নরেন্দ্র মোদীর দিল্লী তাদের তাঁবেদার সরকারের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণকে তাদের সিরাম ইনস্টিটিউটে তৈরি অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রেজেনেকার ২০ লাখ চার হাজার ডোজ ভ্যাক্সিন ‘উপহার’ দিচ্ছে। ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী বলেছেন, বাংলাদেশ ও ভারতের ঐতিহাসিক বন্ধুত্বের নিদর্শনস্বরূপ ভারত সরকার বাংলাদেশের মানুষের জন্য ২০ লাখ চার হাজার ডোজ করোনাভাইরাসের টিকা ‘উপহার’ হিসেবে পাঠিয়েছে। এটা বিলাতের অক্সফোর্ড ও এস্ট্রাজেনিকার ভ্যাক্সিন না, অর্থাৎ বিলাতে উৎপাদিত হয়ে বাংলাদেশে আসে নি। ভারতের উৎপাদিত ভ্যাক্সিন। ভারতের ড্রাগ কন্ট্রোলার কোম্পানির দেওয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এর অনুমোদন দিয়েছেন। কিন্তু তথ্যের স্বচ্ছতা এবং অনুমোদনের প্রক্রিয়া নিয়ে খোদ ভারতেই তর্ক রয়েছে।
কোভিড-১৯-এর ভয়াবহ সংক্রমণ মোকাবিলায় ভ্যাক্সিন দরকার আছে, তাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু ভ্যাক্সিন নিয়ে দিল্লীর নব্য ‘উপহার কূটনীতি’বোঝার দরকার আছে। যারা নিয়মিত কাঁটাতারের বর্ডারে বাংলাদেশীদের হত্যা করে, বাংলাদেশিরা যাদের কাছে ‘উইপোকা’, তখন ঠাকুরের গান গাইতে সাধ হয়, “ওহে এত প্রেম আমি কোথা পাব নাথ তোমারে হৃদয়ে রাখিতে”।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম জানিয়েছেন করোনার টিকা নিতে হলে বায়োমেডিকাল গবেষণার জন্য একপ্রকার ইনফর্মড কনসেন্ট ফর্মে স্বাক্ষর করতে হবে। সম্মতিপত্রে ছয়টি শর্তে গ্রহীতাকে স্বাক্ষর করতে হবে। সেই সম্মতিপত্রের শর্ত পড়লে বোঝা যায় বাংলাদেশে এই ভ্যাক্সিন নিছকই টীকা কর্মসূচী নয়, বরং মানবদেহে ভ্যাক্সিন পরীক্ষা করাই আসল উদ্দেশ্য। সেটা করা হবে কোন প্রকার খরচ বা দায় ছাড়াই। বাংলাদেশের জনগণকে ভ্যাক্সিন পরীক্ষার গিনিপিগ বানানো হবে এবার।
খুরশিদ আলম জানিয়েছেন ভ্যক্সিনের ফলে শরীরের সকল ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফল টিকাদাতাদের জানাতে গ্রহীতা বাধ্য থাকবে, অর্থাৎ গবেষণার তথ্য খুবই সহজে জোগাড় হবে। কিন্তু সম্মতি ফর্মে গ্রহীতা সাক্ষর হোক বা নিরক্ষর, তাকে অঙ্গীকার করতে হবে গবেষণার জন্য তথ্য দিতে গ্রহীতা বাধ্য। ইনফর্ম কন্সেন্ট বা গবেষণার জন্য সম্মতিপত্রের মানে গ্রহীতা বুঝুক বা না বুঝুক তাকে এ কথাও স্বীকার করে স্বাক্ষর বা টিপসই দিতে হবে যে করোনা টিকা সম্পর্কিত তথ্য তাকে অনলাইন ও সামনা সামনি উপায়ে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। অর্থাৎ গ্রহীতা জেনেশুনেই এই পরীক্ষামূলক ভ্যাক্সিন নিজের দেহে নিচ্ছে।
কিন্তু আরেকটি শর্ত গ্রহীতা মানতে বাধ্য, যা ভয়ানক। “’এই টিকা গ্রহণের সময়/পরে কোন অসুস্থতা, আঘাত, ক্ষতি হলে তার দায়ভার স্বাস্থ্য সেবা প্রদানকারী কিম্বা সরকারের নয়”। টিকা দেবার পরে গ্রহীতা অসুস্থ হলে তার চিকিৎসার খরচ গ্রহীতার। জনগণ মরুক কিম্বা ভ্যাক্সিন প্রতিক্রিয়ায় ভুগুক তার কোন দায় টিকাদানকারী কিম্বা সরকার কেউই নেবে না। এই হোল ‘উপহার’’। ভ্যাক্সিন উপহার দেবার ছলনা না করে বিধিবদ্ধ ভাবে গবেষণা হলে মানবদেহে পরীক্ষার জন্য বিশাল অংকের টাকা ভারতের ভ্যাক্সিন উৎপাদক কোম্পানি কিম্বা ভারত সরকারকে খরচ করতে হোত। ভ্যাক্সিন প্রতিক্রিয়ার দায়দায়িত্বো ভারতকে বা ভহারতীয় কোম্পানিকে নিতে হোত। ‘উফার’-এর নামে দিল্লী সেই দায়মুক্তি বাংলাদেশ থেকে আদায় করে নিল।
