আল্লামা আহমদ শফি ইন্তেকালের ৩ মাস পর দায়ের করা হত্যা মামলাকে ষড়যন্ত্রমূলক উল্লেখ করে মামলা প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছেন হেফাজতে ইসলাম। ষড়যন্ত্রমূলক মামলা প্রত্যাহার না হলে কঠোর আন্দোলনের হুশিয়ারি দিয়েছে সংগঠনটি। মামলা প্রত্যাহার না হলে দেশের শীর্ষ ওলামায়ে কেরামদের বৈঠক ডেকে আলোচনার মাধ্যমে এই কর্মসূচি চুড়ান্ত করা হবে বলেও ঘোষণা করা হয়।
বুধবার (২৩ ডিসেম্বর) হাটহাজারী মাদরাসা মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে এই ঘোষণা দেন হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী। হেফাজত ইসলাম বাংলাদেশ এবং চট্টগ্রামের দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসার যৌথ উদ্যোগে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
হেফাজতে ইসলামের আমীর আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী বলেন, আল্লামা শাহ আহমদ শফীর মুত্যু ছিল স্বাভাবিক। একটি স্বভাবিক মৃত্যুর ঘটনার ৩ মাস পর দায়ের করা মামলাটি হচ্ছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত। রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারের চক্রান্তে এই মামলা দায়ের করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, হুজুরের (আহমদ শফি) প্রতি সবার শ্রদ্ধা ছিল এবং হাটহাজারি মাদ্রাসার সকলেই হুজুরের আশেক। হুজুরের ইন্তেকালের পর জানাজাও এই মাদ্রাসায়ই অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে হেফাজত ইসলামের আমির এবং হাটহাজারী মাদরাসার শিক্ষা পরিচালক জুনায়েদ বাবুনগরীর পক্ষে লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান হেফাজতের কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক নুরুল আবছার আজহারী।
এখানে উল্লেখ্য, গত ১৮ সেপ্টেম্বর আল্লামা আহমদ শফি ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। এর আগে হাটাহাজারি মাদ্রাসায় ছাত্র বিক্ষোভে তিনি পদত্যাগ করে মাদ্রাসা থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। সেখানে থেকে তাঁকে ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়। তাঁর ইন্তেকালের পর লাশ হাটহাজারি মাদ্রসায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানেই জানাজা হয়। ইন্তেকালের ৩ মাসের মাথায় গত ১৭ ডিসেম্বর হেফাজতে ইসলামের ৩৬জন নেতাকে অভিযুক্ত করে মামলা দায়ের করেন আল্লামা আহমদ শফির শ্যালক মোহাম্মদ মাঈন উদ্দিন। চট্টগ্রামের জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালত-৩ এর বিচারক শিপলু কুমার দে মামলাটি আমলে নিয়ে পিবিআইকে (পুলিশের ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন।
এই মামলায় হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব আল্লামা মামুনুল হকসহ আসামীদের সকলেই হেফাজত ইসলামের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃত্বে রয়েছেন।
এখানে আরো উল্লেখ্য, দেশব্যাপি শেখ মুজিবুর রহমানের মূর্তি নির্মান নিয়ে হেফাজতে ইসলামের সাথে সরকারের বিরোধ তৈরি হয়। হেফাজতে ইসলাম শেখ মুজিবুর রহমানের মূর্তি নির্মানের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়। মূর্তিকে ইসলাম ও বাংলাদেশের মুসলমানদের সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কৃতি বিরোধী উল্লেখ করে বিভিন্ন কর্মসূচিও পালন করেছে সংগঠনটি। এরপরই সরকারী দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের পক্ষ থেকে হেফাজতে ইসলামকে আক্রমন করে বক্তব্য দেয়া শুরু হয়। এমনকি পুলিশের আইজি থেকে শুরু করে এসপি পদের কর্মকর্তারাও আলেম ওলামাদের কটাক্ষ করে কটু মন্তব্য অব্যাহত রেখেছেন। শেখ পরিবারের সদস্য ফজলে নুর তাপস ও তাঁর বড় ভাই যুব লীগের সভাপতি শেখ ফজলে শামস্ আলেমদেরকে হুমকি দিয়ে বক্তব্য রাখছেন। আলেমদেরকে হুমকি দিয়ে দেওয়া বক্তব্যের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইতোমধ্যেই ক্ষোভের ঝড় উঠেছে। শেখ পরিবারের আত্মীয় যুবলীগের আরেক নেতা নিক্সন চৌধুরীও আলেমদের কটাক্ষ করে বক্তব্য রেখেছেন।
