বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের অন্যতম রক্ষাকবচ নিজস্ব সংস্কৃতি আর ধর্মীয় আত্মপরিচয়। আধিপত্যবাদ চাণক্য কূটচালে বিশ্বের বুকে অনন্য এক সমজাতীয় বাংলাদেশকে রক্তের বিভাজনে বিভক্ত করার প্রয়াস চলছে। শুধুমাত্র ক্ষমতার অন্ধ মোহে এবং সাময়িক হালুয়া রুটির স্বার্থে রাজনীতিবিদ এবং তথাকথিত সুশীলরা এই বিভাজনে ঘি ঢালেন। মানবাধিকার হরণকে জায়েয করে ক্ষমতার স্থায়িত্ব বাড়াতে অতি সুকৌশলে নানা সময়ে ধর্মের প্রতি সহানুভূতিশীল অধিকার বঞ্চিত মানুষদের ভিন্ন এক পরিচয়ে পরিচিতি বা ট্যাগ দেয়ার হীন চেষ্টা চলে ।
সমাজটা হাজার বছরের কিন্তু রাজনীতি খুব কম সময়ের। আজ সবাই রাজনীতি করতে চায় কিন্তু সমাজটাকে বাদ দিয়ে। রাজনীতি দিয়ে সমাজকে নিয়ন্ত্রণ নয় বরং সমাজ দ্বারা রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হওয়া উচৎ। ঐতিহাসিক বাস্তবতা হলো, ধর্মীয় সম্প্রীতি ও সহাবস্থান, আলেম ওলামা আর ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাংলাদেশে এখনো যতটুকু সামাজিক শান্তি ও নিরাপত্তা বিদ্যমান, তা আধুনিক রাষ্ট্রের টেকসই মজবুত নীতি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত বিকাশের কারণ নয় বরং তা ধর্মপ্রাণ মানুষের সরব উপস্থিতির ফল । ব্যক্তি বিশেষের ভুলকে ধর্মীয় বার্তা মনে করার কোন কারণ নাই। মহান মুক্তিযুদ্ধকে পবিত্র ইসলাম ধর্মের মুখোমুখি দাঁড় করানো কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর এজেন্ডা বাস্তবায়নের নামান্তর। ‘ঘাড় মটকানোর’ দাম্ভিকতা রাজনীতিহীন বাংলাদশে জবাবদীহিতাহীনতাকে উস্কে দেয়, মানবিকতাকে করে ভুলন্ঠিত । তাই সংশ্লিষ্ট সকল মহলের দাম্ভিকতা এবং উস্কানিমূলক আচরণে সংযমী হওয়া বাঞ্চনীয়।
১৮ কোটি মানুষের সম্ভাবনাময় একটি দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে কাজ করার বাধ্যবাধকতা থাকলেও বাস্তবে চলছে তার উল্টো । করোনাকালীন সময়েও রাষ্ট্রীয় লুটপাট আর অরাজকতার বীভৎসতা এতটুকু চিড় ধরেনি। লুটপাটের সুযোগ দিতে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের টাকায় বিতর্কিত কর্মকান্ড পরিচালনায় চলছে হরিলুট। জনমানুষের ভাগ্য উন্নয়নে মুক্তিযুদ্বের অঙ্গীকার সাম্য, মানবিক মর্যাদা আর ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় জবাদিহিতামূলক শাসনের বিকল্প নাই। কর্তৃত্ববাদী জবাদিহিতাবিহীন শাসন ব্যবস্থা আখেরে ফ্রাঙ্কেস্টাইন সৃষ্টি করে। যার পরিণতি সুখকর হয় না। ইতিহাস স্বাক্ষী সময়ের ব্যবধানে এরা আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয় ।
ভূ-রাজনীতির দাবার ঘুটি হয়ে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর মাধ্যমে দেশের মানুষকে দমিয়ে রাখতে পারলেও সুযোগ পেলেই জনগণের ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটতে বাধ্য। তথ্য প্রযুক্তির বিশ্বায়নে স্থায়ীভাবে কোনো অঞ্চলের মানুষকে শৃখলিত করে রাখার সুযোগ নাই। সভ্য দুনিয়াতে অগ্রসর সমাজে মানুষ শুধু অন্ন আর বস্ত্র নয়, চায় চিন্তার স্বাধীনতা, চায় প্রাণ খুলে কথা বলার স্বাধীনতা। তাই ব্যক্তিকেন্দ্রিক চাটুকারিতার শিল্পে নয়, অর্থবহ জাতীয় স্বাধীনতার জন্য প্রয়োজন সময়কে ধারণ করে মেধা, সততা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে আধুনিক প্রতিশ্রুতিশীল রাষ্ট্র ও প্রাতিষ্ঠানিক সমাজ ব্যবস্থা। সময় ও সুযোগে চুপিসারে ক্ষমতার পালাবদলের সুবিধাভোগী হয়তো হলেও হওয়া যায়। তবে দেশপ্রেমিক দক্ষ কর্মীবাহিনীর মাধ্যমে সঠিক রূপরেখা বাস্তবায়নে জনগণকে আস্থায় নিতে না পারলে অরক্ষিত ক্ষমতা নিজস্ব ভোগ বিলাসে সাময়িক ব্যবহার করা গেলেও জাতির ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য সহায়ক নয় বরং জনগণকে ভুল বার্তা দেয় ।
