- গোলাম মাওলা রনি
- ৩০ জুলাই ২০২০
আমাদের জাতীয় কবি যখন গানটি লিখেছিলেন তখন তিনি কার কথা ভেবেছিলেন তা জানি না। তবে তিনি সেই ক্ষমতাধর লোকজনের ক্ষমতার দাপট এবং দাম্ভিকতা প্রদর্শনকে মোটেও পছন্দ করতেন না, তা বুঝা যায় তার অসংখ্য লেখনীর মাধ্যমে। তিনি যে সময়টাতে তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যকর্ম রচনা করছিলেন, তখন সারা ভারতবর্ষ নানা কারণে ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম কঠিন বাস্তবতার জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে প্রতিটি ভালো কিংবা মন্দ কর্মের নির্যাস উদগীরণ করে চলছিল। প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্ববর্তী ১০ বছর এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরবর্তী ১০ বছরের মধ্যবর্তী সময়টি পুরো ভারতবর্ষের হাজার হাজার বছরের ইতিহাসের মধ্যে প্রধানতম যুগ সন্ধিক্ষণ বলে বিবেচিত। কারণ, এ সময়ে যেমন ভারতবর্ষের অনেক সেরা কর্মবীর, রাজনীতিবিদ, কবি-সাহিত্যিক, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী কিংবা বিজ্ঞানীর জন্ম হয়েছে; ঠিক তেমনি সর্বনিকৃষ্ট বেঈমান, মোনাফেক, ঠগ-বাটপার, চোর, ডাকাত থেকে শুরু করে আন্ডার ওয়ার্ল্ডের ডনদের উৎপত্তি ঘটে।
ইতিহাসের জাঁতাকলে পড়ে আমাদের জাতীয় কবি কখনো বিদ্রোহ করতে দৃষ্টিপাত করেছেন, কখনো ভেবেছেন- তাকে হয়তো নিয়তির কাছেই আত্মসমর্পণ করতে হবে। তিনি এক দিকে যেমন বেঁচে থাকার অদম্য বাসনায় তাড়িত হয়ে প্রেম-ভালোবাসায় সিক্ত হওয়ার চেষ্টা করেছেন, তদ্রূপ হতাশার সাগরে ডুবতে ডুবতে আধ্যাত্মিকতার দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। তিনি কখনোবা মনে করেছেন, কর্ম দিয়ে সব পরিবেশ পরিস্থিতি পাল্টানো সম্ভব- আবার পরক্ষণে ভেবেছেন পরিবেশ পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকলে অনেক শুভকর্মের ফল মন্দ রূপ ধারণ করে। কবির এতসব বহুমুখী চিন্তার ফসলরূপে যেসব কালজয়ী সাহিত্যকর্ম আমরা পেয়েছি, সেগুলোর মধ্যে আলোচ্য গানটি অন্যতম। গানটির ব্যাপারে বিস্তারিত বলার আগে আজকের শিরোনামের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে কিঞ্চিৎ আলোচনা আবশ্যক।
পৃথিবীব্যাপী করোনা সঙ্কট যখন শুরু হলো, তখন আমরা আমাদের চরিত্র ও অভ্যাস অনুযায়ী সতর্ক না হয়ে বরং এমন সব অদ্ভুত কর্মকাণ্ড শুরু করলাম, যাতে করে এ ভয়াবহ মরণব্যাধিটি আমাদের দেশের টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত নির্বিঘ্নে বিস্তার লাভ করতে পারে। আমরা আমাদের নির্বুদ্ধিতা, গোঁয়ারতুর্মি, অসততা, ধান্দাবাজি, টাউটারি, বাটপারি এবং অশিক্ষা-কুশিক্ষা দিয়ে অদ্ভুত