শেখ মুজিবুর রহমানের মূর্তি নির্মানকে কেন্দ্র করে হেফাজতে ইসলাম ও আওয়ামী লীগ যখন মুখোমুখি অবস্থানে তখনই আল্লামা আহমদ শফিকে হত্যার কাল্পনিক অভিযোগ এনে মামলাটি দায়ের করা হয়।
এই মামলার প্রতিবাদে বুধবার (২৩ ডিসেম্বর) অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, হাটহাজারী মাদরাসা তৎকালীন শিক্ষা পরিচালক মাওলানা নুর আহমদকে পাশ কাটিয়ে শাহ আহমদ শফীর ছেলে আনাস মাদানী মাদরাসা পরিচালনায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনৈতিকভাবে কর্তৃত্ব করতেন। আনাস মাদানী অনেক ছাত্রকে জোরপূর্বক ছাত্রাবাস ত্যাগে বাধ্য করেন। অনেক ছাত্রকে নির্যাতন করেন। অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে গত ১৬ সেপ্টেম্বর ভুক্তভোগী ছাত্ররা মাদরাসায় বিক্ষোভ করেন এবং আনাস মাদানীকে মাদ্রাসা থেকে বহিস্কারের দাবি করেন।
এর প্রেক্ষিতে তৎকালীন পরিচালক আহমদ শফী মাদরাসার শুরা কমিটির (মাদ্রাসা পরিচালানা কমিটি) বৈঠক ডাকেন। শুরা কমিটির বৈঠকে আনাস মাদানীকে মাদ্রাসা থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয়। এরপর মাদরাসায় শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ফিরে আসে।
সংবাদ সম্মেলনে আল্লামা আহমদ শফীকে হত্যার অভিযোগে দায়ের মামলা প্রসঙ্গে বলা হয়, এটি হাটহাজারী মাদরাসার শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বিনষ্ট করা এবং হেফাজত ইসলামের নেতাদের হয়রানি করার হীন চক্রান্ত ছাড়া আর কিছু নয়। অবিলম্বে মামলাটি প্রত্যাহারের দাবি করা হয়। না হলে দেশের ওলামায়ে কেরামের সঙ্গে আলাপ করে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে হেফাজত ইসলামের আমির জুনায়েদ বাবুনগরী বলেন, ‘নির্যাতনের শিকার হয়ে মৃত্যুর অভিযোগ এনে যে মামলা করা হয়েছে তা ভিত্তিহীন। রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারের জন্য ও মন্ত্রীর কাছ থেকে ফায়দা লুটতে মামলাটি করেছে।’ তিনি আরো বলেন, মামলাটি যারা দায়ের করেছেন তারা সুবিধাভোগী দালাল।
এ সময় সেই ‘দালালরা’ কারা, সাংবাদিকরা জানতে চাইলে বাবুনগরী বলেন, ‘সবাই তাদের জানেন, নাম বলার দরকার নেই। সরকার বা মন্ত্রী-এমপি’র থেকে সুযোগ-সুবিধা নিয়ে ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধার করার জন্য এ মামলা করেছে। হুজুর (আল্লামা শফি) অসুস্থ থাকার সময়ও উনাকে পুঁজি করে অনেক ফায়দা লুটেছে। ছাত্র-শিক্ষকদের হয়রানি করেছে। হুজুরের স্বাক্ষরিত একজন শিক্ষার্থীর ভর্তির আবেদন চিঠি ছিঁড়ে ফেলেছিলেন আনাস মাদানী। হুজুরকে বুড়া সম্মোধন করে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেছিলেন সে (আনাস মাদানী)। আমাদের শ্রদ্ধার, উনাকে বুড়া বলা আমাদের জন্য বেদনাদায়ক।’
আল্লামা শফীকে চিকিৎসায় বাধা দেয়া হয়নি দাবি করে বাবুনগরী বলেন, ‘হুজুর অসুস্থ হওয়ার পর তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় সিনিয়র শুরা সদস্যরা সবাই উপস্থিত ছিলেন। তাদের সামনে তাকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। আমরা সবাই হুজুরের (আল্লামা শফী) আশেক, প্রেমিক। উনার ওপর নির্যাতন করার প্রশ্নই আসে না। যে অভিযোগ করছে তা বানোয়াট, মিথ্যা ও ভিত্তিহীন।’
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন হেফাজতের প্রধান উপদেষ্টা আল্লামা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী, প্রচার সম্পাদক নোমান ফয়জী, যুগ্ম-মহাসচিব কেন্দ্রীয় নেতা মাওলানা নাছির উদ্দীন মুনীর, সহকারী মহাসচিব মাওলানা মীর ইদরিস নদভী, সহকারী যুগ্ম মহাসচিব হাবিব উল্লাহ, সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী প্রমুখ।
আল্লামা আহমদ শফির ইন্তেকালের পর হেফাজতে ইসলাম নূতন করে সংগঠিত হয়। কাউন্সিলের মাধ্যমে নূতন নেতৃত্ব নির্বাচন করা হয় হেফাজতে ইসলামে। এতে ফ্যাসিবাদের দালাল হিসাবে পরিচিত আনাস মাদানীর সমর্থকরা নেতৃত্ব হারান। মূল ধারায় ফিরে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও ধর্মীয় সংস্কৃতি বিরোধী মূর্তি নির্মানের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় হেফাজতে ইসলামের নূতন নেতৃত্ব।