https://www.youtube.com/watch?v=JBNVEhjxuDo…
p.dw.com
সংবাদভাষ্য
টিকার রাজনীতির রাজনৈতিক টীকা
টিকা নিয়ে যে রাজনীতি হবে, তা আগেই ধারণা করা যাচ্ছিলো৷ এবার তা হাতেকলমে প্রয়োগ শুরু হলো৷ টিকা আবিষ্কার করলো যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড, উৎপাদন করলো ভারতের সেরাম৷ আর সে টিকা কেনার চুক্তি করার পর বাংলাদেশকে ‘উপহার’ দিচ্ছে ভারত৷
করোনা মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকেই ‘আমরা প্রস্তুত’ টাইপের কথা আমরা শুনে এসেছি৷ কিন্তু কিভাবে সংক্রমণ ছড়ানো যায়, কিভাবে মাস্ক-পিপিপি থেকে শুরু করে অন্য সব সুরক্ষা সামগ্রী বিতরণ করা যায়, কিভাবে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য লকডাউন কার্যকর করা যায়, সবকিছুতেই ভজঘট অবস্থাই আমরা দেখে এসেছি৷
কেবল সরকার নয়, জনগণও বর্তমানে বৈশ্বিক স্রোতের বিপরীতে গিয়ে সামাজিক দূরত্ব বাদ দিয়ে স্বাভাবিক সময়ের মতোই ঘুরতে যাচ্ছেন, উৎসব করছেন৷ কেবল মুখের নীচে মাস্ক ঝুলতে না দেখলে বোঝাই যেত না যে করোনা বলে কিছু আছে৷
স্বাস্থ্য গবেষকদের সব পরামর্শ উপেক্ষা করেও বাংলাদেশ কিভাবে অন্য সব দেশের চেয়ে সংক্রমণ ও অন্যান্য হার নিয়ন্ত্রণে রেখেছে সেটা নিয়ে গবেষণা হওয়াই উচিত৷ তবে এর পেছনে সরকারের পরিকল্পনার সাফল্য যে নেই তা চোখ বন্ধ করেই বলে দেয়া যায়৷
এর আগে পিপিপি ও মাস্ক সংকটের সময় চীন থেকে এসেছিল উপহার৷ এবারও ‘সব ঠিক আছে’ বলার পর ভারত থেকে এসেছে টিকার উপহার৷ এবং আমরা শুনতে পাচ্ছি সব পরিকল্পনা হয়ে গেছে৷ খসড়া পরিকল্পনা অবশ্য এরই মধ্যে ঘোষণা করেছে সরকার৷ সেটাতেও একটু জটিলতা আছে৷
ভারত যে দামে টিকা কিনছে সেরাম ইনস্টিটিউটের কাছ থেকে, তার চেয়ে এক ডলার বেশি দামে টিকা কিনেত হচ্ছে বাংলাদেশকে৷ সরকারের এত বড় অবকাঠামো এবং রোগ নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরকে বাদ দিয়ে বেসরকারি বেক্সিমকোকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে আনা, সংরক্ষণ করা, সরবরাহ ইত্যাদির৷ সরকার ভারতের কাছ থেকে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকায় তিন কোটি ডোজ টিকা কিনছে৷ আরো এক হাজার কোটি নিয়ে নিবে বেক্সিমকো৷
– টিকা কেনায় বিপুল পরিমাণ অর্থ লেনদেন হচ্ছে৷ অথচ এই টিকা কে কিনছে, সেটাও আমরা এখনও পরিষ্কার না৷ স্বাস্থ্যসচিব বলছেন এটা জিটুজি অর্থাৎ সরকারের সঙ্গে সরকারের চুক্তি, বেক্সিমকো হচ্ছে এজেন্ট৷ অন্যদিকে বেক্সিমকো বলছে, এটা তারাই সেরামের কাছ থেকে কিনে বাংলাদেশকে দিচ্ছে৷ এমনকি প্রথম আলোকে বেক্সিমকোর এমডি বলেছেন, ‘‘আমরা যে দাম বলছি, এর ডাবল দামে যদি কেউ দিতে পারে, আমি চ্যালেঞ্জ দিলাম৷” অসাধারণ, তাই না?
ধরে নিচ্ছি স্বাস্থ্যসচিবের কথা সত্য৷ এটা আসলেই জিটুজি চুক্তি৷ তাহলেও নীচের প্রশ্নগুলো মনে জাগে৷
– আমি সত্যিই জানি না, শিশুদের টিকাদানে বাংলাদেশ যে দারুণ সাফল্য দেখায় সেটার ব্যবস্থাপনা কিভাবে হয়? সরকারের কি টিকা সরবরাহ, সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার অবকাঠামো বেক্সিমকোর চেয়ে খারাপ? যদি খারাপই হয়, দেশের বড় সব ফার্মাসিউটিক্যালসে নিয়ে কনসোর্টিয়াম গঠন করে এর ব্যবস্থাপনা করা যেত না? কেবল তিন কোটি ডোজের জন্যই যদি এক হাজার কোটি টাকা ‘বাড়তি খরচ’ হয়ে দাঁড়ায়, পুরো দেশকে টিকা দিতে গেলে সে খরচ কততে গিয়ে দাঁড়াবে?