এক টনিক বানিয়ে করোনার প্রজনন ঘটাতে থাকলাম, যাতে আমাদের মধ্যে রোগটি এমনভাবে মিশে যেতে পারে যেমন আম ও দুধ ভোজনরসিক বাঙালির খাবার টেবিলে মিশে যায়। আমাদের অব্যাহত চেষ্টার ফলে করোনা আজ জাতীয় চরিত্রের আদি ও আসল নির্যাসগুলো মানুষের ভেতর থেকে বের করে সর্বসাধারণের দর্শনে উন্মুক্ত করে দিয়েছে। ফলে আমরা আমাদের হাতি-ঘোড়া, রাজা-উজির, কোতোয়াল-আমির ওমরাহ, ভণ্ড-সাধু সন্ন্যাসী থেকে শুরু করে নব্যধনী, চামার-চণ্ডাল, মাজার ব্যবসায়ী, ভোগী, যোগী ইত্যাদি সবারই আদি ও আসল রূপ তথা জন্মদিনের পোশাকে দেখতে পাচ্ছি।
চলমান করোনা সঙ্কট এক দিকে যেমন আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে, আমরা যেভাবে নিজেদের বড়সড় রাঘববোয়াল বা রুই-কাতলারূপে সবার সামনে প্রদর্শনে এত দিন যে হম্বিতম্বি করেছি তা ছিল মূলত মরীচিকা কিংবা আলেয়া অর্থাৎ অন্যকে বিভ্রান্ত করতে নকল আলোর ঝলকানি। অন্য দিকে, আমাদের মধ্যে এত দিন যারা নিজেদের দুর্বল অসহায় এবং অন্যের অনুগ্রহভাজন হিসেবে সর্বদা রুই-কাতলা, রাঘববোয়ালদের খাদ্য কিংবা জুলুম অত্যাচারের পণ্যরূপে ভাবতাম তারা বুঝতে পারছি যে, আসলে আমরা অত দুর্বল নই। উপরওয়ালা আমাদের যে শক্ত সামর্থ্য শরীর, কাজ করার উপযুক্ত দু’টি হাত এবং নিজের দেহকে বহন করার সামর্থ্যসম্পন্ন দু’টি পা দিয়েছেন; যা কিনা চলমান সঙ্কটে পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান উপসর্গ হিসেবে প্রমাণিত হচ্ছে। আমাদের কম চাহিদাসম্পন্ন মন, লোভহীন জিহ্বা এবং হালাল খাদ্য গ্রহণকারী উদর করোনার মুসিবতের সময় যেকোনো রাজভাণ্ডারের চেয়ে মূল্যবান। একই সাথে যেকোনো অস্ত্রভাণ্ডার কিংবা ওষুধের ভাণ্ডারের চেয়ে শক্তিশালী ও কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে।
বিবিসিসহ পশ্চিমা গণমাধ্যম শত চিন্তাভাবনা করেও কোনো কূলকিনারা করতে পারছে না বাংলাদেশের করোনার পক্ষপাতমূলক আচার-আচরণ সম্পর্কে। করোনা কোনো পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ নোংরা এবং অস্বাস্থ্যকর বলে বিবেচিত ঢাকার বস্তিগুলোতে ঢুকতে পারেনি। দেশের মেহনতি কুলি-মজুর, ঠেলাওয়ালা, ভ্যানচালক, মাছ বিক্রেতা, সবজি বিক্রেতা, ট্রাক-বাস-লঞ্চের কর্মচারী থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের কিষান-কিষানীর বাড়ির চৌহদ্দিতে ঢুকছে না। তারা নিদারুণ আশাহত হয়ে ভয়তি চোখ মেলে লক্ষ কোটি অবোধ বলে ধিকৃত সৎ-পরিশ্রমী অথচ দরিদ্র এমন সব মানুষের চোখে মুখে তাদের মতো করোনাভীতির ছাপ দেখতে পাচ্ছেন না। লোকজন যেখানে তথাকথিত স্বাস্থ্যবিধিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে জমায়েত হচ্ছেন, হাটবাজার করছেন, মসজিদে যাচ্ছেন, জানাজাতে অংশ নিচ্ছেন এবং মাঝে মধ্যে হাজারে হাজারে কাতারবন্দী হয়ে ঢাল সড়কি লাঠিসোটা ইত্যাদি দেশীয় অস্ত্র নিয়ে মারামারি-দাঙ্গা ফ্যাসাদ করছেন, সেখানে তো করোনার প্রলয় বয়ে যাওয়ার কথা! কিন্তু বাস্তবে ওসব ঘটনায় একটি করোনা রোগীকে কেন চিহ্নিত করা গেল না; তা নিয়ে পশ্চিমা বিশেষজ্ঞরা রীতিমতো বেকুব বনে গেছেন।
