
একথা সবারই জানা যে একটি দেহ সুস্থ ও সবল থাকে যখন তার প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ, হাত, পা, চোখ, কান নিজ নিজ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করে। আর এই অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোর ঠিকভাবে কাজ করা না করা নির্ভর করে মস্তিষ্ক থেকে নির্দেশনার উপর। মস্তিষ্ক থেকে সঠিক নির্দেশনা পেলেই শুধুমাত্র অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গুলো নির্ভুলভাবে কাজ করতে পারে । মস্তিষ্ক যদি ঠিক না থাকে তাহলে দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারেনা এবং শরীর অসুস্থ হয়ে পড়ে। মানুষের দেহেরে মতই রাষ্ট্র বা সমাজের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য । একটি রাষ্ট্রকেও তখনই সুস্থ ও সচল বলা যায় যখন তার অঙ্গগুলো অর্থাৎ প্রতিটি প্রতিষ্ঠান ঠিকমতো তাদের দায়িত্ব পালন করে। তাদের এই দায়িত্ব কি নৈতিক মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করে জনগণের স্বার্থে রক্ষা করবে নাকি অনৈতিকভাবে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থ রক্ষা করবে তা নির্ভর করে রাষ্ট্রের মস্তিষ্ক বা সরকারের উপর ।
মানুষের মস্তিষ্কের মত সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে তার অঙ্গ প্রত্যঙ্গ কে সঠিক দিক-নির্দেশনা দেয়া। সরকারের আরও দায়িত্ব হচ্ছে এই নির্দেশনা বাস্তবায়নে ব্যর্থ প্রতিষ্ঠানের কাছে কৈফিয়ৎ তলব করা। আবার যথাযথ নির্দেশনা দিতে সরকার ব্যর্থ হলে অথবা অনৈতিক নির্দেশনা দিলে অথবা নির্দেশনা বাস্তবায়নে কোন প্রতিষ্ঠান ব্যর্থ হলে বিরোধী দলের দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায় সরকারকে জবাবদিহিতার মুখোমুখি করা। বিরোধীদল যদি দুর্বল হয় অথবা সরকারকে জবাবদিহিতার মুখোমুখি করতে ব্যর্থ হয় তাহলে এগিয়ে আসে বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক ও সুশীল সমাজ। বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক ও সুশীল সমাজ মূলত জনগণেরই প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে। তাদের মূল দায়িত্ব হচ্ছে সরকারকে জবাবদিহিতার মুখোমুখি করা, যেন তারা দেশ ও জনগণের স্বার্থের বাইরে কোন কাজ করতে না পারে। এভাবে সমগ্র রাষ্ট্র দায়িত্বশীলতা এবং জবাবদিহিতার একটি বলয়ের উপর ভারসাম্য বজায় রেখে দাঁড়িয়ে থাকে এবং উত্তরোত্তর সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে থাকে ।
নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশ গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যমে এই দায়িত্বশীলতা ও জবাবদিহিতার বলয়কে আরও শক্তিশালী করার লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছিল। দুহাজার সালের পর পর্যন্তও এই ধারা অব্যাহত ছিল। একটি কার্যকর সংসদ ছিল। সেই সংসদে তুমুল বিতর্কের মাধ্যমে জনগণের স্বার্থে জ্বালানি তেলের দাম কমিয়ে আনার মত অসংখ্য কার্যকর ঘটনা ঘটতে দেখা যেত। দুহাজার পাঁচ সালের দিকেও সাংবাদিকরা তাদের দায়িত্ব অনুসারে প্রধানমন্ত্রীকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে জবাবদিহিতার মুখোমুখি করতে পেরেছিল যা এখন অনেকের কাছে রূপকথা বলে মনে হতে পারে। এই গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা হোঁচট খায় দুহাজার ছয় সালে এসে। এরপর থেকে শুরু হয় ঘৃণা ও বিভক্তির রাজনীতি । এই বিভক্তির রাজনীতি আজ এমন এক পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যে প্রতিটি প্রতিষ্ঠান, প্রতিটি মানুষ তার দায়িত্ব ভুলে একটি দল বা গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষাকেই তাদের কর্তব্য বলে মনে করছে ।
বর্তমানে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে যথাযথ দায়িত্ব পালনের দিক-নির্দেশনা দেওয়ার নৈতিক অবস্থানও এই অবৈধ সরকারের আর নেই। তাই তারা ক্ষমতায় টিকে থাকতে একের পর এক ইস্যু সৃষ্টি করে বিদ্বেষ ও বিভক্তি জিইয়ে রাখার চেষ্টা করছে। দেশজুড়ে মানুষ আজ বিভক্ত। কখনো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে, কখনো নাস্তিক-আস্তিক নিয়ে, কখনো বা মূর্তি-ভাস্কর্য নিয়ে। ইতিহাসের কোন বিষয় নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করে জনগণকে বিভক্ত করা চরমপন্থি অপরাজনীতির চরিত্র। ভারতের চরমপন্থি দল বিজেপি ছয়শ বছরের পুরনো রাম মন্দির-বাবরি মসজিদ বিতর্ক টেনে এনে রাজনীতিতে সফলতা পেয়েছে। তাদের এই সফলতায় হয়তো বাংলাদেশে আওয়ামী লীগকে পঞ্চাশ বছরের পুরনো যুদ্ধাপরাধী বিচার ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ শক্তির বিতর্ক টেনে আনতে উৎসাহিত করেছে। নাস্তিক-আস্তিক তো বাংলাদেশি সবসময়ই ছিল। তবে তর্কটা নতুন। আর বিভক্তিটা যে কোন সময়ের চেয়ে এখন প্রকট । তাছাড়া ভাস্কর্য বা মূর্তিও বাংলাদেশে নতুন নয়। এর আগে কখনও এনিয়ে তর্ক-বিতর্ক শোনা যায় নি। এটি তো আওয়ামী লীগের অজানা নয় যে ভাস্কর্যের নামে দেশজুড়ে কারও মূর্তি স্থাপন করলে ধর্মপ্রাণ মানুষের মনে আঘাত লাগবে। তারা প্রতীবাদ করবে। তাহলে কেন তারা এই মহামারীর সময় মূর্তি নিয়ে মেতে উঠলো? এই তর্কগুলো মূল্যবোধের নয় বরং এই তর্ক গুলোর পিছনে রয়েছে বিভক্তি সৃষ্টির উদ্দেশ্য।
আর এদিকে রাষ্ট্রের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো তাদের দায়িত্বশীলতা ছেড়ে বিরোধী দলগুলোকে কাবু করার কাজে ব্যস্ত। বিরোধীদল তাই এখন অক্ষম হয়ে বসে আছে। দায়িত্ব পালনের সামর্থ্য তাদের নেই। সাধারণ মানুষেরা অনেকটাই অসহায়। মানুষের স্বাধীনতা রাষ্ট্র-যন্ত্রের নিয়ন্ত্রণে অথবা দুর্নীতিবাজদের ইচ্ছের হাতে বন্দী। দেশের বেশীরভাগ মানুষের ভাগ্য আজ তাদের নিজেদের হাতে নয়। বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক ও সুশীল সমাজ তাদের দায়িত্ব ছেড়ে, সরকারকে জবাবদিহিতার মুখোমুখি না করে বরং তাদের অবৈধ কাজগুলোকে স্বীকৃতি দেবার চেষ্টা করছে। এটি শুধুমাত্র দায়িত্বহীনতা নয়, একটি নৈতিক অধঃপতন। দায়িত্বশীলতা ও জবাবদিহিতার বলয় পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়েছে এবং রাষ্ট্রের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেছে। অবস্থাটা এমন যে সারা অঙ্গে ব্যথা ঔষধ দিব কোথা ?