সম্মতিপত্রের ধরণ দেখে বোঝা যায় গ্রহীতা ভ্যাক্সিন নামে যা নেবে সেটা পূর্ণ বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও বায়ো-মেডিকাল এথিক্স বা নৈতিক নিয়মানুযায়ী পরীক্ষিত নিরাপদ ভ্যাক্সিন না। বরং বাংলাদেশের জনগণের ওপর ভ্যাক্সিন ট্রায়াল বা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা। যে দেশে গণতন্ত্র নাই, মত প্রকাশের স্বাধীনতা রুদ্ধ, শক্তিশালী কোন বায়োমেডিকাল গবেষণার কার্যকর নীতি বা আইন নাই, সর্বোপরি জনগণ ভ্যাক্সিনে মারা বা ক্ষতিগ্রস্ত হলে এবং তা প্রচার করলে সেটা ‘গুজব’ বলে শাস্তি দেবার মানবাধিকার বিরোধী ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন রয়েছে, তেমনি একটা দেশকে ভারত মানবদেহে ভ্যাক্সিন পরীক্ষার জন্য বেছে নিয়েছে। দিল্লীর কূটনৈতিক বুদ্ধির তারিফ না করে পারা যাচ্ছে না। “এতো প্রেম আমি কোথা পাব নাথ তোমারে হৃদয়ে রাখিতে এ এ এ মাঝে মাঝে তব দেখা পাই!!!!
অন্যদিকে বেসরকারি ভাবে ভারত থেকে আরো তিন কোটি ভ্যাক্সিন কোনো ইনভেস্টমেন্ট ছাড়াই বিনা টেন্ডারে আমদানির সুযোগ একটি বেসরকারী কম্পানিকে দেওয়া হয়েছে। যা ফাও মুনাফা কামাবার অবাধ সুযোগ। সেই ক্ষেত্রে দুই ডলারের ভ্যাক্সিন জনগণের কাছে বিক্রি করা হবে ৫ ডলারে। সেই ক্ষেত্রে তিন কোটি ভ্যাকসিনে মুনাফা কামানো হবে ৯ কোটি ডলার। তথাকথিত উপহারের দুই লাখ ভ্যাক্সিনের খরচ ৪০ লাখ । যা আসলে দিল্লীর মার্কেটিং কস্ট মাত্র।
দিল্লী মানবদেহে ভ্যাকসিন পরীক্ষার এই গালভরা নাম দিয়েছে ‘ভ্যাক্সিন মৈত্রী’। দারুন কূটনীতি বটে! যেখান ভারত কাঁটাতার দেওয়া সীমান্তে বাংলাদেশীদের নিয়মিত গুলি করে হত্যা করে, বাংলাদেশের জনগণ যাদের কাছে ‘উইপোকা’, সেখানে ভারতের ‘মৈত্রী’ কথাটা কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতো। দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে চীনের তৈরি ভ্যাক্সিন সিনোভ্যাক বা সিনোফার্মকে টেক্কা দেওয়া এই কূটনীতির আরেকটি উদ্দেশ্য। উপহারের তামাশা এই কূটনীতিকে এক নতুন মাত্রা দান করেছে। এতো প্রেম…।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন ভারতের ভ্যাক্সিন পেয়ে বলেছেন, ‘আজ আমাদের এক ঐতিহাসিক দিন। ভারত যে আমাদের অকৃত্রিম বন্ধু আবারও তার প্রমাণ দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় যেভাবে আমাদের সহায়তা দিয়েছে এবারও আমরা তাদের কাছ থেকে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সহযোগিতা পেলাম।’ স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, ‘আজ আমাদের বহুল প্রতীক্ষিত মাহেন্দ্রক্ষণ। এত দিন আমরা অপেক্ষায় ছিলাম টিকা আসবে আসবে বলে। এখন ২০ লাখ টিকা আমাদের হাতে এসে গেছে। ভারত যেভাবে মহান স্বাধীনতার সময় আমাদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিল। এবারও এই করোনা মহামারিতেও তারা সাহায্য করল টিকা দিয়ে। এটা আমাদের প্রধানমন্ত্রী ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বন্ধুত্ব ও দুই দেশের সৌহার্দ্যের প্রতীক।’
ঠিক। এতো প্রেম আমি কোথা পাব নাথ তোমারে হৃদয়ে রাখিতে। এ এ এ এ এ …!!