– এখন টিকা হাতে পাওয়ার পর বলা হচ্ছে ২৫ জনের ওপর পরীক্ষামূলক প্রয়োগের কথা৷ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের কথা৷ সেরামের সঙ্গে টিকা কেনার চুক্তির সময়ই পরীক্ষমূলক প্রয়োগের বিষয়টিও সেরেই রাখা যেত৷ সেটা করা হলো না কেন?
– প্রতি মাসে ৫০ লাখ ডোজ আসার কথা ভারত থেকে৷ সে হিসেবে মাসে কেবল ২৫ লাখ মানুষকে টিকা দেয়া সম্ভব হবে৷ বিভিন্ন দেশই এই টিকার জন্য একটা উৎসে নির্ভর করে না থেকে নানা জায়গা থেকে টিকা আনার চেষ্টা করছে৷ বায়োনটেক-ফাইজার বা মডার্নার এমআরএনএ টিকা অনেক দামি এবং সংরক্ষণ-সরবরাহ কঠিন৷ কিন্তু এছাড়াও রাশিয়া ও চীনের তৈরি টিকাও বেশকিছু দেশে সাফল্যের সঙ্গে চালুর খবর মিলছে৷ সেসব দেশের টিকার ব্যাপারে বাংলাদেশের কী অবস্থান? আশা করি টিকা নেয়ার ক্ষেত্রে জনগণকে বাদ দিয়ে আগে আন্তর্জাতিক রাজনীতির কথা চিন্তা করা হবে না৷
– করোনা টেস্ট করা নিয়ে যে দুর্ভোগে পড়তে হয়েছিল দেশের জনগণকে, সেটা কাটিয়ে উঠতে লেগেছিল অনেক সময়৷ ভুয়া টেস্ট নিয়ে তুলকালামও হয়ে গেছে৷ সেসব কথা মাথায় রেখে প্রস্তুতি কি নেয়া হচ্ছে? অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি, ভুয়া টিকায় বাজার সয়লাব হওয়া, বা সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে এ নিয়ে জালিয়াতি হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়৷ ফলে এ নিয়ে এখনই শক্ত অবস্থান না নিলে অচিরেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে৷
– টিকার জন্য চালু করা হয়েছে অ্যাপ৷ ঢাকা এবং বড় শহরগুলোতে শিক্ষিত মানুষগুলোর জন্য স্মার্ট ফোনে অ্যাপ ব্যবহার করে টিকার জন্য নিবন্ধন করা যতটা সহজ, মফস্বল বা গ্রামে অনেকেই তা পারবেন না৷ তাদের আমরা কিভাবে টিকার আওতায় আনার চেষ্টা করছি? সহজ ও দুর্নীতিমুক্ত পদ্ধতি চালু করতে না পারলে টিকার নিবন্ধন নিয়েও শুরু হবে ব্যবসা৷ একসময় অ্যামেরিকায় ডিভি ভিসার নিবন্ধনের জন্য বিভিন্ন দোকানে যেমন টাকা নেয়া হতো, গ্রামে-গঞ্জে টিকা নিবন্ধনের জন্যও এমন ব্যবসা চালু হবে না তো? বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে ‘স্পিড মানির’ বিনিময়ে আগে টিকা পাওয়ার ব্যবসা চালু হবে না, এমন নিশ্চয়তা কী দেয়া যাচ্ছে? ক্ষমতাধর ব্যক্তি তার স্বজনদের জন্য ‘ক্ষমতা খাটিয়ে’ আগে টিকা নেয়ার ব্যবস্থা করবেন না, এটা নিশ্চিত করা যাবে কী?
সমস্ত অব্যব্সথাপনা কাটিয়ে উঠে দ্রুতই বাংলাদেশ করোনার টিকার সুষ্ঠু বন্টন করবে, এটা আমাদের আশা৷ পাশাপাশি কেবল একটি টিকার মনোপলি বা একাধিপত্য কমানো যায় কিনা, সেটাও খেয়াল রাখতে হবে৷ জনগণ বিনামূল্যে টিকা পাচ্ছে, সেটা সত্যি৷ কিন্তু বেক্সিমকোর কাছ থেকে সরকার যে টিকা কিনছে, সেটা জনগণের টাকা দিয়েই কেনা হচ্ছে, এটাও মনে রাখা উচিত৷
- তারিখ 21.01.2021
- লেখক অনুপম দেব কানুনজ্ঞ