করোনাকে পুঁজি করে যারা মহাধান্ধা করার প্রচেষ্টা করছিলেন, তারা রীতিমতো মাঠে মারা যাওয়ার মতো পর্যায়ে পৌঁছে গেছেন। লোকজন হাসপাতালে যাচ্ছেন না। এমনকি পরীক্ষা করার ক্ষেত্রেও তাদের কোনো আগ্রহ নেই। ফলে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের ধান্ধাবাজরা ধান্ধাবাজির যেসব বেসাতি সাজিয়ে বসেছিলেন তা লাটে উঠেছে। আনাফ দেউলিয়া হয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন। কেউ নাটক করতে গিয়ে রীতিমতো ধরা খেয়ে সর্বস্ব খুইয়ে জেলের ঘানি টানছেন। যারা করোনা সঙ্কটে সৃষ্ট অভাব অভিযোগকেন্দ্রিক ত্রাণ দান খয়রাত ইত্যাদির পসরা সাজিয়ে গরিবের হক নষ্টের মাস্টার প্ল্যান করছিলেন তারাও খরিদ্দারের অভাবে বেকায়দায় পড়ে গেছেন। গরিবরা এখন ত্রাণের পেছনে ঘোরাঘুরির পরিবর্তে আল্লাহর দেয়া হাত-পাগুলো কাজে লাগাচ্ছেন। ফলে ত্রাণচোররা ইতিহাসের হৃদয়বিদারক মহামন্দার কবলে পড়ে রীতিমতো হাহাকার শুরু করে দিয়েছেন।
চলমান সঙ্কটে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছেন ক্ষমতাধর লোকেরা। কারণ, তারা এখন তাদের অবৈধ ক্ষমতার দাপট দেখাতে পারছেন না। নব্য ধনী যারা নিজেদের ধনসম্পদ প্রদর্শনে পরস্পরের সাথে পাল্লা দিতেন এবং অহেতুক ভোগবিলাস এবং অপব্যয় করে নিজেদের শরীর স্বাস্থ্য ও মন রোগবালাইয়ের কারখানায় পরিণত করছিলেন, তারা এখন মরণ যন্ত্রণায় ছটফট শুরু করে দিয়েছেন। প্রথমত, তাদের অনেকের ব্যবসাবাণিজ্য বা আয়রোজগার হয় বন্ধ হয়ে গিয়েছে, নতুবা অনেক কমে গিয়েছে। কেউ গত তিন চার মাসের ধাক্কায় রীতিমতো দেউলিয়া হয়ে পড়েছেন। ফলে এ শ্রেণীর জীবনযাপন এবং মনমানসিকতা অর্ধউন্মাদ ভিখেরির পর্যায়ে নেমে এসেছে। তারা এখন পুরনো ভিখেরির জায়গা দখলে নেমে পড়েছেন, অন্য দিকে পেশাদার ভিখেরিরা ভিক্ষার অভাবে গ্রামগঞ্জে গিয়ে কাজ করে রীতিমতো সম্মানজনক পর্যায়ে পৌঁছে গেছেন।
উল্লেখিত সামাজিক বিবর্তনের মতোই হয়তো আমাদের জাতীয় কবির সময়কাল ভারতবর্ষ উলটপালট হচ্ছিল। ফলে তিনি লিখেছিলেন, চিরদিন কাহারও সমান নাহি যায়। আজকে যে রাজাধিরাজ, কাল সে ভিক্ষা চায়। স্বামী পঞ্চপাণ্ডব, সখা কৃষ্ণ ও ভগবান, দুঃশাসন করে তবু দ্রোপদীর অপমান, পুত্র তার হলো হতো যদুপতি যার সহায়… চিরদিন কাহারও সমান নাহি যায়!