তবে তাদের রাজনীতি যে কতটা ভুল এবং এর পরিণতি জাতীর জন্য এবং তাদের নিজেদের জন্যেও যে কতটা কঠিন, দেরিতে হলেও সেই বোধহয় তাদের আসবে। ভাল-মন্দ মিলিয়ে তারাও মানুষ। তাদেরকেও বুঝতে হবে রাজনীতিতে মূল্যবোধের স্থান কতটা গুরুত্বপূর্ণ। ঘটনার বিকৃতি, অন্যকে উপহাস, চরিত্র হনন এগুলো আত্মঘাতী অপরাজনীতি ছাড়া কিছুই নয়। যে সমস্ত বুদ্ধিজীবীরা এধরণের অপকর্ম অনুমোদন করে চলছে তাদেরও বিবেক একসময় কথা বলবে। কারণ তারাও চায় তাদের সন্তানদের জন্য একটি সুন্দর পরিবেশ, একটি সুন্দর দেশ। তাদেরকে অবশ্যই বুঝতে হবে, যে ঘৃণা ও বিদ্বেষের বিষ তারা এই সমাজে ঢেলেছে সেই একই সমাজ থেকে তারা এবং তাদের সন্তানদেরকে পানি পান করতে হবে। বিষাক্ত পানি কারও জন্যেই স্বাস্থ্যকর নয় ।
আজকের এই দায়িত্বহীনতার পিছনে জবাবদিহিতার অভাব তো রয়েছেই আরও রয়েছে মূল্যবোধের অভাব। যেভাবে ধর্ম-বিদ্বেষ কে উস্কে দেওয়া হচ্ছে, ধর্মীয় মূল্যবোধকে যেভাবে স্বাধীনতার চেতনা বিরোধী হিসেবে দাঁড় করানো হচ্ছে, দেশের ঐতিহ্য, প্রথা ও রীতিনীতিকে মুছে ফেলার যে নিরন্তর প্রচেষ্টা চলছে এবং অপরদিকে যেভাবে মানব পাচারকারী, খুনি, মাদক ব্যবসায়ী ও দুর্নীতিবাজদেরকে সংসদে স্থান দেওয়া হচ্ছে – তারপরও আমাদের মূল্যবোধগুলো টিকে থাকবে ভাবাটা ভুল। ধর্ম, নৈতিকতা, সততা, সুবিচার, ন্যায্যতা, ভদ্রতা, দয়া ও ধৈর্যের মত গুনগুলো বাদ দিলে দায়িত্ববোধ বা দেশের জন্য আত্মত্যাগের চেতনা এমনকি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাও আর টিকে থাকেনা। দেশপ্রেম, চেতনা এগুলো তখন রাজনৈতিক বুলিতে পরিণত হয় এবং কোনটি সৎ চিন্তা আর কোনটি রাজনৈতিক শঠতা তা পার্থক্য করা মানুষের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে।
তবে প্রকৃতির একটি নিয়ম আছে, কোন কিছু ভারসাম্য অবস্থান থেকে বিচ্যুত হলে পুনরায় তা ভারসাম্যে ফিরে আসে। কিন্তু এই ফিরে আসাটা অলৌকিক ভাবে হয় না বিভিন্ন শক্তির প্রভাবেই তা আবার ফিরে আসে অথবা নতুন একটি ভারসাম্য অবস্থান তৈরি করে নেয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে, সকল মানুষের বোধের পরিবর্তনই হবে সেই শক্তি যা আবার দেশকে দায়িত্বশীলতা – জবাবদিহিতার বলয়ের ভারসাম্যে নিয়ে আসবে। তবে একটি চিরন্তন সত্য এখানে মনে রাখা প্রয়োজন, আর তা হচ্ছে, কোন লৌহ খণ্ডকে আগুনে গরম করে হাতুড়ির ঘা না মারলে তার আকার পরিবর্তিত হয় না। তেমনিভাবে কোন গণঅভ্যুত্থান বা গণজোয়ার ছাড়া অলৌকিক ভাবে ক্ষমতালোভীদের বোধোদয় হবে সে চিন্তা করাটাও অবাস্তব কল্পনা বা দিবাস্বপ্ন।
[লেখক: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও গবেষক]