- ইকতেদার আহমেদ
- ০৭ ডিসেম্বর ২০২০
সর্বশেষ ধর্মগ্রন্থ পবিত্র কুরআন শরিফে মানুষকে জীবকুলের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে অভিহিত করা হয়েছে। অন্যান্য ধর্ম মতেও জীবকুলের মধ্যে মানুষ সর্বশ্রেষ্ঠ। আধুনিক সমাজবিজ্ঞান ধর্মগ্রন্থ ও ধর্মমতগুলোর সাথে দ্বিমত পোষণ করে না।
মানুষ সর্বশ্রেষ্ঠ জীব হওয়ায় মানুষের প্রতি মানুষের আচরণ হতে হবে ভদ্র, নম্র, শোভন, মার্জিত, অমায়িক, শিষ্ট, সংযত, কোমল ও বিনত। অন্যান্য জীবের প্রতি মানুষকে হতে হবে দয়ালু। মানুষের মধ্যে উপরোক্ত গুণাবলির উপস্থিতি পরিপূর্ণ ও আদর্শ মানুষের পরিচায়ক। আমাদের বর্তমান সঙ্ঘাতপূর্ণ সমাজে আমরা আমাদের নিজকেই প্রশ্ন করতে পারি, আমরা মানুষ হিসেবে কতটুকু পরিপূর্ণ ও আদর্শ।
দর্শন শাস্ত্র ও যুক্তিবিদ্যার ভাষ্য মতে, মানুষ অন্যান্য জীবের মতো জীবনসমৃদ্ধ প্রাণী হওয়ায় জীবের মতো প্রাণিত্ব মানুষের একটি অন্তর্নিহিত গুণ কিন্তু যে গুণটি মানুষকে অন্যান্য প্রাণী বা জীব থেকে পৃথক করেছে সেটি হচ্ছে মানুষের বিচারশক্তি।
ইতরের বিপরীত শব্দ ভদ্র আর অসভ্যের বিপরীত শব্দ সভ্য। অসভ্য ইতরের পরিপূরক। আমাদের সমাজে যে সব ব্যক্তি হীন, নীচ, নোংরা, অশালীন, অশিষ্ট, অশ্লীল, অসভ্য, অভদ্র, বর্বর, ছোটলোক, সৌজন্যহীন, বেয়াদব, বেয়াড়া, বাঁদর, অসদাচারী, দুর্ব্যবহারকারী, বেলেহাজ, বেতমিজ, অমার্জিত, বজ্জাত, কুৎসিত, জঘন্য, কটুভাষী তাদের ইতর বা অসভ্য হিসেবে অভিহিত করা হয়।
সমাজে বসবাসকারী প্রতিটি শ্রেণী পেশার মানুষের নির্ধারিত যে দায়িত্ব রয়েছে তা সঠিকভাবে প্রতিপালনের মধ্যেই পাওয়া যাবে মানুষ হিসেবে জন্মের সার্থকতা। বিশ্বাসীদের মতে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক সফলতা পেতে হলে ধর্মীয় অনুশাসন প্রতিপালনসহ একজন মানুষকে হতে হবে ভদ্র ও সভ্য। ধর্মীয় অনুশাসনের সাথে নীতি নৈতিকতা কখনো সঙ্ঘাতপূর্ণ নয়। তাই ধর্মীয় অনুশাসন ও নীতি নৈতিকতার প্রতি একনিষ্ঠ ও একাগ্র ব্যক্তির ইতর অসভ্যের আবরণে অমানুষ হওয়ার সুযোগ নেই।
অনেকের মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক যে, অমানুষ কে? ধর্মতত্ত্ববিদ ও নীতিশাস্ত্রবিদদের মতে, ইতর অসভ্য অবশ্যই অমানুষ। বাংলা ‘মানুষ’ শব্দটিকে এ দেশীয় দার্শনিক ও ভাষাবিদরা এভাবে বিশ্লেষণ করেছেন যে ‘মান’ ও ‘হুঁশ’ সমৃদ্ধ ব্যক্তি হচ্ছে মানুষ। অর্থাৎ যে ব্যক্তি নিজ ও অন্যের মান বা মর্যাদা বিষয়ে সমভাবে সচেতন এবং একই সাথে সংবেদনশীল বা অনুভূতিপ্রবণ তিনিই হচ্ছেন মানুষ।
সততা ও ন্যায়পরায়ণতা একজন মানুষের স্বাভাবিক গুণাবলি; অপর দিকে অসততা ও অন্যায় একজন মানুষের অস্বাভাবিক গুণ। সততার বিপরীত হচ্ছে অসততা আর ন্যায়ের বিপরীত হচ্ছে অন্যায়। অসৎ ও অন্যায় কাজ সমাজের যেকোনো শ্রেণীর মানুষের জন্য পরিত্যাজ্য। যেকোনো সমাজ ও দেশের উচিত সৎ ও ন্যায়নিষ্ঠদের প্রতিপালন এবং অসৎ ও অন্যায়কারীদের প্রতিবিধান। এ নিয়মটি মেনে চললে যেকোনো সমাজ ও দেশে অসততা ও অন্যায়ের ওপর সততা ও ন্যায়ের আধিপত্য অক্ষুণ্ন থাকবে।