জাতীয় কবির উল্লেখিত গানের কথামালা ২০২০ সালের জুন-জুলাই-আগস্ট মাসের বাংলাদেশের বাস্তবতার সাথে যে কিভাবে মিলে গেছে তা যদি তিনি দেখতেন; তবে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেতেন। কারণ পর্দার অন্তরালে যেসব ঘটনা ঘটছে এবং প্রকাশ্যে যা কিছু দৃশ্যমান হচ্ছে; তা আমরা মাত্র মাস ছয়েক আগে কল্পনাও করতে পারতাম না। এই যেমন জনৈক ক্ষমতাধর ব্যক্তির নিদারুণ অসহায় অবস্থা, অশ্রুসিক্ত নয়ন এবং কান্নাজড়িত কণ্ঠের কথাবার্তা যেভাবে টেলিভিশনের পর্দায় দেখলাম তা যে হতে পারে এমন ভাবনা ভদ্রলোকের জাতশত্রুও কোনোকালে কল্পনা করেননি। ক্ষমতাধর ভদ্রলোক ভুয়া করোনা সার্টিফিকেটের কবলে পড়ে সপরিবারে জাতীয়ভাবে বেইজ্জতি হয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন। তার মতো মানুষ কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রতারিত হবেন এটি বাংলাদেশের বাস্তবতায় রীতিমতো রোজ কিয়ামতের আলামত। অন্য দিকে দেশের একটি নামকরা বেসরকারি হাসপাতাল ভদ্রলোকের পরিবারের সদস্যদের যেভাবে করোনার রোগী বানিয়ে ফেলার সাহস দেখিয়েছেন তাও অকল্পনীয় বিষয়।
আলোচিত ক্ষমতাধর ব্যক্তির প্রাণপ্রিয় কন্যাকে নিয়ে যে সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে; সেটিকে তিনি নির্মম নিষ্ঠুর এবং সবিবেচকের কাণ্ড বলে অভিহিত করেছেন। মানুষ কিভাবে এতটা দায়িত্বহীন এবং নিষ্ঠুর হতে পারে এ অভিযোগ তুলে তিনি যখন নিজের রাজনৈতিক পদ-পদবি বংশীয় মর্যাদা এবং প্রিয় কন্যার প্রতি তার অপত্য স্নেহের কথা বর্ণনা করছিলেন তখন আবেগে তার কণ্ঠ রোধ হয়ে আসছিল। বোবা কান্নার বেদনায় তার চোখ, অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়ছিল। তিনি তার সারা জীবনের ঐতিহ্যকে উল্টিয়ে দিয়ে প্রথমবারের মতো নিজেকে অসহায়রূপে তুলে ধরলেন এবং বিচার প্রার্থনা করলেন।
টেলিভিশনে যখন উপরোক্ত দৃশ্য দেখছিলাম; তখন বারবার মনে হচ্ছিল সরকারি অব্যবস্থাপনা, সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতির রাহুগ্রাস এবং দুর্নীতিবাজদের উল্লাস নৃত্যের তাণ্ডবের কথা। মন্দলোকদের বহুমুখী পাপের কারণে চলমান করোনা সঙ্কট আমাদের আকাশে বাতাসে ফসলের মাঠে যেভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, তদ্রূপ ক্ষমতাধরদের সুরক্ষিত প্রাসাদ, লম্পটদের প্রেমকুঞ্জ, বিলাসী বিত্তবানদের কোলবালিশ ইত্যাদি সব কিছুই করোনার দখলে চলে গেছে। ফলে আজ আর আমরা কেউ নিরাপদ নই। আমরাও আলোচিত ক্ষমতাধরের মতো বিচার চাই- বিচার চাই তাদের, যারা দুর্নীতির জন্ম দেন এবং তা লালন করেন। আমরা চাই, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি কার্যকর করা হোক।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য, বাংলাদেশ সরকার