথায় অবস্থান করছি? বেশ কিছু কাল আগে অর্থাৎ বিশ্বে কোভিড ছড়ানোর আগে আমাদের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল, বাংলাদেশ দ্রুতই মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হবে। তারপর কোভিডকালীন অবস্থার মধ্যে সরকারিভাবে ভিন্ন কথা বলা হলো- আমরা দরিদ্র দেশের পর্যায় থেকে উঠে এসেছি। কিন্তু এর অর্থ কী? সত্যিকারভাবে আমরা কোন অবস্থানে আছি? সম্প্রতি দেশের প্রায় সব পত্রিকায় এক অর্থনৈতিক প্রতিবেদনে প্রকাশ, কোভিড-এর শুরুর দিকে যে বিপুলসংখ্যক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে এসেছে, তাদের পক্ষে আগের অবস্থায় ফিরে আসা সম্ভবই হয়নি। বরং আরো বহু পরিবারের অবস্থার চরম অবনতি ঘটেছে। কোভিড পরিস্থিতির অবসান না হলে দেশের ভঙ্গুর অর্থনীতি উঠে দাঁড়াতে পারবে না। দেশে শ্রমজীবী পুরুষ মানুষের পাশাপাশি বহু নারী তাদের কাজ হারিয়েছে। চরম দুর্দশার মাঝে দিন যাপন করছে তারা। বাংলাদেশের অর্থনীতি বহুলাংশে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। কর্মসংস্থানের দিক থেকে দেশের প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ কৃষিকর্মে নিয়োজিত। কোভিডের কারণে কৃষিপণ্যের বেচাকেনায় তীব্র মন্দা চলছে। সে কারণে কৃষকের জীবনেও দুরবস্থা। দেশের বেশির ভাগ মানুষের অর্থনৈতিক জীবনে যদি মন্দা বিরাজ করে এটাই স্বাভাবিক যে, দেশের মানুষ ভালো নেই।
কোভিডের মন্দা কাটিয়ে ওঠার জন্য বিশেষ করে অর্থনৈতিক অঙ্গনে তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে বলে কোনো কথা শুনতে পাওয়া যায়নি। এ ক্ষেত্রে সরকারি প্রশাসনের যে ক্ষমতা বিষয়টি রয়েছে তার কোন উদাহরণ চোখে পড়ে না। কোভিড নিয়ন্ত্রণেও প্রশাসনের ক্ষমতার প্রমাণ নেই। কোভিডের টিকার বিষয়টি প্রশাসন যেভাবে পরিচালনা করছে সেখানে সক্ষমতার বিশেষ কোনো লক্ষণ নেই। অথচ কোভিড নিয়ন্ত্রণে আনা এখন সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত। তা তো দেখাই যাচ্ছে না; বরং টিকার ক্ষেত্রে ভারতনির্ভরতা যে কতটা অবিবেচনাসুলভ হয়েছে তা এখন হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করা যাচ্ছে।
একটি দক্ষ প্রশাসন যখন কোনো জটিল বিষয় নিয়ে কাজ করে তখন তার বহু বিকল্প সম্মুখে রেখে কাজ করে থাকে। বিশ্বে কোভিড নিয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সেই কোভিডের টিকা সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে বিকল্পের বিষয়টি নীতিনির্ধারকদের বিবেচনায় থাকা জরুরি ছিল। তাহলে আজকে বিকল্পের জন্য যে হন্যে হতে হচ্ছে তার আর প্রয়োজন হতো না। দুঃখ হচ্ছে, অতীতে নানা ক্ষেত্রে প্রশাসনের দুর্বলতার দরুন জনগণকে ভুগতে হয়েছে। কিন্তু এসব থেকে আমাদের সরকার কোনো শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেনি। একে অবশ্যই প্রশাসনের মেধা আর বিবেচেনার সক্ষমতার ঘাটতি বলতে হবে। কিছুকাল আগে পেঁয়াজ নিয়ে ভারতের কাছ থেকে যে শিক্ষা পাওয়া গিয়েছিল, এবার কোভিডের টিকা নিয়ে একই অভিজ্ঞতাটা অর্জন করতে হলো। অথচ কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই প্রতিবেশীর প্রতি আমাদের ‘দেওয়ানার’ ভাবটা জাতীয় স্বার্থের বিপরীত বলেই মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
প্রশাসনের এই ব্যর্থতা তথা টিকা নিয়ে এখন দেশ যে সঙ্কটের মুখে পড়েছে, তাকে সাধারণভাবে গ্রহণ করার কি কোনো সুযোগ আছে? দেশে কোটি কোটি মানুষের জন্য এখন টিকা কতটা জরুরি তা প্রশাসন উপলব্ধি করতে পারেনি। এই টিকা নিতে না পারার কারণে মানুষের জীবন কতটা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে সে বিবেচনা প্রশাসনে নেই। কারণ দেশে জবাবদিহিতার কোনো ব্যবস্থা সৃষ্টি হয়নি।
দেশের সরকার ও তার প্রশাসনের কাজের মূল্যায়ন করা তথা সাফল্য-ব্যর্থতা পর্যালোচনার ফোরাম হচ্ছে জাতীয় সংসদ। এর অধিবেশন প্রায়ই হচ্ছে। জাতির জীবন-মরণ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে যে কোভিড, তা নিয়ে গত প্রায় দুই বছরেও সংসদে কোনো আলোচনার কথা শোনা যায়নি। অথচ এ নিয়ে সরকার ও প্রশাসন কী করছে, তার কোনো জবাবদিহি হয়নি। ক্ষমতার সাথে যে দায়দায়িত্ব অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত এই বোধটুকুর হক কতটা এখন আদায় হচ্ছে? অবশ্যই জনগণের এসব জানার অধিকার রয়েছে। বিশ্বের বহু দেশে এমন বহু নজির রয়েছে যে, প্রশাসনের কোনো দায়িত্বশীল যদি তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করতে না পারেন, সে কারণে আত্মগ্লানিতে ভুগে স্বীয় পদ থেকে সরে দাঁড়ান সেই কর্মকর্তা। আমাদের এখানে দায়িত্ব পালনের বহু ব্যর্থতার কথা হরহামেশাই শোনা যায়। কিন্তু সেই ব্যর্থতার জন্য দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন তাদের অন্তত একজন, এমন কথা শুনেছেন বলে কেউ তা বলতে পারবেন না। অথচ আমাদের দায়িত্বশীল মহল নিজ কাজ করতে পারুক আর না পারুক; কথার ফুলঝুরি সাজাতে তাদের জুড়ি পাওয়া যাবে না। এভাবে পার পেয়ে যাওয়ায় দায়িত্ব পালন করা নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই আরো অনেকের মাঝে ঢিলেমিটা সংক্রামিত হচ্ছে। একটি কার্যকর ও দক্ষ প্রশাসনে এমন উদাহরণ থাকতে পারে না।