দেশে ও সমাজে বসবাসকারী পদধারী ও অপদধারী নির্বিশেষে সবার কর্মপরিধির সীমাবদ্ধতা রয়েছে। উভয়কে এ সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকে আইন, বিধি-বিধান, নীতি-নৈতিকতা মেনে চলে কর্ম সম্পাদন করতে হয়। কিন্তু সঠিকভাবে কর্ম সম্পাদনের ব্যাপারে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে আমরা সবাই কি সচেষ্ট? সচেষ্ট নই বলেই তো দেশ ও সমাজে এ অস্থিরতা। আর এ কারণেই দেশ ও সমাজের অগ্রযাত্রা থমকে আছে।
মানুষের মৃত্যু পরবর্তী যে পুনরুত্থান হবে সে পুনরুত্থান পর্বে এককভাবে শেষ বিচারের মালিক আল্লাহ পাক বিচারকার্য সম্পন্ন করবেন। সে বিচার হবে নিখুঁত এবং সবার প্রতি সম্ভাব্য যতটুকু দয়া প্রদর্শন সম্ভব সে দয়া থেকে কাউকে বঞ্চিত করা হবে না। এ পৃথিবীতে যারা বিচারকার্য পরিচালনার কাজে নিয়োজিত তাদের বলা হয় পৃথিবীর বুকে শেষ বিচারের মালিকের প্রতিনিধি। আমাদের ইসলাম ধর্মসহ একত্ববাদে বিশ্বাসী সব ধর্ম মতে পৃথিবীর বুকে বিচারকার্য পরিচালনারত বিচারকদের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বারবার সতর্ক করা হয়েছে।
একজন বিচারকের বিচারক হিসেবে পরিচয়ের বাইরে যে পরিচয় তা হলো তিনি একজন মানুষ। মানুষ হিসেবে অন্যান্য মানুষের মত তার কাছ থেকে সবাই শালীন, ভদ্র, মার্জিত, সদাচরণ, সদ্ব্যবহার ও বিনয় প্রত্যাশী। একজন বিচারকের আচরণে যখন পক্ষপাতমূলকভাবে আইন বিধি-বিধান ও নীতি-নৈতিকতার ব্যত্যয়ে হীনতা, নীচতা, নোংরামি, অশালীনতা, অশিষ্টতা, অশ্লীলতা, অসভ্যতা, অভদ্রতা, বর্বরতা, ছোটলোকমি, বেয়াদবি, বেয়াড়াপনা, বেলেল্লাপনা, বাঁদরামি, অসৌজন্য, অসদ্ব্যবহার, অসদাচরণ, দুর্ব্যবহার, বজ্জাতি, কদাচরণ পরিলক্ষিত হয় তখন সে আচরণকে ইতরতা বা অসভ্যতার বাইরে অপর কোনো আচরণ হিসেবে গণ্য করার সুযোগ আছে কি? আর যদি সুযোগ না থেকে থাকে তবে তিনি কি মানুষ না অমানুষ সেটি তার কার্যকলাপ বিবেচনায় তিনি নিজেই অপর কারোর চেয়ে ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারবেন।
একজন অপরাধীকে বিচার শেষে সাজা বা দণ্ড প্রদান ধর্মীয় এবং রাষ্ট্রীয় আইন দ্বারা স্বীকৃত কিন্তু একজন নিরপরাধ ব্যক্তিকে ক্ষমতার অপপ্রয়োগে অপমানিত বা লাঞ্ছিত করা ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় আইন দ্বারা স্বীকৃত নয়।
বিচারকের পদসহ যে কোনো পদে যোগ্য, দক্ষ ও উপযুক্ত ব্যক্তিকে পদায়ন করা বা নিয়োগ দেয়া হলে ক্ষমতার প্রয়োগ আইনানুগ ও নিরাপদ হয়ে থাকে কিন্তু অযোগ্য, অদক্ষ ও অনুপযুক্ত ব্যক্তিকে পদায়ন করা বা নিয়োগ দেয়া হলে ক্ষমতার আইনানুগ ও নিরাপদ প্রয়োগ বাস্তবে প্রতিফলিত হতে দেখা যায় না।
একজন জ্ঞানী ও বিদ্যান ব্যক্তিকে বিচারিক পদসহ যেকোনো উচ্চপদে পদায়ন করা বা নিয়োগ দেয়া হলে সে সবসময় শঙ্কিত থাকে না জানি অনুধাবনের অপরিপক্বতায় বিচার বিভ্রাটে নিরীহ ব্যক্তি হয়রানির শিকার হয় কিন্তু একজন অজ্ঞ বা মূর্খের সে অনুধাবন শক্তি কি আছে?