একটি স্বৈরশাসক যা কিছু তা করতে পারে। তবে সময়ের ব্যবধানে একটি ভুলই তাদের পতনের জন্য যথেষ্ট। প্রশ্ন হলো, বিড়ালের গলায় ঘন্টাটা বাঁধবে কে? মন্দের ভালো অথবা ক্ষমতার পালাবদল আর ‘ট্রায়াল এন্ড এরর’র জগাখিচুড়ি ফন্দির কূটকৌশল দিয়ে কালক্ষেপন কাম্য হতে পারে না। আধুনিক দুনিয়াতে অগ্রসর রাষ্ট্র ও সমাজে বিদ্যমান পরীক্ষিত ও প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতিসমূহ বাস্তবায়নে চাই জনআকাঙ্খাকে ধারণ করে পরিষ্কার রূপরেখা ও দক্ষ ব্যবস্থাপনা। তোষণের প্রতিযোগিতায় না নেমে মেধাকে ধারণ করে সৎ ও দক্ষ কর্মী বাহিনী গঠনের মাধ্যমে মর্যাদাবান জাতি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার জনগণের আস্থা বাড়াতে সাহায্য করে। রাজনীতির ময়দানে জাতীয় এবং স্পর্শকাতর ইস্যূতে নীরবতা নয় বরং বুদ্বিদীপ্ত বলিষ্ঠ পদক্ষেপ রাজনীতির প্রাজ্ঞতা পরিচায়কে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। জনআকাঙ্খাকে বাস্তবে রূপ দিতে শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা আরোহণ রাজনীতির একটি অন্যতম দিক বটে তবে এটাই মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়। দলীয় পরিশীলিত রাজনীতি আর গণমূখী কর্মসূচির মাধ্যমে জনগণকে ঐক্যবদ্ব রাখাও রাজনীতির বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। এছাড়া রাজনীতিতে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করা ব্যাতিত স্বকীয়তা বজায় রেখে ক্ষমতা ধরে রাখাও দুঃসাধ্য । তাই কারো মুখাপেক্ষী নয় বরং নিজেদের আদর্শিক শক্তিতে বলীয়ান আর দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে জনগণকে আস্থায় নিতে পারলে রাজনীতির চাকা ঘুরানো সময়ের ব্যাপার মাত্র। অন্যথায় ফ্যাসিবাদী শাসনের দীর্ঘায়ূতে বিরোধী পক্ষের ভূমিকাও ইতিহাসে লিপিবদ্ধ রয়ে যাবে।
প্রয়াত কথা সাহিত্যিক, গণমানুষের আত্মার আত্মীয় আহমদ ছফা সেই ১৯৭২ সালে লিখেছিলেন, আমরা এমন এক সময়ে বাস করছি যখন রক্ত দিয়ে চিন্তা করতে হয়। আজ আহমদ ছফা বেঁচে থাকলে নিশ্চয় লিখতেন, আমরা এমন এক সময়ে বাস করছি যখন আরো রক্ত দিয়ে চিন্তা করতে হবে। ভারত থেকে ফিরে এসে স্বাধীনোত্তর বাংলাদেশে প্রবেশ করে প্রয়াত আহমদ ছফা আরো বলেছিলেন, ১৯৭১ সালে রক্ত দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ বুঝতে পেরেছে জাতীয় স্বাধীনতা দরকার। আর জাতীয় স্বাধীনতাকে অর্থবহ করার জন্য প্রয়োজন আরেকটি মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে এসেও তার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যায় নি, বরং আরো প্রকট হয়েছে। যে প্রতিশ্রুতিতে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল, তার কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে? শুধুমাত্র পতাকা উড়াবার স্বাধীনতা নয়, নয় মানচিত্র আর ভৌগোলিক স্বাধীনতা। শৃঙ্খলমুক্ত সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় চাই অর্থবহ জাতীয় স্বাধীনতা।
লেখক: সংবাদ বিশ্লেষক। সাবেক সহকারী অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় সিলেট।
লন্ডন, ০৩ ডিসেম্বর ২০২০।