প্রাচীন বাংলায় একটি প্রবাদ আছে, ফলভারে গাছ নত হয়ে যায়। এর অর্থ গাছের অহঙ্কার বা গর্ব হলো তার ফল এবং এ অহঙ্কার বা গর্বে গাছ উদ্ধত না হয়ে ডাল নত করে বিনয় প্রকাশ করে। অনুরূপ মানুষের ক্ষেত্রেও প্রকৃত জ্ঞানী ও বিদ্বানকে ক্ষমতা দেয়া হলে তিনি এ ক্ষমতার উপযুক্ত কি না এ কথা ভেবে বিনত থাকে। আর অজ্ঞ বা মূর্খকে যখন এ ক্ষমতা দেয়া হয় তখন উল্টোটিই পরিলক্ষিত হয়।
এ পৃথিবীসহ বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সব সম্পদ ও ক্ষমতার মালিক আল্লাহ রাব্বুল আলামিন। এ পৃথিবীতে মানুষের অবস্থান ক্ষণস্থায়ী। মানুষ পৃথিবীতে অবস্থানকালীন যে সম্পদ ও ক্ষমতা ভোগ করে তাও ক্ষণস্থায়ী। তাই প্রকৃত জ্ঞানী ও বুদ্ধিমানরা সম্পদ ও ক্ষমতার মোহে অন্ধ না হয়ে নতজানু থাকে। আর এ ক্ষেত্রে অজ্ঞ মূর্খ যে উদ্ধত হবে তা কি বুঝবার বাকি আছে।
বিচারক ছাড়া অন্যান্য সাংবিধানিক পদধারীসহ সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা সবাই নিজ নিজ কার্য সম্পাদনে নিজ নিজ ক্ষেত্রে বিচারক। তাদের সবার কাছ থেকেও বিচারকদের অনুরূপ দেশবাসী শালীন, ভদ্র, মার্জিত, সদাচরণ, সদ্ব্যবহার ও বিনয় প্রত্যাশী।
একজন বিচারক তার নিরপেক্ষ অবস্থানের কারণে সুদূর অতীত থেকে সমাজে ও দেশে সবার কাছে সম্মানিত ছিলেন। সব বিচারক কি বর্তমানে সমভাবে সম্মানিত? সুদূর অতীতে বিচারকের সততাই ছিল বিচারকের নিরাপত্তা। তাই ফাঁসির আদেশ দিয়ে বা বহাল রেখে বিচারক নির্বিঘ্নে হেঁটে বাসায় চলে যেতেন। একবারও তো তার ভাবনায় আসেনি যে দণ্ডিত ব্যক্তির পক্ষের লোক দ্বারা তিনি নাজেহাল হবেন বা আক্রান্ত হবেন।
অতীতে কখনো কেউ কি কোনো বিচারককে তথাকথিত অভিজাত ক্লাবে উন্মুক্ত পরিবেশে মদ্যপান করতে দেখেছেন? না দেখে থাকলে এখন দেখার অবকাশ সৃষ্টির পেছনে এরা কারা? এরূপ মদ্যপান পদের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কি না তা-ও ভেবে দেখার বিষয়।
দু-একজন বিচারকের পদের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ আচরণের দায় তো পুরো বিচারক সমাজ নিতে পারে না। তাই বিচারক সমাজের সম্মিলিত প্রয়াস হোক এমন দু-একজনকে নিজ সমাজ থেকে বিতাড়িত করে বিচারক সমাজকে নিষ্কলুষ রাখা। আর এ নিষ্কলুষ রাখার মধ্যে নিহিত আছে ব্যক্তি বিচারকের মানুষ হিসেবে ভদ্র ও সভ্য গণ্যে সমাজে সম্মানজনক ও নিরপেক্ষ অবস্থান। পরিশেষে যখন শিরোনামের উত্তর খোঁজার পালা তখন আলোচনার গভীরতার আলোকে বলতেই হয়, ইতর অসভ্য মানুষের অবয়বধারী হলেও তাকে তো আর মানুষ বলা যায় না।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
E-mail: [email protected]